এটা আর অস্বীকার করার উপায় নেই যে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ভারতের জায়গা দখল করছে চীন। এর কারণ হলো এ অঞ্চলের দেশগুলোতে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের ব্যপারে চীনের আগ্রহ ও সদিচ্ছা। অন্যদিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের অর্থ বিনিয়োগে অনীহার পাশাপাশি রয়েছে গতানুগতিক অর্থনৈতিক ধ্যানধারণা।
তবে চীনের অর্থনৈতিক সামর্থ্য এবং পরিকল্পনার চেয়েও বড় বিষয় হলো অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তার হস্তক্ষেপ না করার নীতি।
আর এ কারণেই ৭ ডিসেম্বর মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লা ইয়ামিনের সফরের সময় যে যৌথ ইশতেহার ঘোষণা করা হয়, তাতে এ বিষয়টিকে নীতি হিসেবেই ঘোষণা করেছে বেইজিং।
ইশতেহার বলা হয়েছে, “চীন অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতিতে বিশ্বাসী এবং মালদ্বীপের নিজস্ব পরিমণ্ডলের উন্নয়নে তার স্বাধীন সিদ্ধান্তকেও সমর্থন করে চীন।”
এই যৌথ ইশতেহারের মাধ্যমে আসলে চীন দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের প্রতিই একটা বক্তব্য তুলে ধরেছে।
চীনের বিবৃতি ইয়ামিন সরকারের জন্য আকাশ থেকে পাওয়া ‘মান্না’র মতো। কারণ মানবাধিকার ও রাজনৈতিক অধিকারের ইস্যুতে তারা পশ্চিমা দেশগুলোর চাপের মধ্যে রয়েছে। পরিস্কারভাবেই বোঝা যায় এই চাপের উদ্দেশ্য হলো বিরোধী মালদ্বীভিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এমডিপি) সহায়তায় ক্ষমতার পালাবদল।
এই মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো চীনকে দেখছে নিরাপদ সাহায্যকারী হিসেবে, যেভাবে ভারতকে দেখা হয় না। এ অঞ্চলের দেশগুলো স্বাভাবিকভাবেই মনে করে যে, ভারতের যে কোন সহায়তার পেছনে স্বার্থ লুকানো আছে।
তারা একেবারে নিজস্ব স্বার্থে অন্যের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এ অঞ্চলে তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে চায়। এ অঞ্চলটাকে ভারত আসলে তার বাড়ির পেছনের উঠোন মনে করে।
চীনা সহায়তাকে স্বাগত জানানোর এটাই মূল কারণ যে ভারতের সাহায্যকে দেখা হয় সন্দেহের চোখে। এমনকি ভারতের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের ব্যপারে সন্দেহের কারণে তাদের সবচেয়ে ভাল প্রকল্পও প্রত্যাখ্যাত হয় বা অবাস্তবায়িত থেকে যায়।
শ্রীলঙ্কা
শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দ্র রাজাপাকসে ভারতকে দেখেন পশ্চিমা-নেতৃত্বাধীন জোটের সহযোগী হিসেবে, যারা একটা স্বাধীন নীতি (এখানে চীনমুখী নীতি) অনুসরণের কারণে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে।
প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা সিরিসেনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার শুরুতে চীনকে পাশ কাটিয়ে ভারত ও পশ্চিমাদের স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু দুই বছরের মধ্যেই তার অবস্থান বদলে গেছে। ভারতীয় প্রকল্পগুলো তুলে রেখে এখন চীনা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের দিকে এগুচ্ছেন তিনি।
বিতর্কিত হামবানতোতা বন্দর প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে এগুচ্ছে বর্তমান সরকার।
বিগত চীনঘেঁষা রাজাপাকসে সরকার এই প্রকল্পে চীনকে যতটা সুযোগ সুবিধা দেয়ার ব্যপারে চুক্তি করেছিল, তার চেয়ে বেশি দিচ্ছে বর্তমান সরকার।
অন্যদিকে, শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বেশি পশ্চিমাপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিত প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমাসিঙ্ঘেও প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন যে শ্রীলঙ্কা এখন চীনের ওবিওআর ও টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ম্যারিটাইম সিল্ক রুট প্রকল্পের অংশীদার।
যেসব প্রকল্পে যোগ না দেয়ার জন্য ভারত সবসময় শ্রীলঙ্কা ও অন্যান্য দেশগুলোকে সাবধান করে আসছে।
ভারত বলে আসছে, অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর জন্য একটি ঋণের ফাঁদ হলো এই ওবিওআর প্রকল্প। কিন্তু তার কথায় কেউ কান দেয়নি। এইসব দেশের তহবিল দরকার, একমাত্র চীনই সেটা দিতে সক্ষম। আর তাদের দৃষ্টিতে চীনা সাহায্য অন্তত রাজনৈতিক দুরভিসন্ধী নিয়ে আসবে না।
বাংলাদেশ
সাধারণভাবে ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত শেখ হাসিনা সরকার চীনের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে। শুধু চীনা অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তাই নয়, বাংলাদেশকে ওবিওআরের অংশীদারও ঘোষণা করেছে সরকার।
অস্থির মিয়ানমার থেকে ৬ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল যখন বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তখন ভারত এমনকি বাংলাদেশের ভারতপন্থী সরকারকেও সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়েছে। রাখাইন রাজ্যের অসহায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে “ইসলামী সন্ত্রাসী” রয়েছে মর্মে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর যে প্রচারণা, তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে বাংলাদেশকে তীব্র আঘাত করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
চীন মিয়ানমার সরকারের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় ক্ষুব্ধ হয় বাংলাদেশ। কিন্তু দ্রুত দুই দেশকে আলোচনার টেবিলে বসানোর মাধ্যমে নিজের অবস্থান শুধরে নেয় চীন। ওই আলোচনায় শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যপারেও সিদ্ধান্ত হয়। চীনের হস্তক্ষেপের কারণে রাখাইন রাজ্যে নৃশংস জাতিগত নির্মূলের প্রক্রিয়াও আপাতত থেমেছে।
খনিজ-সমৃদ্ধ মিয়ানমারে ভারতেরও প্রায় সমান অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থান রয়েছে, কিন্তু পরিস্থিতির উত্তরণে তার সামান্য ভূমিকাও দেখা যায়নি।
দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়ে একক অবস্থান তৈরির যে সুযোগ ছিল, তা নষ্ট করেছে ভারত। শিকলে যেন পা বাঁধা তাদের।
নেপাল
নেপালে ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত নেপালি কংগ্রেস-মাওবাদী কোয়ালিশান সরকার এক পর্যায়ে এসে ওবিওআরে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে চীনের সাথে সম্পর্ক জুড়েছে। চলমান নির্বাচনে কমিউনিস্ট জোটের বিজয়ের মাধ্যমে, ২০১৮ সাল থেকে হিমালয় অঞ্চলের এ দেশটিতে চীনের অবস্থান আরও শক্ত হবে বলেই মনে হচ্ছে।
মালদ্বীপ
মালদ্বীপে ভারতীয়দের ভূমিকাকে দেখা হয় পক্ষপাতমূলক এবং বিরোধী মালদ্বীভিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এমডিপি) সমর্থক হিসেবে। সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদের আমলে মর্যাদার প্রতীক মালে বিমানবন্দর আধুনিকায়ন প্রকল্পটির কাজ দেয়া হয়েছিলো ভারতীয় প্রতিষ্ঠান জিএমআর’কে।
কিন্তু নাশিদের অপসারণের পর ওই চুক্তি বাতিল করে কাজ দেয়া হয় চীনকে।
প্রতিশোধ হিসেবে ইয়ামিন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য পশ্চিমাদের সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে ভারত। তাদের অস্ত্র হলো এ সরকারের কথিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের রেকর্ড এবং এদের অধীনে ইসলামী মৌলবাদের কথিত উত্থানের প্রচারণা।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইয়ামিনকে নয়াদিল্লিতে স্বাগত জানালেও নিজে এখনও মালদ্বীপ সফর করেননি। যদিও দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রধান শত্রু পাকিস্তানসহ অন্যান্য সব দেশেই সফর করেছেন তিনি।
ভারতের অর্থনৈতিক সহায়তা প্রস্তাবকে সন্দেহের চোখে দেখছে মালদ্বীপ। যদিও প্রকাশ্যে তারা বলছে, ভারতীয় বিনিয়োগ ও সহায়তার জন্য তাদের দরজা খোলা।
মালদ্বীপের পক্ষ থেকে এটাও বলা হয়েছে যে, নিরাপত্তা প্রশ্নে অন্তত ভারত ও শ্রীলঙ্কা ছাড়া অন্য কারো সাথে কাজ করবে না তারা।
এর মধ্যে, গত ৭ ডিসেম্বর মুক্তি বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) এবং ওবিওআরে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে চীনের সাথে মালদ্বীপের সম্পর্ক উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়ে গেছে।
৭ ডিসেম্বরে দেয়া যুক্ত বিবৃতিতে বলা হয়ে যে, চীনা প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে ব্যবস্থা নেবে মালদ্বীপ সরকার। অন্যদিকে, নিজ দেশের নামিদামি প্রতিষ্ঠানগুলোকে মালদ্বীপে বিনিয়োগের জন্য উদ্বুদ্ধ করবে চীন। পাশাপাশি মালদ্বীপের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নেও সহায়তা করবে তারা।
এফটিএ- একটি মাইলফলক
ইয়ামিনের চীন সফরের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল এফটিএ স্বাক্ষর। এর ফলে মালদ্বীপের মাছ ও মাছজাত পণ্যের জন্য চীনের বিশাল বাজার খুলে গেছে, যেখানে তাদের পণ্য যাবে শুল্কমুক্তভাবে।
মাছ ছাড়াও আরও প্রায় ৪০০ মালদ্বীপের পণ্য এ চুক্তির ফলে সুবিধা পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মালদ্বীপের জন্য এটা আশীবার্দের মতো কারণ জিএসপি প্লাস সুবিধা তুলে নেয়ার পর দেশটির প্রধান বিদেশী বাজার ইইউ-এ ঢুকতে মালদ্বীপকে ২৫% শুল্ক দিতে হচ্ছিল।
এফটিএ-র ফলে সীমিত শুল্কে মালদ্বীপে শিল্পপণ্য রফতানি করতে পারবে চীন।
কিন্তু এতে মালদ্বীপের বাজার চীনা পণ্যে সয়লাব হয়ে যাবে এবং বিদ্যমান বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি আরও বেড়ে যাবে বলে সমালোচনা শুরু হয়েছে। ২০১৬ সালে মালদ্বীপে ৩২০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করেছে চীন।
অন্যদিকে চীনে মালদ্বীপের রফতানির পরিমাণ মাত্র ১৩৭ মিলিয়ন ডলার। তবে বাণিজ্য ঘাটতির ভারসাম্যের জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের এফডিআই প্রবাহ বাড়িয়েছে চীন।
মালদ্বীপ সরকার বলছে, উচ্চাকাঙ্ক্ষী অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক বৈচিত্রীকরণ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য তার কিছু চীনা পণ্যের প্রয়োজন হবে, এফটিএ’র কারণে যেগুলোর আমদানি সহজ হবে।
২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধীদের মানবাধিকার প্রচারণার মোকাবেলা করতে হলে ইয়ামিনকে কিছু উন্নয়ন প্রকল্প সামনে নিয়ে আসতে হবে।
নেতিবাচক দিক
৭ ডিসেম্বরের যৌথ বিবৃতির নেতিবাচক দিক হলো, মালদ্বীপ সরকার তার সকল পর্যায়ে এবং সকল বিভাগেই সহযোগিতার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। এতে মালদ্বীপ সরকারের সকল পর্যায়ে চীনের প্রভাব আরো বেড়ে যাবে।
আরো ভালোভাবে যোগাযোগ ও সহযোগিতার জন্য, মালদ্বীপবাসীর জন্য চীনা ভাষায় স্কুল চালু করবে চীন।
মালদ্বীপসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মানসিকতা, উদ্বেগ ও চাহিদার বিষয়টি বিবেচনা করে পশ্চিমা শক্তি ও ভারত যদি বাস্তবসম্মত কৌশল নিয়ে এগিয়ে না আসে, তাহলে এ অঞ্চলকে চীনা প্রভাববলয়ে হারিয়ে যাওয়া থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন