(১) কুরআনে উল্লেখিত আল-মাসজিদুল আকসা মানে, চার দেয়ালের ভেতরের অংশ ও চৌহদ্দির বাইরে দক্ষিণ দিকের কিছু অংশ। পুরোটা মিলেই ‘হারাম’ বা পবিত্র এলাকা। এই চৌহদ্দির যে কোনও স্থানে সালাত আদায় করলেই ‘আল-আকসায়’ সালাতের ফজিলত মিলবে। এর আয়তন ১৪৪০০০ বর্গমিটার।
.
(২) আল মাসজিদুল আকসা মানে শুধু ‘আল-জামেউল কিবালি’ বা শুধু ‘কুব্বাতুস সাখরা’ নয়। পুরো কমপ্লেক্সটাকেই আল-মাসজিদুল আকসা বলা হয়।
(৩) চার দেয়ালের অভ্যন্তরে, পুরো কমপ্লেক্সে অনেক স্থাপনা আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হল দু’টি :
ক. আল-জামেউল কিবালি তথা দক্ষিণ দিকের পুরনো মসজিদটা। এটাই মূল মসজিদে আকসা। ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর বিন খাত্তাব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এটা নির্মাণ করেছিলেন। সহিহ হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর প্রথম মসজিদ মক্কার বায়তুল্লাহ। তার চল্লিশ বছর পর নির্মিত হয়েছে বায়তুল মুকাদ্দাস।
খ. কুব্বাতুস সাখরা বা ডোম অব দি রক। সোনালি গম্বুজওয়ালা মসজিদটা। কমপ্লেক্সের উত্তর দিকের প্রায় মাঝামাঝিতে অবস্থিত। গম্বুজটা খেলাফতে রাশেদার যুগে ছিল না। মুয়াবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু), ইয়াযিদ বা মারওয়ানের যুগেও ছিল না। এটা নির্মিত হয়েছে ৬৯১ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চম উমাইয়া খলিফা আবদুল মালেক বিন মারওয়ানের (৬৮৫-৭০৫) শাসনামলে।
(৪) সাখরা (الصخرة) অর্থ পাথরখণ্ড বা ‘রক’। কুব্বাতুন (قبة) অর্থ গম্বুজ বা ‘ডোম’। পুরো কমপ্লেক্সের মধ্যে, এই পাথরখণ্ডটা ছিল উঁচু ভূমিতে। এই পাথরখণ্ডটাই ছিল পূর্বেকার নবীগণের কিবলার কেন্দ্রবিন্দুতে। অর্থাৎ এই পাথরখণ্ডকে কিবলার মূলবিন্দু ধরে সবাই সালাত আদায় করতেন। মদিনায় আসার পর মুসলমানরা এই ‘সাখরার’ দিকে মুখ করে সালাত আদায় করেছিল প্রায় ষোল মাস।
ইহুদিরাও এই পাথরখণ্ডকে মূল কেন্দ্রবিন্দু ধরে তাদের উপাসনা করত। কিছু খ্রিস্টান উপদলও এটাকে কিবলা মানত। উমর বিন খাত্তাব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করে দেখলেন, পাথরখণ্ডটা ময়লা-অবর্জনার স্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। খ্রিস্টানরা পরিকল্পিতভাবেই ‘সাখরার’ ওপর তাদের সমস্ত ময়লা-নোংরা ফেলত। তারা এটা করত ইহুদিদের অপমান করার জন্য। উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) দেখামাত্র ময়লা সরানোর নির্দেশ দেন। নিজেও ময়লা সরানোর কাজে লেগে পড়েন।
(৫) সাখরার আশপাশ পরিষ্কার করার পর, উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) একটা মসজিদ নির্মাণ করার প্রস্তুতি নিলেন। মসজিদটা কোথায় কিভাবে নির্মাণ করবেন, সে ব্যাপারে পরামর্শ করলেন। একপর্যায়ে কথা বললেন, কা‘বে আহবারের সঙ্গে। তিনি একজন তাবেয়ী। ইহুদি থেকে মুসলমান হয়েছেন। মুসলমান হওয়ার আগে তিনি একজন ইহুদি পণ্ডিত ছিলেন। এজন্য তাকে ‘আহবার’ বলা হয়। উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু)র প্রশ্নের উত্তরে কা‘ব বললেন, মসজিদটা সাখরার পেছনে মানে পূর্বপাশে নির্মাণ করতে পারেন। উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) তার কথা শুনে বললেন, ‘হে ইহুদি মায়ের বেটা, তোমার মধ্যে এখনো ইহুদিবাদ মিশে আছে। আমি বরং মসজিদটা সাখরার সামনে নির্মাণ করব।’
(৬) কা‘বের কথামত সাখরার পেছনে মানে পূর্বপাশে মসজিদটা নির্মাণ করলে সাখরা থাকবে সমজিদের সামনে। মানে মুসলমানরা যদিও কা‘বার দিকে মুখ করে দাঁড়াবে, কিন্তু পাশাপাশি আগের কিবলা ও ইহুদিদের কিবলা ‘সাখরা’ও মুসলমানদের সামনে পড়ে যাবে। এতে একপ্রকার ইহুদিদের কিবলার অনুসরণ হয়ে যাবে। দূরদর্শী উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) চট করেই ব্যাপারটা ধরে ফেলেছিলেন। তিনি মন্তব্য করলেন, তোমার মধ্যে এখনো আগের ইহুদিবাদের গন্ধ রয়ে গেছে। পুরনো কিবলার প্রতি দুর্বলতা রয়ে গেছে।
(৭) সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীগণের কেউ রক বা সাখরার কাছে সালাত আদায় করেননি। এখানে কোনও স্থাপনাও ছিল না। সাখরা একসময় মুসলমানদের কিবলা ছিল। পরে মানসুখ বা রহিত হয়ে গেছে। এখন মুসলমানদের কাছে সাখরার বাড়তি কোনও মূল্য নেই। সালাফের কেউ আল-আকসায় গেলে, মসজিদে কিবালি মানে উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) কর্তৃক নির্মিত মসজিদেই সালাত আদায় করতেন। পূর্বসুরী সালাফের কাছে সাখরা কোনও গুরুত্ব পেত না। মানসুখ বিষয়ের প্রতি আলগা দরদ ইসলাম সমর্থন করে না। এসব দরদ ফিতনা সৃষ্টি করে। (মাজমুয়া রাসায়েলে ইবনে তাইমিয়া রহ. অবলম্বনে)
(৮) ইহুদিদের কাছেও এই কমপ্লেক্সটা কয়েকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। যথা-
ক. কারণ তাদের প্রাচীন কিবলা এই কমপ্লেক্সের ভেতরে। ডোম অব দি রক বা কুব্বাতুস সাখরার নিচে। পাশাপাশি মুসলমানরাও মনে করে, এই সাখরা থেকেই নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মেরাজের রাতে উর্ধ্বাকাশে আরোহণ করেছিলেন।
খ. সাখরার নিচে একটা গুহা আছে। সেখানে সালাত আদায় করার মতো একটা মেহরাব আছে। সেটাকে বলা হয় (মুসাল্লাল আম্বিয়া) নবীগণের সালাতের স্থান।
গ. হায়েতুল বুরাক বা বোরাকের দেয়াল। এখানে নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মেরাজের রাতে তাঁর বোরাক বেঁধেছিলেন। আমরা এই দেয়ালকে বলি ‘হায়েতুল বুরাক’। ইহুদিরা এই দেয়ালকে বলে, ওয়েলিং ওয়াল বা ওয়েস্টার্ন ওয়াল। এটার অবস্থান কুব্বাতুস সাখরা ও মসজিদে কিবালির মাঝামাঝিতে। পশ্চিম দিকস্থ সীমানা প্রাচীরের কিছু অংশ। ইহুদিরা মনে করে, এই প্রাচীর সুলাইমান (আ.) যে মসজিদ বা হায়কাল নির্মাণ করেছিলেন, তার অবশিষ্টাংশ। বিশ্বের বড় নেতাদের কেউ গেলে এই দেয়ালের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা যেমন কাবাঘরে যাই, ইহুদিরাও এই ওয়ালের কাছে আসে। তাওরাত-তালমুদ পাঠ করে। আমাদের হেফযখানার তালিবে ইলমদের মতো আগে পিছে দুলে দুলে। দুআ মুনাজাত করে এবং কাঁদে।
(৯) পুরো কমপ্লেক্সের দিকটাও ঠিক করে নেয়া জরুরি। কমপ্লেক্সটাকে লম্বালম্বিভাবে আমরা উত্তরী-দক্ষিণী ধরে নিতে পারি। এই হিসেবে, কুব্বাতুস সাখরা আছে কমপ্লেক্সের উত্তর দিকের মাঝামাঝিতে। জামে কিবালি বা পুরনো গম্বুজের মসজিদটি আছে কমপ্লেক্সের দক্ষিণ দিক ঘেঁষে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন