ইরানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ও সহিংসতার বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করেছে রাশিয়া। একটি দেশের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে’ জড়িয়ে জাতিসংঘের শীর্ষ এ পরিষদটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছে তারা। রাশিয়ার সঙ্গে গলা মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য চীন ও ফ্রান্সও। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি নস্যাৎ করে তারা বলেছে, ইরানের চলমান বিক্ষোভ কোনোভাবেই আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়। গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানে ওই জরুরি বৈঠক বসে।
গতকাল ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফ নিরাপত্তা পরিষদের ওই বৈঠক সম্পর্কে বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের ক্ষমতা ছিনতাইয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্র নগ্নভাবে যে চেষ্টা চালিয়েছে তাকে ‘রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে’ নিরাপত্তা পরিষদ। তিনি বলেন, বেশির ভাগ সদস্যই জেসিপিওএর (পরমাণু চুক্তি) পূর্ণ বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছে এবং অন্যদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে বলেছে।
গত ২৮ ডিসেম্বর ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় মাশহাদ শহরে দেশটির অথনৈতিক দুরবস্থা ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে স্থানীয়রা। পরে তা সরকারবিরোধী বিক্ষোভে রূপ নিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী বিক্ষোভ-সহিংসতায় অন্তত ২১ জন নিহত হয়েছে। কিন্তু গত বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার ইরানের রাজপথে সরকার সমর্থকরা নেমে আসে। তারা বিশাল শোডাউন করে। এ সময় কয়েকটি প্রদেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্রভাবে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের খবর পাওয়া গেলেও তার সত্যতা সংবাদমাধ্যমগুলো নিশ্চিত করতে পারেনি। তবে রাজধানী তেহরান ছিল হাজার হাজার সরকারপন্থীর দখলে। বুধবার ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের প্রধান জাফারি বিক্ষোভের নামে দেশের বিভিন্ন শহরে হওয়া ‘বিদ্রোহ পরাজিত হয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। বিক্ষোভ চলাকালেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সরকারবিরোধীদের প্রতি বিভিন্নভাবে সমর্থন ব্যক্ত করে আসছিলেন। শুক্রবার তাদের ডাকে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি সভা বসে।
নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি ইরানের বিক্ষোভকে ‘সাহসী জনগণের শক্তিশালী প্রদর্শনী’ হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ‘ইরানের শাসকরা এখন নজরদারিতে আছেন, বিশ্ব এখন নজর রাখছে আপনারা কী করছেন।’ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘ইরানের সেই মানুষগুলোর পাশে ওয়াশিংটন দ্বিধাহীনভাবে আছে, যারা স্বাধীনতা চায়, পরিবারের সমৃদ্ধি চায় এবং জাতির জন্য মর্যাদা চায়।’
এর প্রতিক্রিয়ায় ইরানের রাষ্ট্রদূত গোলাম আলী খশরু বলেন, যুক্তরাষ্ট্র স্থায়ী সদস্য হিসেবে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকার ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। ‘ইরানের এই বিক্ষোভ যে বিদেশ থেকে পরিচালিত হচ্ছে তার শক্ত প্রমাণ আমাদের সরকারের হাতে আছে। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, কিছু সদস্যের আপত্তি সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসনের অপব্যবহারে নিজেকে এমন একটি বিষয়ে সমর্পিত করল নিরাপত্তা পরিষদ, যা তার ক্ষমতার বাইরে।’
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের তীব্র সমালোচনা করে রাশিয়া। জাতিসংঘে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভাসিলি নেবেনজিয়া বলেন, ‘বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ ছিল না। আমরা অবশ্যই বিক্ষোভে নিহতদের প্রতি শোক প্রকাশ করছি। যাই হোক, যেহেতু সমস্যাটি ইরানের, তাই সেটা তাদেরকেই সামলাতে দিন।’ যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে নেবেনজিয়া আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি মানলে ২০১৪ সালের আগস্টে মিসৌরির ফার্গুসনে হওয়া কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতিবাদের সময়ও নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক হওয়া উচিত ছিল। শ্বেতাঙ্গ পুলিশ সদস্যের গুলিতে নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ যুবক নিহতের ওই ঘটনায় পরে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ সংঘটিত হয়েছিল।
বৈঠকে ফ্রান্স জানায়, ইরানের বর্তমান পরিস্থিতিতে যেকোনো ধরনের হস্তক্ষেপ পাল্টা ফল বয়ে আনতে পারে। জাতিসংঘে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত ফ্রাঁসোয়া দেলাত্রে বলেন, ইরানের চলমান বিক্ষোভ আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়। ইরানের সঙ্গে ২০১৫ সালে করা ছয় বিশ্বশক্তির স্বাক্ষরিত পরমাণু চুক্তির বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক মহলকে সচেষ্ট হওয়ারও আহ্বান জানান তিনি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরু থেকেই ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তির সমালোচনা করে আসছেন। তেহরান চুক্তি অনুযায়ী কাজ করছে, গত বছরের অক্টোবরে এমন প্রত্যয়ন দিতেও অস্বীকৃতি জানায় তাঁর প্রশাসন।চীন ইরানের বিক্ষোভকে দেশটির ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ হিসেবে অভিহিত করে বলেছে, নিরাপত্তা পরিষদের আলোচনা সংকট সমাধানে সহযোগিতা করবে না।
সূত্র : এএফপি, বিবিসি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন