কেরালার সবরীমালায় আয়াপ্পা মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকলো। বলা হলো, মহিলারা যে বয়স পর্যন্ত ঋতুবতী থাকেন, সেই বয়স পর্যন্ত তারা অপবিত্র। তাই ১০ থেকে ৫০ বছর বয়সি মহিলাদের মন্দিরে প্রবেশ নিষেধ।
এমনটাই বিধান মন্দির কর্তৃপক্ষের। অর্থাৎ মন্দিরে প্রবেশেও সেই লিঙ্গ-বৈষম্য। ভারতের দক্ষিণী রাজ্য কেরালার সবরীমালায় পাহাড়ের ওপর স্থাপিত বিখ্যাত আয়াপ্পা মন্দিরে প্রবেশের জন্য মহিলা ভক্তদের দেখাতে হবে বয়সের প্রমাণপত্র।
যে বয়সে একটি মেয়ে ঋতুবতী হয় এবং যে বয়স পর্যন্ত সেটা থাকে জৈবিক নিয়মে, সেই বয়স পর্যন্ত তাদের অশুচি, অপবিত্র বলে গণ্য করা হয়। সেকারণেই মন্দিরে তাদের প্রবেশ নিষেধ। সেই হিসেবে এই নিষেধাজ্ঞা ১০ থেকে ৫০ বছর বয়সি মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
৫০ বছরের পর সাধারণত ঋতু নিবৃত্তি হয়ে থাকে। মন্দিরের পরিচালন কর্তৃপক্ষ ত্রিবাঙ্কুর দেবাস্থানম বোর্ড এই নিষেধাজ্ঞা জারি করে বলেছে, বিশেষ বিশেষ তিথিতে আয়াপ্পা মন্দির দর্শনে আসে হাজার হাজার মহিলা। তখন তারা এই নিষেধাজ্ঞা মানে না। যেমন, তিন মাসব্যাপী বাত্সরিক তীর্থ যাত্রা শুরু হয় তিন পর্যায়ে। এ বছর তা শেষ হবে আগামী ১৪ই জানুয়ারি মকরভিলাক্কু (মকর সংক্রান্তি) উত্সবে। ঋতুকালীন বয়সসীমার কোনো মেয়ে বা মহিলার সবরীমালার আয়াপ্পা মন্দিরে পূজা দেওয়া নিষিদ্ধ। কারণ, মন্দিরের বিগ্রহ আয়াপ্পাকে অবিবাহিত ব্রম্মচারী বলে মানা হয়।
মন্দির কর্তৃপক্ষের প্রধান পদ্মকুমার বলেছেন, বয়সের প্রমাণপত্র হিসেবে দেখাতে হবে আধারকার্ডসহ বার্থ সার্টিফিকেট। সবরীমালা পাহাড়ের ওপর মন্দির দর্শনের আগে পাহাড়ের নীচেই বয়সের প্রমাণপত্র পরীক্ষা করা হয়। কারণ, দেখা গেছে, ১০ থেকে ৫০ বছর বয়সি অনেক মহিলা মন্দিরে ঢুকে পড়েন। অনেক সময় বয়স নিয়ে মন্দির কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা কর্মীদের সঙ্গে বচসা, ঝগড়াঝাটি হয়। মেয়েদের সঙ্গে পুরুষ অভিভাবকরা যে বয়সটা বলেন, মন্দির কর্তৃপক্ষের তা বিশ্বাস হয় না। শুরু হয় বচসা।
সম্প্রতি বয়স নিয়ে তর্কাতর্কির পর শেষ পর্যন্ত বয়সের প্রমাণপত্রে দেখা যায়, মেয়েটির বয়স ১১ বছর, অর্থাৎ নির্ধারিত বয়স সীমার চেয়ে এক বছর বেশি। মেয়েটিকে যেতে দেওয়া হয়নি। সবরীমালা মন্দির বোর্ডের প্রেসিডেন্ট পদ্মকুমার আরো জানান, চলতি মহাতিথিতে, যেটা শুরু হয় গত বছরের নভেম্বর মাসে, ১০ থেকে ৫০ বছর বয়স সীমার ২৬০ জন মহিলাকে মন্দিরে যেতে দেওয়া হয়নি। তবে এদের অনেকের হয়ত সবরীমালা মন্দিরের নিয়মবিধি জানা ছিল না। মহিলাদের মধ্যে বেশি আসেন, কেরালা, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা ও কর্নাটক থেকে।
ধর্মবিশ্বাস আর আচরণে এই বিপ্রতীপ অবস্থান মুসলিম সমাজেও আছে। মুম্বাইয়ের বিখ্যাত পীর হাজি আলি দরগার মাজারে মুসলিম মহিলাদের ঢোকা বারণ। ধর্মস্থানেও এই লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় মুসলিম মহিলা জাকিয়া সোমান এবং নূরজাহান নিয়াজ। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে মুম্বাই হাইকোর্টে মামলা করেন। বলেন, ‘এটা ভারতের নাগরিক হিসেবে তাদের মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার লংঘন। সেকেলে পুরুষতান্ত্রিকতা কখনোই পুরুষ মহিলাদের সম-অধিকার কেড়ে নিতে পারে না।'
মুম্বাই হাইকোর্ট মহিলাদের পক্ষে রায় দেন। হাজি আলি ট্রাস্ট সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলে সুপ্রিম কোর্টও হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। পাঁচ বছর পর মুসলিম মহিলারা হাজি দরগায় প্রবেশের অধিকার অর্জন করেন।
এই লিঙ্গ-বৈষম্য ও পুরুষতান্ত্রিকতা মহারাষ্ট্রের শনি মন্দিরেও আছে। ঐ শনিদেবের মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ। পুরুষ পুরোহিতদের বিধান শনি মন্দিরে নারী প্রবেশ করলে অমঙ্গল হয়। মুম্বাই হাইকোর্টের রায় হিন্দু মন্দিরের ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য হচ্ছে না কেন সেটাই প্রশ্ন।
ঋতুকালীন কয়েকটা দিনে মহিলারা নিজেরাই মন্দিরে প্রবেশ করেন না বা পুজা ইত্যাদি দেন না। আসলে ঋতুস্রাবকে সমাজে অপবিত্রের ঘেরাটোপে বেঁধে রাখা হয়েছে বহুকাল ধরেই। শুধু ধর্মস্থানে প্রবেশ নিষিদ্ধ নয়, কোনো পারিবারিক শুভকাজেও তাদের অংশ নেওয়া নিষিদ্ধ। রান্নাবান্না খাওয়াতেও এই অন্ধ বিশ্বাস আজও কাজ করে। প্রান্তিক এলাকায় এমনও দেখা গেছে, পিরিয়ডকালে তাদের রাখা হয়েছে গোয়াল ঘরে বা অস্বাস্থ্যকর জায়গায়। ফলে নানা রকম সংক্রমণের শিকার হয়ে পড়েন তারা। কিছুদিন আগে নেপালে একটি কিশোরীকে উঠানের কোণায় একটা ঘরে রাখা হয়। সেখানে রাতে সাপের কামড়ে সে মারা যায়।
সূত্র: ডয়চে ভেলে
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন