গতমাসে ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিলিস্তিনিদের ব্যাপকভাবে ক্ষুব্ধ করে ইসরাইলে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। অথচ ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেমকে তাদের ভবিষ্যত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ভেবে আসছেন। যদিও এতে কিছু ভয়ভীতি ছাড়া মুসলিম দেশগুলোতে ব্যাপক আকারে কোন অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েনি। সারা বিশ্ব যেখানে নতুন এই নীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১২৮/৯ ভোটে নিন্দা প্রস্তাব পাস হয়েছে সেখানে মনে হচ্ছে আরব দেশগুলো বিষয়টিকে এক প্রকার মেনেই নিয়েছে।
গত সপ্তাহে নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যে, একজন মিশরীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা প্রভাবশালী টকশো হোস্টদের ডেকে নিয়ে বলে দিয়েছেন, তাদের দর্শকদের যেন ইসরাইল বিরোধী বিক্ষোভের খবর থেকে দূরে রাখা হয়।
এই ইস্যুতে আরব দেশগুলো উদাসীনতা দেখানোয় যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রক্ষণশীল প্রমাণ করতে চান যে, ট্রাম্পই সঠিক ছিলেন। ''ফিলিস্তিনিদের নৈরাজ্য সৃষ্টির হুমকিকে'' আমলে না নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার করায় ট্রাম্পের তোষামোদি করেছে দ্য ডেইলি কলার। ন্যাশনাল রিভিউতে ডগলাস ম্যুর লিখেছেন, "যুক্তরাষ্ট্র নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের পরাস্ত করেছে এবং অন্তত এইবার কেবল উপরে উপরে বিরোধিতা করা থেকে বেরিয়ে এসেছে।"
এই বিতর্কগুলো ট্রাম্পের ঘোষণার বিরোধীতা করার প্রধান কারণ এবং বিশেষত আমেরিকার রাজনীতিতে পাত্তা না পাওয়া ফিলিস্তিনিদের অব্যাহত দূর্গতির বিষয়টি ধরতে পারেনি।
ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত কেবল এই কারণেই ধ্বংসাত্মক নয় যে, এটা সংঘাত তৈরি করতে পারে। বরং এটা সংকট নিরসনে ইসরাইল-ফিলিস্তিন দুই রাষ্ট্র সমাধানের যে ক্ষীণ আশা ছিল তাকেও দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং দুই রাষ্ট্র সমাধানের পরিবর্তে এক রাষ্ট্র সমাধানকেই স্থির করে দিয়েছে। আর সেটা হল দখলিকৃত ভূমিসহ আরও শক্তিশালী ইসরাইল রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্র ইহুদিবাদী রাষ্ট্র হতে পারে কিংবা হতে পারে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু এক সাথে দুটিই হতে পারবে না। এভাবে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত উদারনৈতিক ইহুদিবাদের কফিনে আরো একটি পেরেক ঠুকে দিল।
ট্রাম্প প্রশাসন যখন প্রথমিকভাবে দূতাবাস সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করে তখন দাবি করে যে, তারা একটি চূড়ান্ত শান্তি চুক্তি হওয়ার ক্ষেত্রে জেরুজালেমের মর্যাদাকে খাটো করে দেখছে না। কিন্তু ইসরাইল-ফিলিস্তিন উভয় দেশের নাগরিকরাই বুঝতে পারছেন- এ ঘোষণায় ট্রাম্প মূলত ইসরাইলকে ফিলিস্তিনি ভূমি জবরদখলের পূর্ণক্ষমতা প্রদান করেছে।
ট্রাম্পের ঘোষণার পরপরই ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি পশ্চিম তীরে ইসরাইলী বসতি স্থাপন বাস্তবায়িত করার আহ্বান জানিয়ে একটি রেজ্যুলেশন পাস করেছে। ফিলিস্তিনের সাথে শান্তি চুক্তিকে প্রতারণাপূর্ণভাবে আরো বিলম্বিত করে দিয়ে সমগ্র জেরুজালেমে নিজেদের পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় একটি সংশোধিত বিল পাস করেছে নেসেট (ইসরাইলী পার্লামেন্ট)।
পিএলও (প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাজাইশন)'র কেন্দ্রীয় পরিষদের একজন সদস্য মুস্তাফা বারগুতি আমাকে বলেছেন, ‘ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের আগে শান্তি প্রক্রিয়া ঝিমিয়ে পড়া অবস্থায় থাকলেও অনেকেই বিশ্বাস করতেন এটা হয়ত কখনও পুনরায় চালু হবে। কিন্তু ট্রাম্প সে সম্ভাবনাকে একেবারে পন্ড করে দিয়েছে।’
এসব ইচ্ছাকৃত বলেই প্রতীয়মান হয়। ট্রাম্প প্রশাসনকে নিয়ে লেখা মিখাইল উলফের সদ্যপ্রকাশিত বই 'ফায়ার এন্ড ফিউরি'তে তিনি স্টিভ ব্যাননকে উদ্ধৃতি করেছেন, যেখানে ব্যানন মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে গর্ব প্রকাশ করেন। ব্যানন এটাকে আখ্যায়িত করেন ফিলিস্তিনিদের জাতীয় আকাঙ্ক্ষার মৃত্যুঘণ্টা হিসেবে।
ফক্স নিউজের প্রধান নির্বাহী রজার আয়েলসকে ব্যানন বলেন, 'আমরা ভালভাবেই জানি, আমরা এটাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি। এখন জর্ডান পশ্চিম তীর নিক আর মিশর নিয়ে নিক গাজা।"
ব্যাননের গ্রেট গেম কল্পনা সত্ত্বেও এটি ঘটতে যাচ্ছে না। বরং ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা যদি শেষ হয়ে যায় তাহলে সমস্ত অঞ্চলই ইসরাইল তার নিয়ন্ত্রণাধীনে নিয়ে নিবে। সেখানে প্রতিষ্ঠা পাবে মাত্র একটি রাষ্ট্র। এখন প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্রটির ধরণ কেমন হবে।
যা অনুমান করা যায় তা হল এমন এক ব্যবস্থা কায়েম হবে যেখানে ফিলিস্তিনিরা হয়ে পড়বে রাষ্ট্রহীন এবং তাদেরকে শাসন করা হবে ইসরাইলী নাগরিকদের চেয়ে ভিন্নতর আইনকানুন দিয়ে।
লিকুদ পার্টির পার্লামেন্ট সদস্য ইউয়েভ কিশ ইতিমধ্যে একটি পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছেন যেখানে ফিলিস্তিনিরা পশ্চিম তীরে সীমিত পর্যায়ে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন পাবে; নাগরিকের বদলে তারা 'স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের বাসিন্দা'
হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।
ইসরাইলকে 'জাতিবিদ্বেষী' বললে ইসরাইল সমর্থকদের মনে চোট লাগে। কিন্তু যখন কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একটি জাতি অন্য জাতির উপর শাসনের ছড়ি ঘোরায়, একটি ক্ষুদ্র অঞ্চলে ঐ জাতিটিকে জোরপূর্বক অবরুদ্ধ করে রাখে, তাদের সমস্ত রাজনৈতিক অধিকারকে অস্বীকার করে তখন সেটিকে জাতিবিদ্বেষী ছাড়া আর কী বলা যায় তা আমাদের জানা নেই। ইসরাইলকে 'জাতিবিদ্বেষী' বলাটাই বরং দিনকে দিনকে অনিবার্য হয়ে উঠছে।
অন্যদিকে সংখ্যায় কম হলেও ফিলিস্তিনিরা স্বাধীনতা ও সমঅধিকারের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে এবং সময়ের সাথে তারা সংখ্যায় বাড়ছে।
এ ব্যাপারে মুস্তাফা বারগুতি বলেন, 'ইসরাইল যদি দুই রাষ্ট্র সমাধানের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দেয় তাহলে একটাই বিকল্প থাকে- আর সেটা হল, পূর্ণগণতান্ত্রিক ফিলিস্তিন রাষ্ট্র সমাধান। যেখানে প্রত্যেকেই সমঅধিকার ভোগ করবে।'
বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, ইসরাইল কখনও এটা মেনে নিবে না। যদিও এ অঞ্চলের জনসংখ্যাগত পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায় শিগগিরই ফিলিস্তিনিরা জনসংখ্যার দিক দিয়ে ইসরাইল ও দখলকৃত ভূমির তুলনায় সংখ্যাগুরুতে পরিণত হবে। যদি তাদের সকলকে ভোটাধিকার দেওয়া হয় তাহলে ইসরাইলের ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাটা আর হয়ে উঠবেনা।
কিন্তু এখন সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় ফিলিস্তিনিদের যে যুদ্ধ তার বিরোধিতা করাটা অধিকাংশ ইহুদি ডায়াস্পোরাসহ পুরো বিশ্বের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। কৈফিয়তদানকারী ইসরাইলীদের এখন কেবল বাকি থাকল কুখ্যাত জিম ক্রো আইনের সমর্থনে উইলিয়াম এফ. বাকলে একসময় যে যুক্তি দিয়েছিলেন, তার পুণরাবৃত্তি করা। ১৯৫৭ সালে বাকলে বলেছিলেন, 'সাউথ (যুক্তারাষ্ট্রের দক্ষিণের রাজ্যগুলো)'র শেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের উপর প্রভাব বিস্তারের অধিকার রাখেন। যেখানে সাদারা সংখ্যার দিক দিয়ে বেশি নয় সেখানে প্রভাব বিস্তারের প্রয়োজনে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। সাদারা এই অধিকার রাখেন, কারণ জাতি হিসেবে তারা শ্রেষ্ঠ।'
এরকম ব্যবস্থা ইসরাইল ঠিক কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারবে তা বলা না গেলেও এটা অন্তত বলা যায় যে, উদার ইহুদিবাদের যে স্বপ্ন ছিল তা হারিয়ে যাবে। খুব সম্ভবত ইতিমধ্যেই এটা ঘটে গেছে।
(নিউইয়র্ক টাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন