ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের অভ্যন্তরভাগ অশান্ত হয়ে উঠেছে। প্রধান বিচারপতি দিপক মিশ্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন চারজন বিচারক। এ নিয়ে তোলপাড় চলছে ভিতরে ভিতরে। এটর্নি জেনারেল কে কে বেণুগোপাল ‘সব মিটে গেছে’ দাবি করলেও পর্দার আড়ালের খবর অন্য। এ ঘটনাকে ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা বর্ণনা করেছে এভাবে: অগ্ন্যুৎপাত বন্ধ হয়েছে। কিন্তু লাভা এখনও টগবগিয়ে ফুটছে।
বিদ্রোহী চার বিচারপতির অভিযোগ, প্রধান বিচারপতি বাছাই করা কয়েকজন বিচারপতির বেঞ্চেই পাঠাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সব মামলা। তারা হলেন বিচারপতি জে চেলামেশ্বর, রঞ্জন গোগোই, এম বি লোকুর ও কুরিয়ান জোসেফ। এ নিয়ে গত সপ্তাহে বিদ্রোহ শুরু হয়। বিদ্রোহ করে বসেন চারজন বিচারপতি একে সিক্রি, এএম খানবীলকার, ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় ও অশোক ভূষণ।
প্রধান বিচারপতি ও এই চারজন বিচারককে নিয়ে গড়ে উঠেছে পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ। চার বিচারপতি বিদ্রোহ করে শুনানি বা আদালত বর্জন করলেও সেই অবস্থায় বেঞ্চ চালিয়ে নিচ্ছিলেন প্রধান বিচারপতি। এরপর সোমবার তারা চা চক্রে মিলিত হন। তাতে সব সমস্যা মিটে গেছে বলে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে আনন্দবাজার লিখেছে, প্রধান বিচারপতি এখনও নিজের অবস্থানে অনড়। কারণ, এক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে শুধু প্রশাসনিক গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে তা-ই নয়, সরকারের চাপের মুখে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা বিসর্জনের ইঙ্গিতও রয়েছে। সিদ্ধান্ত বদলালে মেনে নেওয়া হবে, প্রধান বিচারপতি ভুল করছিলেন। ওদিকে অনলাইন জি নিউজ বলছে, দৃশ্যত সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মধ্যকার তিক্ততা মিটে গেছে বলে মনে হচ্ছে। তবে এটর্নি জেনারেল বেণুগোপাল মঙ্গলবার নিশ্চিত করে বলেছেন, বিচার বিভাগীয় সঙ্কটের এখনও সমাধান হয় নি। এ সমস্যা সমাধান হতে আরো দু’তিন দিন সময় লাগতে পারে। এর ফলে ভারতের প্রধান বিচারপতি দিপক মিশ্রের সঙ্গে অন্য বিচারপতিদের যে বিদ্রোহ ও অসন্তোষের খবর পাওয়া যাচ্ছে তা মিটে গেছে তা বলা যাবে না। এমন অবস্থায় ১৭ই জানুয়ারি বুধবার থেকে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু মামলার শুনানি শুরু হওয়ার কথা সাংবিধানিক ওই বেঞ্চে। এর মধ্যে রয়েছে আধার অ্যাক্ট-এর বৈধতা, প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার বিষয়টিতে দেয়া রায়ে সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা, কেরালার শবরিমালা মন্দিরে নারীদের প্রবেশ সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা।
২০১৭ সালের ১০ই অক্টোবর থেকে এই পাঁচ বিচারকের বেঞ্চ ভারতের গুরুত্বপূর্ণ সব মামলার শুনানি করেছে। এর মধ্যে রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার ও দিল্লির সরকারের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে টানাটানি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ১২ই জানুয়ারি অপ্রত্যাশিতভাবে সংবাদ সম্মেলন করেন ওই বেঞ্চের অন্য চারজন বিচারক। তারা প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে, তিনি বাছাই করা কিছু বিচারকের বেঞ্চে গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলো স্থানান্তর করছেন। বিদ্রোহী এমন চার বিচারকের একজন চেলামেশ্বর বলেছেন, আমরা প্রধান বিচারপতিকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। আমাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এভাবে একটি দেশে গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে না। ওদিকে আনন্দবাজার পত্রিকা মঙ্গলবার এ নিয়ে যে রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে তা এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো:
অগ্ন্যুৎপাত বন্ধ হয়েছে। কিন্তু ভিতরে লাভা এখনও টগবগিয়ে ফুটছে। গত সপ্তাহের পশষ কাজের দিনে চার প্রবীণ বিচারপতি ‘বিদ্রোহ’ ঘোষণা করেছিলেন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের বিরুদ্ধে। সোমবার সুপ্রিম কোর্টের দিন শুরু হল বিচারপতিদের ‘চায়ে পে চর্চা’ দিয়ে। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সুপ্রিম কোর্টের শুনানি শুরু হয়। তার আগে প্রতিদিনই, বিশেষ করে সোমবার সকাল সওয়া ১০ টায় জাজেস লাউঞ্জে বিচারপতিরা এক সঙ্গে চা খেয়ে থাকেন। সোমবারও তা-ই হল। ফারাক হল, এ’দিন চায়ে পে চর্চার সময় রেজিস্ট্রার ও অন্যান্য কর্মীদের বাইরে যেতে বলা হয়। আলোচনাও ১৫ মিনিটে থামেনি। ফলে সব এজলাসেই শুনানি শুরু হয় দেরিতে। দেরিতে হলেও প্রধান বিচারপতি এবং ক্ষুব্ধ বিচারপতিদের এজলাসে নিয়মমাফিকই শুনানি হয়।
যা দেখিয়ে সোমবার কেন্দ্রের অ্যাটর্নি জেনারেল কে কে বেণুগোপাল বলেন, ‘‘সব মিটে গিয়েছে। আদালতের কাজও স্বাভাবিকভাবে চলছে। চায়ের কাপে তুফান উঠেছিল!’’ একই দাবি বার কাউন্সিনের চেয়ারম্যান মানান মিশ্রেরও। ঘটনাপ্রবাহ বা সূত্র কিন্তু তুফান থামার ইঙ্গিত দিচ্ছে না। প্রধান বিচারপতির এজলাসে শুনানির শুরুতেই আইনজীবী আর পি লুথরা শুক্রবারের প্রসঙ্গ টেনে ক্ষুব্ধ বিচারপতিদের কার্যত ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘‘আদালতের অবমাননা হলে পদক্ষেপ করুন। আমরা দেশদ্রোহীদের হাতে প্রতিষ্ঠান ভাঙতে দেব না।’’
প্রধান বিচারপতি দু’একবার ‘নো’ ‘নো’ বলা ছাড়া নীরবই ছিলেন। (আর পি) লুথরা কোনও মামলার প্রসঙ্গ ছাড়াই এ সব বললেও পুরোটা শুনে শেষে মৃদু হাসেন তিনি। বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুত চূড়ান্ত করার আবেদন জানিয়ে এই লুথরা’র করা মামলাটি বিচারপতি এ কে গয়ালের বেঞ্চে পাঠানো নিয়েও ক্ষুব্ধ বিচারপতিরা প্রধান বিচারপতিকে লেখা চিঠিতে আপত্তি তুলেছিলেন। অন্দরের খবর, এক দিকে প্রধান বিচারপতি, অন্য দিকে চার ‘বিদ্রোহী’ বিচারপতি, দু’পক্ষই নিজেদের অবস্থানে অনড়। ক্ষুব্ধ বিচারপতিদের নির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল, গুরুত্বপূর্ণ মামলা প্রধান বিচারপতি বাছাই করা কয়েক জন বিচারপতির বেঞ্চে পাঠাচ্ছেন। সুপ্রিম কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশন দাবি তোলে, যাবতীয় জনস্বার্থ মামলা প্রথম পাঁচ বিচারপতিই শুনুন।
সূত্রের খবর, প্রধান বিচারপতি এখনও নিজের অবস্থানে অনড়। কারণ এ ক্ষেত্রে শুধু প্রশাসনিক গাফিলতির অভিযোগ ওঠেনি। সরকারের চাপের মুখে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা বিসর্জনের ইঙ্গিতও রয়েছে। সিদ্ধান্ত বদলালে মেনে নেওয়া হবে, প্রধান বিচারপতি ভুল করছিলেন। সেই সূত্র মেনে, বিচারক লোয়ার মামলা মঙ্গলবার বিচারপতি অরুণ মিশ্রের বেঞ্চেই শুনানি হবে। বুধবার থেকে আধার, শবরীমালা, ৩৭৭ ধারা-র মতো আটটি মামলার শুনানি সাংবিধানিক বেঞ্চে শুরু হবে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সেই বেঞ্চেও চার প্রবীণ বিচারপতিকে রাখা হয়নি।
আইনজীবীদের ব্যাখ্যা, প্রকাশ্যে কলহ চালিয়ে গেলে সরকার তার সুযোগ নিতে পারে বলেই ফের প্রকাশ্য সংঘাতে যাচ্ছেন না বিচারপতিরা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন