কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণে অর্থায়নে দীর্ঘ দিনের জটিলতার অবসান হয়েছে। প্রতিশ্রুত ঋণের টাকার প্রথম কিস্তি গত ডিসেম্বরে ছেড়েছে চীনের এক্সিম ব্যাংক। ফলে টানেল নির্মাণ কাজে গতি সঞ্চার হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) এশিয়া উইংয়ের যুগ্ম-সচিব ড. একেএম মতিউর রহমান।
এ বিষয়ে ইআরডি সচিব কাজী শফিকুল আযম যুগান্তরকে বলেন, কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পে অর্থায়নের জটিলতা চলছিল অনেক দিন ধরেই। ঋণ চুক্তির পর অর্থছাড় হচ্ছিল না। কিন্তু ইআরডির সফল নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে গত নভেম্বরে এ প্রকল্পের জন্য ব্যবস্থাপনা ফি পাঠানো হয়। তারপর ৭ ডিসেম্বর ১৩ কোটি ৭৬ লাখ মার্কিন ডলার (১ হাজার ১০৮ কোটি টাকা) ছাড় করেছে চায়না এক্সিম ব্যাংক। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এখন আর কোনো সমস্যা থাকবে না বলে আশা করছি। এখন প্রকল্পের কাজে গতি সঞ্চার হবে।
সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের ঢাকা সফরে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তি অনুযায়ী, চীনের এক্সিম ব্যাংক ২০ বছর মেয়াদি ঋণ দেবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শি জিন পিং একই সঙ্গে টানেলের নির্মাণ কাজের উদ্বোধনও করেন। কিন্তু এরপরই নানা জটিলতায় আটকে যায় ঋণের অর্থছাড়। ফলে টানেল নির্মাণের মূল কাজে স্থবিরতা তৈরি হয়। শুরু হয় নানা দেন-দরবার। ব্যাপক আলাপ-আলোচনার পর গত নভেম্বরের শেষ দিকে চীনের এক্সিম ব্যাংকের কাছে পাঠানো হয় ব্যবস্থাপনা ফি। এক্ষেত্রে ঋণের শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ হারে ১৪ লাখ ২ হাজার ৩৯০ মার্কিন ডলার (প্রতি ডলার ৮০ টাকা হিসাবে প্রায় ১১ কোটি ২১ লাখ ৯১ হাজার ২০০ টাকা) পরিশোধ করা হয়। এরপরই অর্থছাড়ের প্রক্রিয়া শুরু করে চীন।
ব্যবস্থাপনা ফি’র বিষয়ে ইআরডির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, চীন দুভাবে ঋণ দিয়ে থাকে- সহজ শর্তে এবং কিছুটা কঠিন শর্তে। জি-টু-জি (সরকার-টু-সরকার) ভিত্তিতে যে ঋণ দেয়া হয়, ধরে নেয়া হয় সে ঋণে কোনো লাভ করা হয় না। কিন্তু বায়ার্স ক্রেডিটে যে ঋণ দেয়া হয় সেখানে কিছুটা লাভ করে। যে ঋণে লাভ করা হয় না তার একটি পরিচালন ব্যয় রয়েছে। এছাড়া বায়ার্স ক্রেডিটে যে ঋণ দেয়া হয় তারও একটি পরিচালন ব্যয় রয়েছে। এজন্য সুদের হার যাই থাক ঋণ ব্যবস্থাপনার জন্য চীনা এক্সিম ব্যাংক ব্যবস্থাপনা ফি নিয়ে থাকে। এটি অর্থছাড়ের আগেই পরিশোধ করতে হয়। তা না হলে অর্থছাড় করা হয় না।
সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এ টানেল নির্মাণ প্রকল্প ২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুমোদন পায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২০ সালের জুনের মধ্যে নির্মাণ শেষ হওয়ার কথা। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ২০১১ সালে নিয়োগ করা হয় পরামর্শক। যৌথভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করে চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) ও হংকংয়ের ওভিই অরুপ অ্যান্ড পার্টনারস। নকশাও প্রণয়ন করা হয় একই সঙ্গে। জি-টু-জি ভিত্তিতে চীনের অর্থায়নে টানেলটি নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করে সিসিসিসি। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর) অনুযায়ী, সম্ভাব্যতা যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারির কাজ পাওয়ার সুযোগ নেই। তবে জি-টু-জি ঋণের আওতায় হওয়ায় সিসিসিসিকে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। ২০১৫ সালের জুনে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তি সই হয়। মোট নির্মাণ ব্যয়ের মধ্যে ৭০ কোটি ৫০ লাখ ডলার বা প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা চীন জি-টু-জির আওতায় ঋণ হিসাবে দেয়ার কথা। বাকি টাকা সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে।
নকশা অনুযায়ী, টানেলের শহর প্রান্ত থাকবে পতেঙ্গার নেভাল একাডেমি পয়েন্টে। অপর প্রান্ত থাকবে নদীর পশ্চিম তীরে আনোয়ারার চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার (সিইউএফএল) এলাকায়। পূর্ব প্রান্তে ৫ কিলোমিটার এবং পশ্চিমে এক কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হবে। চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ৫৬৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা এবং চীনা ঋণের ১ হাজার ৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন