বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্যসমুহ নিয়ে ভারতের উদ্বেগ আজ নতুন নয়। সর্বশেষ ভারতীয় সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াতের বক্তব্যে সে উদ্বেগই আবার ফুটে উঠেছে।
ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সেন্টার ফর জয়েন্ট ওয়ারফেয়ার স্টাডিজ ও হেডকোয়ার্টার্স ইন্টিগ্রেটেড ডিফেন্স স্টাফের যৌথ আয়োজনে বুধবার অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বিপিন রাওয়াত অভিযোগ করেন, ভারতের সাথে ছায়াযুদ্ধের অংশ হিসেবে পাকিস্তান পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ থেকে পূর্ব ভারতের রাজ্য আসামে অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে। পাকিস্তানকে এই কাজে সহায়তা করছে চীন। মূলত ভারতের ওই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল রাখতেই এই অনুপ্রবেশ ঘটানো হচ্ছে বলে তিনি মত দেন। খবর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এর।
ভারতীয় এই সেনা প্রধানের বক্তব্যের পর নাখোশ হবার বদলে বিস্মিত হয়েছেন অনেকে। একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার এই বক্তব্যে আসামের চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতির আরও অবনতি ঘটাবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সম্প্রতি বিজেপি নেতৃত্বাধীন আসামের প্রাদেশিক সরকার আসাম পাবলিক ওয়ার্কার্স নামে একটি সংগঠন প্রদেশের ভোটার তালিকা থেকে ৪১ লাখ ‘অবৈধ বাংলাদেশির’ নাম বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়ে মামলার প্রেক্ষিতে ‘বৈধ নাগরিকদের’ একটি তালিকা প্রকাশ করে। ‘ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস’ (এনআরসি) নামক বহুল-আলোচিত এই তালিকায় প্রথম দফায় বাদ পড়েছেন সিংহভাগ মুসলমান। এসব মুসলমান নাগরিকদের আসাম দেখছে অবৈধ বাংলাদেশি হিসাবে। ফলে ক্রমেই এ অঞ্চলে নতুন সংকট দেখা দিয়েছে। আসাম সরকারের এই প্রক্রিয়াকে অনেকে পুর্বের ‘বাঙাল খেদাও’ আন্দোলনের নতুন রূপ বলেও মনে করছেন। ঠিক এমন সময় আসাম নিয়ে ভারতীয় সেনাপ্রধানের বক্তব্য সেই উত্তেজনায় বাড়তি হাওয়া দেবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
বিপিন রাওয়াত দাবি করেন, বাংলাদেশ থেকে সুপরিকল্পিতভাবে এভাবে মুসলিমদের পাঠানোর ফলে আসামে যেখানে বছর কয়েক আগেও মাত্র পাঁচটি জেলায় মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, এখন সে রাজ্যে আট থেকে নটি জেলা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে। নিজের বক্তব্যের সমর্থনে তিনি আসামে মুসলিমদের রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত মাওলানা বদরুদ্দিন আজমল নেতৃত্বাধীন অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এআইইউডিএফ)-এর জনপ্রিয়তাকে ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন, “দলটি বিজেপির থেকেও দ্রুত প্রভাব বিস্তার করছে।”
ভারতে বর্তমান ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির সাথে মুসলিমদের রাজনৈতিক দলটির এমন তুলনার মধ্যে ভারতের ইসলামোফোবিয়া তথা মুসলিমভীতিরই বহি:প্রকাশ ঘটছে। সেনাপ্রধানের এমন কথা আসামে কেবল সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকেই উসকে দিতে পারে। এতে ‘বাঙাল খেদাও’ আন্দোলন পালে হাওয়া পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সেনা প্রধানের এমন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ক্ষোভ জানিয়ে মাওলানা বদরুদ্দীন আজমল টুইটারে বলেন, “জেনারেল রাওয়াত রাজনৈতিক মন্তব্য করেছেন। এটা খুব আশ্চর্যজনক! আমরা যদি বিজেপির থেকে দ্রুত হারে বেড়ে উঠি তাতে তার চিন্তা কোথায়। বড় দলগুলি ব্যর্থ হয় বলেই তো এআইইউডিএফ এবং আপ এর মতো দলগুলি তৈরি হয়।”
M Badruddin Ajmal
@BadruddinAjmal
Gen Bipin Rawat has made a political statement, shocking! Why is it a concern for the Army Chief that a political party, based on democratic & secular values, is rising faster than BJP? Alternative parties like AIUDF, AAP have grown because of the misgovernance of big parties.
1
১১:১৬ AM - ২২ ফেব, ২০১৮
১,৩৩৮
৮৬৮ জন লোক এই সম্পর্কে কথা বলছেন
টুইটার বিজ্ঞাপন তথ্য ও গোপনীয়তা
আসামের রাজনীতিতে মাওলানা আজমলের দল এআইইউডিএফ দিন দিন বড় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ফলে তারা এ অঞ্চলের মুসলিমদের মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করছে। আসামে মুসলিমদের নাগরিক তালিকা থেকে বাদ দেয়ার ঘটনায়ও তারা আন্দোলন করেছিলো।
কে এই মাওলানা বদরুদ্দীন আজমল
বদরুদ্দীন আজমলের জন্ম ১৯৫০ সালে আসামে। মাধ্যমিক পর্যন্ত ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করার পর ধর্মপ্রাণ ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে বদরুদ্দিন উত্তর প্রদেশে ইসলামি শিক্ষার বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসায় পড়াশোনা শুরু করেন। মাস্টার্স করেন ইসলামিক থিওরির ওপর। ১৯৮২ সালে মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারে গড়ে তোলেন এনজিও মারকাজুল মাআরিফ। পরে সেই সংগঠনই নাম পাল্টে হয় আজমল ফাউন্ডেশন। তিনি ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের উপদেষ্টা বোর্ডের একজন সদস্য। ২০০২ সালে তিনি হুসাইন আহমদ মাদানির জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের আসাম রাজ্য সভাপতি নির্বাচিত হন। তারও কিছুদিন পর ২০০৫ সালে গড়ে তোলেন আসামে মুসলিমদের রাজনৈতিক দল অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউডিএফ)। রাজনীতির পাশাপাশি বস্ত্র, রিয়েল এস্টেট, চামড়া, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুগন্ধির ব্যবসা রয়েছে আজমলের।
রাজনীতিতে আসার পরই আজমল ২০০৬ সালে আসাম বিধান সভায় দক্ষিণ সালামারা ও যমুনামুখ আসন থেকে একত্রে দুটি আসনে জয়ী হন।
এবং ২০১১ সালের নির্বাচনে তিনি ১৮টি আসন নিয়ে আসামের বৃহত্তম বিরোধী দলীয় নেতা হন। লোকসভায় ধুবরি আসন থেকে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিগত নির্বাচনেও আজমলের দল থেকে ভারতের পার্লামেন্টে তিনজন এমপি আছেন, আসামের বিধানসভাতেও ওই দল থেকে নির্বাচিত মোট ১৩জন বিধায়ক আছেন। মাওলানা বদরুদ্দীন আজমল ২০১৫-১৬ সালে জর্ডানের রয়্যাল ইসলামিক স্টাটিজিক স্টাডিজ সেন্টারের প্রকাশিত বিশ্বের ৫০০ জন প্রভাবশালী মুসলমানের তালিকাভুক্ত ছিলেন।
ভারতীয় সেনাপ্রধানের বক্তব্য এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যত রাজনীতি
গত মঙ্গলবার সরকারি বাসভবনে ভারতীয় সাংবাদিকদের এক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে ভারতের উদ্বেগের কিছু নেই। তিনি বলেন, এ সম্পর্ক শুধুই দুই দেশের উন্নয়নের জন্য। তার ঠিক একদিন পরেই বিপিন রাওয়াতের পাকিস্তানের সহযোগিতায় বাংলাদেশিদের আসামে ‘অনুপ্রবেশের’ অভিযোগ বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিচ্ছে। ভারত যে এখন বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না সেটা বিপিনের এই বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ফলে সরাসরিই এরকম অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। যদিও আসামে বাঙালিদের সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ সরকার কখনোই উচ্চবাচ্চ্য করেনি।
তবে ঢাকায় ভারতীয় সাংবাদিকদের সাথে এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “আমি ভারতীয় সাংবাদিক বন্ধুদের বলতে চাই, এ কথাটা আপনাদের মনে রাখতে হবে… বাংলাদেশে আমাদের বিকল্প যারা তারা পাকিস্তানের বন্ধু, যারা আপনাদের সেভেন সিস্টার্সের যাবতীয় গ্যাঞ্জামের হোতা, যারা পাকিস্তানের আইএসআইয়ের সঙ্গে কাজ করে। একই চক্রান্তের জালে তারা আবদ্ধ।” তিনি আরো বলেন, “আরেকটা বিষয়ে অনুরোধ করব, প্লিজ আমাদের একটু সাহায্য করুন। পর পর তিনটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমরা ফেইস করেছি।”
এতে ভারত প্রশ্নে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নিয়েও প্রশ্ন উঠছে জনমনে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বন্ধু রাষ্ট্র বলে আস্বস্ত করা হলেও ভারত বাংলাদেশকে তেমন দৃষ্টিতে দেখছে না। ভারত বাংলাদেশকে তার শত্রু রাষ্ট্র চীন এবং পাকিস্তানের সাথেই মিলিয়ে দেখছে। সেক্ষেত্রে ভারত নীতিতে বাংলাদেশের ভবিষ্যত অবস্থান পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তাও দেখছেন অনেকে। এ অবস্থায় ভারত নিয়ে তথাকথিত ‘বন্ধুত্ব’ কিংবা ঢালাওভাবে ‘ভারত বিরোধিতা’ উভয় প্রবণতা থেকেই বেরিয়ে নতুন স্বকীয় পররাষ্ট্রনীতি তৈরির বিষয়েও বাংলাদেশ মনোযোগ দেবে এমনটাই প্রত্যাশা সবার।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন