কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর প্রতি ভারত কোনো ধরনের রাখঢাক না করেই অসৌজন্যতা প্রদর্শন করছে।
বিশ্বের সম্মানিত অতিথিদের স্বাগত জানাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিয়মিতভাবেই বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকেন। কোনো বিশ্বনেতা ভারতের মাটিতে পা রাখার সাথে সাথেই মোদির ফটো তোলার হিড়িক পড়ে যায়। বিশ্বনেতাদের জন্য মোদির বিখ্যাত আলিঙ্গন বরাদ্দ থাকার কথা কে ভুলতে পারে?
মোদির কানাডিয়ান প্রতিপক্ষ ট্রুডোও কিন্তু বিষয়টি হজম করে নীরব না থেকে পাল্টা চাল দিতে কম যাচ্ছেন না। ১৭ ফেব্রুয়ারি সপ্তাহব্যাপী সফরে দিল্লি অবতরণ করেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী। বিমান থেকে নেমেই তিনি ভারতীয় কায়দায় নমস্তে জানান। তবে তাকে স্বাগত জানাতে মোদি উপস্থিত ছিলে না। কৃষিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী তাকে স্বাগত জানান। মোদি টুইটারেও টুডোরকে স্বাগত জানাননি, বরং দক্ষিণে রাজ্য নির্বাচনের প্রচারণায় ব্যস্ত ছিলেন।
পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে তাজমহল সফরে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কিংবা জুনিয়র মন্ত্রী নন, জেলা কর্মকর্তারা তাকে সেখানে স্বাগত জানান। তবে ফটোজেনিক ট্রুডো প্রেমের সৌধটিতে তার সফর স্মরণীয় রাখতে সক্ষম হন। মোদি প্রায়ই তার বিদেশী অতিথিদের তার রাজ্য গুজরাটের আহমদাবাদে নিয়ে জান। মহাত্ম্যা গান্ধীর সবরমতী আশ্রয় বা নগরীটি তাদের ঘুরিয়ে দেখান। কিন্তু এবার ট্রুডোকে একা গুজরাতে যেতে হয়েছে। সেখানে তিনি ভারতীয় পোশাক পরে একটি হিন্দু মন্দির সফর করেছেন, গান্ধীর নিবাসে গেছেন।
ট্রুডো মুগ্ধতা সৃষ্টিকারী আক্রমণ দিয়ে ভারতীয়দের বশীভূত করার চেষ্টা করতে থাকলেও কানাডিয়ানদের প্রতি ভারতীয়দের তাচ্ছিল্য যেন শেষ হবার নয়।
ট্রুডোর প্রতি ভারত কেন এত রূঢ়? এর জবাব শিখদের সাথে সম্পর্কিত।
শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য ভারত প্রায়ই কানাডাকে অভিযুক্ত করে থাকে। কানাডার শিখরা ট্রুডোর ভোটিং ব্লক। তাদের খুশি করার জন্য একটি চরমপন্থী গুরুদুয়ারায় খালাসা দিবস অনুষ্ঠানেও তিনি উপস্থিত থেকেছেন। অথচ কানাডার কোনো কোনো গুরুদুয়ারা ভারতীয় কূটনীতিকদের জন্য পর্যন্ত নিষিদ্ধ।
সহিংস খালিস্তান আন্দোলন ১৯৮০-এর দশকে পাঞ্জাবে ব্যাপক ঝড় তুলেছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বড় ধরনের অভিযান চালিয়ে স্বর্ণমন্দিরকে জঙ্গিমুক্ত করতে হয়েছিল। কিন্তু এরপর ১৯৮৪ সালে শিখ দেহরক্ষীদের হাতে নিহত হন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। এরপর দিল্লি ও আরো কয়েকটি স্থানে শিখবিরোধী দাঙ্গায় কয়েক হাজার শিখ নিহত হয়। পরের বছর কানাডা থেকে মুম্বাইগামী এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমান উড়িয়ে দেয় খালিস্তান জঙ্গিরা।
শিখদের সংখ্যা আড়াই লাখের কিছু বেশি। সবচেয়ে বৃহত্তম জাতিগত গ্রুপের মধ্যে রয়েছে ভারতীয় বংশোদ্ভূত কানাডিয়ানরা। ট্রুডোর মন্ত্রিসভায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত চার মন্ত্রীর সবাই শিখ। মোদির চেয়েও তার মন্ত্রিসভায় শিখদের সংখ্যা বেশি বলে গর্ব করে থাকেন ট্রুডো। শিখ প্রাধান্যপূর্ণ পাঞ্জাব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী (তিনি নিজেও শিখ) অমরিন্দর সিং প্রকাশ্যেই অভিযোগ করেছেন, ট্রুডোর মন্ত্রীরা পাঞ্জাব রাজ্যকে ভাগ করে আলাদা খালিস্তান গঠন করতে ইচ্ছুক কানাডার শিখ চরমপন্থীদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন। গত বছর অমরিন্দর সিং ট্রুডোর প্রতিরক্ষামন্ত্রী হরাজিত সিং সজ্জনের সাথে সাক্ষাত করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। চার শিখ মন্ত্রীর সবাই সম্প্রতি ভররত সফর করেছেন। ট্রুডো যাতে তাদের সাথে করে নিয়ে না আসেন, সেটাই চাইছিলো ভারত। কিন্তু ট্রুডোর এই সফরটির মূল বিষয় হলো কানাডায় শিখ ভোট-সম্পর্কিত।
খালিস্তান ইস্যু নিয়ে ভারত ও কানাডার মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করার প্রেক্ষাপটে নয়া দিল্লি ট্রুডোর কাছ থেকে ‘ভারতের ঐক্য ও অখণ্ডতার’ প্রতি প্রকাশ্য বক্তব্য চাইছে। সোমবার এ প্রসঙ্গে ট্রুডো বলেন, কানাডা ‘একটি ঐক্যবদ্ধ ভারত’কে সমর্থন দেয়। একইসাথে ট্রুডো এই বলে হইচই সৃষ্টি করেন যে ভারত একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ ও বহুত্ববাদী দেশ। কানাডার শিখরা এই বার্তার অর্থ বুঝতে পেরেছে।
কানাডার অবস্থান হলো এই যে সে শিখ নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করতে পারে না। কিন্তু ভারত চায়, কানাডা প্রকাশ্যে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখুক। দুই পক্ষ ট্রুডোর নয়া দিল্লি আসার আগেই উত্তেজনা নিরসন করতে না পারায় মোদির তাচ্ছিল্যের লক্ষ্য হলো কানাডার লোকদের প্রতি চাপ বৃদ্ধি করা। ট্রুডোর সফরের শেষ ভাগে তার সাথে সাক্ষাত করবেন মোদি। তখন হবে আপসরফার সময়।
ট্রুডো ভারত দেখে চলেছেন। তবে পর্দার অন্তরালে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। ট্রুডো তার শিখ সহকর্মীদের প্রতি অমরিন্দর সিংয়ের মন্তব্য বিবেচনায় নিয়ে তার সাথে বৈঠকের কোনো পরিকল্পনা করেননি। তবে তিনি এখন নমনীয় হয়েছেন, তারা বৈঠক করবেন শিগগিরই।
বাস্তবতা হলো, ট্রুডোর সফরের লক্ষ্য ছিল বৈরিতার অবসান ঘটানো। ভারতের আশঙ্কা, কানাডার প্রশ্রয়ে আবার ভারতীয় পাঞ্জাবে শিখ চরমপন্থীরা উত্তেজনার সৃষ্টি করবে।
ট্রুডোকে মাঝামাঝি পথ বেছে নিতে হবে যাতে ভারতে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদ নতুন করে ছড়িয়ে না পড়ে, আবার কানাডায় তার ভোট ব্যাংকও সংহত থাকে। তিনি একইসাথে দুটিই পারবেন না। ভারত যদি কুইবেকের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দেওয়া শুরু করে, তবে ভারতের সাথে যে কানাডা সুসম্পর্ক রাখবে না তা সহজেই বোঝা যায়। শাঁখের করাত।
লেখক : নয়া দিল্লিভিত্তিক সাংবাদিক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন