আগামী কয়েক সপ্তাহজুড়ে আমি ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চের ঘটনাবলি পর্যালোচনা করে দেখতে চাই। ফিরে যেতে চাই সেই দুর্ভাগ্যজনক দিনগুলোয়, যা বুশ প্রশাসনকে ইরাকে সর্বনাশা সামরিক হস্তক্ষেপ এবং দেশটিকে দখলে নেয়ার দিকে চালিত করেছিল। যেসব মিথ্যা তখন বলা হয়েছিল, যেসব উন্মত্ততা তৈরি করা হয়েছিল, বিতর্ক ধামাচাপা দিতে তর্জন-গর্জনের যেসব কূটকৌশল নেয়া হয়েছিল এবং যুদ্ধের বিরোধিতায় যেসব গণসংহতি ও আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল- আমি খুব ভালোভাবেই তার সব স্মরণ করি।
শেষ পর্যন্ত আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ দেশটির জনগণের মতামত এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস বাকের ও সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রেন্ট স্কোক্রফটের মতো জ্যেষ্ঠ রিপাবলিকান সিনেটরদের প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ উপেক্ষা করেছিলেন ও ইরাকে সামরিক অভিযান চালিয়েছিলেন। এ যুদ্ধ সাম্প্রতিক ইতিহাসে যুক্তরাষ্ট্রকে সবচেয়ে বেশি সর্বনাশা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার দিকে নিয়ে গেছে। ইরাক যুদ্ধের ছিল এমন এক প্রভাব, যা সময়কে অতিক্রম করে প্রতিনিয়ত বেড়ে উঠেছে। এ সর্বনাশা বিপর্যয়ের বিশালতা কেবল পরিমাপ করা যায় বহুসংখ্যক জীবন, প্রচুর অর্থ, সামর্থ্য ও প্রেস্টিজ হারানোর মধ্য দিয়ে।
২০১১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের লড়াইকারী বাহিনীগুলোকে প্রত্যাহার করে নেয়া পর্যন্ত ইরাক যুদ্ধ ৪ হাজার ৫০০ মার্কিন সেনার জীবন কেড়ে নিয়েছে এবং নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছেন দেড় লাখের বেশি বেসামরিক ইরাকি নাগরিক। এমনকি ইরাকে যুদ্ধ করা ৬ লাখের বেশি মার্কিন অভিজ্ঞ যোদ্ধা এখন প্রতিবন্ধী হিসেবে নিবন্ধিত। যা হোক, যুদ্ধটির প্রভাব ভালোভাবে বুঝতে হলে আমাদের অবশ্যই ওই তরুণ-তরুণীদের সংখ্যা যোগ করতে হবে যাদের একাধিকবার ইরাক ও আফগানিস্তানে যেতে হয়েছে (এ দুটি যুদ্ধে সামরিক বাহিনীর ৪ লাখের বেশি সদস্যকে দায়িত্ব পালন করার জন্য তিন বা তারও বেশি বার যুদ্ধে যেতে হয়েছে) এবং যারা পিটিএসডি- পোস্ট-ট্রমাটিক শক ডিজঅর্ডারে ভুগে ফিরে এসেছেন। প্রায় ১০ শতাংশ অভিজ্ঞ যোদ্ধা পিটিএসডিতে ভুগছে।
এ যোদ্ধাদের বেশিরভাগই গৃহহীন ও মাদকাসক্তের তালিকাভুক্ত হয়েছেন অথবা তারা আত্মহত্যা করেছেন। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি রাতে গড়ে ৪ হাজারের বেশি যোদ্ধা গৃহহীন হয়েছে। অন্যদিকে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পিটিএসডি-আক্রান্ত যোদ্ধাদের মধ্যে প্রতিদিন ২২ জন আত্মহত্যা করে। এর অর্থ হচ্ছে ইরাক ও আফগান যুদ্ধে অংশ নেয়া দক্ষ সেনারা নানা বিকলাঙ্গতার কারণে প্রতিবছর যে হারে আত্মহত্যা করছে, তা দুটি লড়াইয়ে যুদ্ধের মাঠে যৌথভাবে মৃত্যুর চেয়েও বেশি।
ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের সরাসরি ব্যয় প্রায় দুই ট্রিলিয়ন ডলার বলে অনুমান করা হয়েছে। এর বাইরে যুদ্ধ দুটিতে অংশ নেয়া সেনাদের চিকিৎসাসেবা ও বিকলাঙ্গ ভাতা পরিশোধ করার জন্য আরও কয়েক ট্রিলিয়ন যোগ হচ্ছে। ফল হিসেবে অবিজয়যোগ্য দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ দুটি মার্কিন সামরিক বাহিনীকে মাটিতে নামিয়ে এনেছে এবং ক্লান্ত করে দিয়েছে। পরিপূর্ণভাবে বিদ্রোহীদের পরাজিত করা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনে তাদের অক্ষমতার প্রমাণও দিয়েছে ইরাক ও আফগান যুদ্ধ। এমনকি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও ব্যয়বহুল সামরিক বাহিনীর সীমাবদ্ধতা এবং মার্কিন বাহিনীর অনৈতিকতার প্রমাণও হয়ে পড়েছে এ দুটি যুদ্ধ।
একই সঙ্গে বুশ প্রশাসনের বেপরোয়া ও উদ্ধত একতরফা (তুমি হয় আমাদের সঙ্গে, না হয় বিপক্ষে) মিত্রদের মাঝে বিরোধ তৈরি করেছে এবং বিশ্বব্যাপী জনমতকে অবজ্ঞা করেছে। বুশ প্রশাসনের বিদায়ের পর পছন্দের রেটিংয়ে বিশ্বজুড়ে দেশটির অবস্থান ছিল একেবারে তলানিতে। যুদ্ধের সময় প্রকাশিত হয়ে পড়া যুক্তরাষ্ট্রের ঘৃণ্য আচরণ (আবু গারিব কারাগার, নির্যাতন, গুয়ান্তানামো বে কারাগার ইত্যাদি) আল-কায়দাকে চরমপন্থায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার জ্বালানি সরবরাহ করেছে। এটির জš§ আফগানিস্তানে হলেও গ্র“পটির আমেরিকাবিদ্বেষী ঘৃণা অনেক দেশে স্থানান্তরিত হয়েছে এবং ছড়িয়ে পড়েছে। এ ছাড়া আমেরিকার সামরিক বাহিনীর দুর্বল ও ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়াটা একসময় নিজেদের প্রভাব বিস্তারের জন্য সাহসী থাকা দেশটির আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ও বহুমুখী উত্থানের অক্ষমতার অভূতপূর্ব পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
অবশ্যই, এভাবে এবং এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। নব্যরক্ষণশীল আমেরিকার জন্য ‘একটি নতুন আমেরিকান শতাব্দীর প্রকল্প’, নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় আমেরিকার প্রভুত্ব রক্ষায় ইরাক যুদ্ধের মতো একটি যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা ছিল বলে যেভাবে স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেভাবে উৎসাহী হয়েছিলেন যুদ্ধ দুটির প্রধান নায়করা, তেমনটি কিন্তু হয়নি। তারা ভেবেছিলেন যে, স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির পর যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শক্তিশালী হওয়ার দরকার ছিল, যাতে করে তৈরি হতে যাওয়া যে কোনো সম্ভাব্য প্রতিযোগীকে বুঝিয়ে বাগে আনা যায়। তারা উপলব্ধি করেছিলেন, অভাবিত এক সামরিক শক্তির প্রদর্শনীর পর বহু মেরুকরণের বিশ্বের বিপদ ঠেকানো যাবে এবং একবিংশ শতাব্দী হবে আমেরিকান শতাব্দী।
যেভাবে তারা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, বুশ প্রশাসন ও এর নব্যরক্ষণশীল অনুগতরা মিথ্যার একটি তীব্র প্রপাগান্ডায় জড়িয়ে পড়েছিলেন যাতে করে সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে সমর্থন জোগানো যায়। যখন আমি বলছি তারা মিথ্যা বলেছে, তখন কিন্তু আমি সাদ্দামের ‘পরমাণু প্রকল্প’ সম্পর্কে তাদের মনগড়া বিষয়টির কথা বলছি না। এমনকি ইরাকি প্রশাসনকে ওই অঞ্চলের সন্ত্রাসের মূল পৃষ্ঠপোষক হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য তাদের জালিয়াতি প্রচেষ্টার কথাও বলছি না- সামরিক হস্তক্ষেপের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ের জন্য জাতিসংঘে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল যে ব্যর্থ সংক্ষিপ্ত প্রেজেন্টেশন তুলে ধরেছিলেন, তার কথাও বলছি না আমি। হ্যাঁ, সবচেয়ে মারাত্মক যে মিথ্যাগুলো তারা বলেছিলেন, তা ছিল সহজ, সস্তা ও মহিমান্বিতভাবে আমেরিকানদের কাছে যুদ্ধ বিক্রির চেষ্টা।
কংগ্রেসের সাক্ষ্য ও প্রেস ব্রিফিংগুলোয় প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা যুক্তি দেখিয়েছিলেন, ইরাক যুদ্ধ করতে সর্বোচ্চ ৬০ হাজার থেকে ৯০ হাজার পর্যন্ত সেনা লাগতে পারে। এমনকি পেন্টাগনের একজন জেনারেল যখন কংগ্রেস শুনানিতে বলেছিলেন যুদ্ধটিতে সফল হতে ও দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে ৩ লাখ ৫০ হাজার সেনা লাগবে, তখন তাকে বহিষ্কার পর্যন্ত করা হয়েছিল। যুদ্ধ প্রশাসনের মুখপাত্ররা বলেছিলেন কয়েক সপ্তাহের মধ্যে শেষ হবে ইরাক যুদ্ধ। মার্কিন সেনারা মুক্তিদাতা হিসেবে বরিত হবেন। এ ছাড়া বলা হয়, এ যুদ্ধে ইরাকের তেলক্ষেত্র আবার উৎপাদনে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ১০০ থেকে ২০০ কোটি ডলার ব্যয় হবে এবং বাকিটা তেল থেকে তুলে নেয়া যাবে। এতসব কল্পনাপ্রসূত মিথ্যাও যখন যথেষ্ট হচ্ছিল না, তখন তারা নিজ দেশের জনগণকে বারবার বলেছিলেন ধূলি সরে গেলে (সাদ্দাম প্রশাসনকে সরিয়ে দিলে) ইরাক হবে একটি ‘উদারপন্থী গণতান্ত্রিক’ দেশ এবং এটি ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি বাতিঘর’ হিসেবে কাজ করবে।
সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে বক্তব্যগুলোয় বুশ আরও বাড়িয়ে বলেছেন যে, যুদ্ধ ‘মানুষকে মুক্ত করবে’ এবং তার মূল উদ্দেশ্য ছিল ‘স্রষ্টার দেয়া স্বাধীনতার পুরস্কার’ ইরাকি জনগণের হাতে পৌঁছে দেয়া। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমরা ইরাকে যাব এটি নিশ্চিত করতে যে, সেখানকার ক্ষুধার্তরা খেয়েছে, স্বাস্থ্যসেবা যার প্রয়োজন তিনি সেটা পেয়েছেন এবং যেসব তরুণের শিক্ষা দরকার, তারা সেটা পেরেছে।’
এতকিছুর পর বুশ কেবল তার ডানপন্থী সমর্থক ঘাঁটির সদস্যদের এবং নব্যরক্ষণশীলদের রাজি করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এদের উভয় পক্ষকে শিশুসুলভ ও কল্পনাপ্রসূতভাবে বোঝানো হয়েছিল, এমনকি তাদের সঙ্গে শেয়ার করা হয়েছিল যে, একটি শক্তিশালী ও নৈতিক মনোবলসম্পন্ন বাহিনী শয়তানকে পরাজিত করবে এবং ‘নতুন একটি বিশ্ব ব্যবস্থার’ দিকে নিয়ে যাবে আমাদের।
এটি কিন্তু হয়নি। আজ ১৫ বছর পর আমরা, বিশেষত ইরাক এবং ওই অঞ্চলের জনগণ সর্বনাশা বিপর্যয়টির পার্শ^প্রতিক্রিয়া নিয়ে বাস করছি, যা নব্যরক্ষণশীলরা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। ফল হিসেবে এসেছে চূর্ণবিচূর্ণ ইরাক, সাহসী ইরান, একটি দুর্বল, যুদ্ধপরিশ্রান্ত ও ভীত আমেরিকা এবং এমন একটি মধ্যপ্রাচ্য যেখানে বহু আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তি অনেক রক্তাক্ত সংঘর্ষে জড়িয়ে আছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন