কদরুদ্দীন শিশির
মঙ্গলবার থেকে বাংলাদেশের অনলাইন জগতে একটি খবর ভাইরাল হয়েছে; তা হলো ‘সৌদি বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব ইসরাইলকে দেয়া হয়েছে।’
দৈনিক যুগান্তরের অনলাইনে ২০ মার্চ প্রকাশিত “সৌদি বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব দেয়া হলো ইসরাইলকে” শিরোনামের প্রতিবেদনটি হাজারে হাজার শেয়ার হচ্ছে। যুগান্তর মূলত ‘পার্স টুডে’ (সাবেক রেডিও তেহরান) থেকে খবরটি নিয়েছে, এবং তা উল্লেখও করেছে।
যুগান্তরের প্রতিবেদনটি হুবহু দেখে নেয়া যাক--
//
সৌদি রাজার নতুন এক ফরমান অনুযায়ী সে দেশের বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ইসরাইলের হাতে। ইসরাইলের জিফোরএস কোম্পানির হাতে নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে। খবর রেডিও তেহরানের।
কাতারের দৈনিক আশ্ শারকুল আওসাত জানিয়েছে, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত অন্য যুবরাজরা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য সৌদি রাজা এ পদক্ষেপ নিয়ে থাকতে পারেন।
প্রকৃতপক্ষে সৌদি আরবে ক্ষমতার যে দ্বন্দ্ব চলছে তার কারণে সৌদি রাজা ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পদক্ষেপ নিয়েছেন। এমনকি সৌদি ও ইসরাইলি কর্মকর্তারা গোপনে সাক্ষাতে মিলিত হচ্ছেন।
তবে এর আগে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে কোনো আরব সরকারের নিরাপত্তা বাড়েনি বরং ওই সরকারের পতন ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের উদাহরণ হয়ে আছে।
//
এবার পার্স টুডে’র প্রতিদেনের শিরোনামটি দেখা যাক, “সৌদি বিমান বন্দরগুলোর নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হল মুসলমানদের শত্রু ইসরাইলকে”।
পার্সের রিপোর্টটি অনেক দীর্ঘ; যুগান্তর সেখান থেকে একটা অংশ নিয়েছে।
সাবেক রেডিও তেহরান এবং বর্তমান পার্স টুডে’র সংবাদ পরিবেশন সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা জানেন সংবাদমাধ্যমটি তাদের প্রতিবেদনে তথ্যের চেয়ে ‘ভাষা’কে বেশি গুরুত্ব দেয়। এবং ঐতিহ্যগতভাবে সৌদি আরব ও ইসরাইল সংক্রান্ত সংবাদের ভাষা সব সময়ই বিদ্বেষমূলক হয়ে থাকে। যেমনটি উপরের শিরোনামে স্পষ্ট (‘মুসলমানদের শত্রু ইসরাইলকে’ শব্দের ব্যবহার থেকে।) প্রতিবেদনের ভেতরেও প্যারায় প্যারায় বিষটি পরিলক্ষিত হয়।
এবার দেখা যাক পার্স টুডে’র সংবাদের সূত্র কী? প্রতিবেদনের শুরুটা হচ্ছে এভাবে- “সৌদি রাজার নতুন এক ফরমান অনুযায়ী সেদেশের বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে দখলদার ইহুদিবাদী ইসরাইলের হাতে। ইসরাইলের জিফোরএস কোম্পানির হাতে নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে।”
এরপর শেষের দিকে একটি প্যারায় লেখা হয়েছে, “এরই আলোকে সৌদি আরবের বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব ইসরাইলের হাতে ছেড়ে দেয়ার বিষয়টি মূল্যায়ন করতে হবে। কাতারের দৈনিক আশ্ শারকুল আওসাত এ ব্যাপারে লিখেছে, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত অন্য যুবরাজরা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য সৌদি রাজা এ পদক্ষেপ নিয়ে থাকতে পারেন।”
সূত্র হিসেবে “কাতারের দৈনিক আশ্ শারকুল আওসাত” এর কথা বলা হয়েছে। কাছাকাছি নামে দু’টি পত্রিকা অনলাইনে আছে। এর একটি সৌদি ভিত্তিক এবং সৌদি সরকারপন্থি Asharq Al-Awsat (aawsat.com)। আরেকটি কাতার ভিত্তিক www.al-sharq.com. (কাতার ভিত্তি ‘আশ্ শারকুল আওসাত’ বলে কোনো পত্রিকা অনলাইনে খুঁজে পাওয়া যায়নি।)
www.al-sharq.com পত্রিকাটির সাথে পার্স টুডের দেয়া নাম পুরোপুরি মিলছে না। তবে এই পত্রিকায় এ সংক্রান্ত রিপোর্ট পাওয়া গেছে। ১৯ মার্চ প্রকাশিত “সৌদি বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ইসরাইলের হাতে” শিরোনামের রিপোর্টে বলা হয়েছে--
“সৌদি রাজকীয় আদালত এক ডিক্রি জারি করেছেন যে, বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তা বিদেশি কোনো কোম্পানিকে দেয়া হবে। এক্ষেত্রে ডিক্রিতে জিফোরএস এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, বিমানবন্দরে বর্তমানে নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদেরকে সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। দেশব্যাপী ধরপাকড়ের কারণে সেনাবাহিনীর প্রতি সরকারের সন্দেহ বাড়তে থাকে এবং সৌদি নেতৃত্বের প্রতি তাদের অানুগত্য নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়। এদিকে সম্প্রতি ইসরাইল ও ভারত একটি চুক্তি করেছে যে, তারা সপ্তাহে পরস্পরের দেশে তিনটি করে ফ্লাইট চালু করবে এবং এজন্য সৌদি আরবের আকাশসীমা ব্যবহার করবে। এজন্য তারা আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সৌদির ওপর চাপ প্রয়োগ করে।” (রিপোর্টের মূল অংশের অনুবাদ: মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম, কলেজ শিক্ষক, সাবেক শিক্ষার্থী শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়)।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই এখানে দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে কি এটা বলা যায়- “সৌদি বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হল মুসলমানদের শত্রু ইসরাইলকে”? (পার্স টুডের শিরোনাম)। বা “সৌদি বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ইসরাইলের হাতে”? (আল শারক এর শিরোনাম)।
পার্স টুডের খবরের মূল তথ্যটি হচ্ছে “ইসরাইলের জিফোরএস কোম্পানির হাতে বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে।” এই তথ্যের আলোকেই বলা হয়েছে “সৌদি বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হল মুসলমানদের শত্রু ইসরাইলকে”।
বাস্তবে জিফোরএস ইসরাইলি কোনো কোম্পানি নয়, এটি লন্ডন ভিত্তিক ব্রিটিশ-ড্যানিশ কোম্পানি। তবে অতীতে ইসরাইলের পুলিশ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়া, বিভিন্ন কারাগারের ব্যবস্থাপনা ও আল-আক্বসায় ফিলিস্তিনিদের ওপর নজরদারির জন্য ইসরাইল সরকারের দ্বারা নিয়োজিত ছিল। অবশ্য এসব কাজ যে শুধু ইসরাইলের হয়ে করেছে প্রতিষ্ঠানটি তা নয়, এমন ব্যবসা তারা অন্যান্য অনেক দেশের সরকারের সাথে করে থাকে (১২৫টি দেশে কার্যক্রম)।
তবে ইসরাইলি সরকারকে এসব সহায়তা দেয়ার কারণে বিডিএস মুভমেন্ট কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ব্যাপক বয়কট প্রচারণা চালায়। এতে কয়েকটি দেশের সরকার জিফোরএস-এর সেবা নেয়া বন্ধ করে দেয় (সূত্র: টাইমস অব ইসরায়েল)। চাপের মুখে এক পর্যায়ে ২০১৬ সালের মার্চ মাসে ইসরাইলে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেয় কোম্পানিটি। যদিও কোম্পানির পক্ষ থেকে গুটিয়ে নেয়ার কারণ হিসেবে কোনো চাপের কথা অস্বীকার করা হয়।
ইসরাইলি সরকারের সাথে অতীতে কাজ করলেও জিফোরএস ইসরাইলি কোম্পানি নয়। এবং এটির সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার বিষয়টিকে কোনোভাবেই ‘ইসরাইলের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়া’ বলার সুযোগ নেই।
আবার জিফোরএস সৌদি আরবে এই প্রথম কার্যক্রম পরিচালনার ভার পাচ্ছে না। বেশ আগে থেকেই সৌদির ‘আলমাজাল’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে ‘আলমাজাল জিফোরএস’ নামে। সরকারি/বেসরকারি পর্যায়ে নানা সেবা দিচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান। জিফোরএস- এর সৌদি আরব শাখার এই ওয়েবসাইটে গেলেই বিস্তারিত দেখা যাবে- www.g4s.com.sa/en
এবং বহু আগে থেকে সৌদি আরবের সব বিমানবন্দরেও নানা ধরনের সেবা দিচ্ছে ‘আলমাজাল জিফোরএস’। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে ছবিও তথ্য উল্লেখ করা আছে--
আল শারক-এর উপরিউক্ত রিপোর্ট সঠিক হলে জিফোরএস বর্তমানে অন্যান্য সেবা দেয়ার পাশাপাশি নতুন করে ‘নিরাপত্তা’ সেবায় যুক্ত হচ্ছে মাত্র। তবে মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক প্রভাবশালী এবং অপেক্ষাকৃত বেশি বিশ্বাসযোগ্য অন্যান্য যেসব সংবাদমাধ্যম (যেমন কাতারি আল-জাজিরা, মিডল ইস্ট আই, নিউ এরাব) সৌদি আরবের প্রতি আনুগত্যশীল নয় সেগুলোতে এ ধরনের কোনো রিপোর্ট পাওয়া না যাওয়ায় (২১ মার্চ রাত পর্যন্ত) এ তথ্যটির সত্যতাও নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই।
চরমভাবে সরকার নিয়ন্ত্রিত সৌদি ও ইরানভিত্তিক সংবাদমাধ্যমগুলো নিয়মিতভাবে পরস্পরের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত প্রচারণায় লিপ্ত থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার বর্তমানে কাতার সৌদি আরবের বিপক্ষ ব্লকে অবস্থান করছে। আল জাজিরা ছাড়া কাতার ভিত্তিক অন্য কোনো সংবাদমাধ্যম সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করে বলে শোনা যায় না।
কাতারের একটি অখ্যাত পত্রিকার কোনো প্রামাণ্য দলিল ছাড়া পরিবেশন করা এবং সেখান থেকে ইরানের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পার্স টুডে’তে অতিরঞ্জনের মাধ্যমে প্রচার করা একটি রিপোর্টকে নির্দ্বিধায় মেনে নেয়ার আগে উপরের বিষয়গুলো মাথায় রাখা সচেতন পাঠকের জন্য বাঞ্ছনীয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন