সিরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে তাতে ‘নিখুঁত’ সাফল্যের দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রশংসায় মেতেছে ফ্রান্সও। সেই সঙ্গে সিরিয়া ইস্যুতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপনের জন্য নতুন খসড়া প্রস্তাব তৈরি করেছে পশ্চিমা জোট। অন্যদিকে সিরিয়ায় পশ্চিমাদের সামরিক হামলার নিন্দা জানিয়ে রাশিয়ার উত্থাপিত প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে গেছে। এসবের মধ্যেই সিরিয়ায় রাসায়নিক হামলার ঘটনায় গতকাল রবিবার তদন্ত শুরু করেছে রাসায়নিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ বিষয়ক সংস্থা ওপিসিডাব্লিউ।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ বিদ্রোহী অধ্যুষিত দৌমায় গত ৭ এপ্রিল রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করেছেন, এমন অভিযোগে সিরিয়ায় গত শনিবার ভোররাতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স। সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের কাছে একটি ও হোমস প্রদেশে দুটি স্থাপনা লক্ষ্য করে পৌনে এক ঘণ্টা ধরে এসব হামলা হয়। হামলাকারী পশ্চিমা জোটের দাবি, ওই তিনটি স্থাপনা রাসায়নিক অস্ত্র তৈরির সঙ্গে সম্পর্কিত। সিরিয়ায় হামলা শেষে যৌথ হামলার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল ম্যাখোঁ এবং ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মের মধ্যে ফোনে কথা হয়।
হামলার পর গত শনিবার সকালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যথারীতি টুইট করেন। টুইটবার্তায় তিনি বলেন, ‘গত রাতে নিখুঁতভাবে হামলা সম্পন্ন হয়েছে। এর চেয়ে ভালো ফলাফল হতেই পারে না। অভিযান সুসম্পন্ন!’ কিন্তু ভবিষ্যতে বড় পরিসরে সামরিক হামলা চালাতে চাইলে অবশ্যই ট্রাম্পকে কংগ্রেসের অনুমতি নিতে হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতারা।
এদিকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ টুইট করেন, ‘সমন্বিতভাবে একসঙ্গে কাজ করে আমরা অবশ্যই সিরিয়ায় জনগণের ওপর সরকারের রাসায়নিক অস্ত্র হামলা প্রতিহত করতে পারব।’
পশ্চিমা নেতাদের এসব বক্তব্যের বিপরীতে সিরিয়া জানায়, ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় মাত্র তিনজন নিহত হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম জানায়, যেসব স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা হয়েছে, সেগুলো আগে থেকে খালি করে ফেলা হয়েছিল। সিরিয়ার মিত্র রাশিয়া অবশ্য দাবি করছে, কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
সিরিয়ায় সামরিক হামলা নিয়ে পশ্চিমা নেতাদের টুইটের পর তারা কূটনৈতিক পথ অবলম্বনের কথাও বলেন। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ব্রিটেন একটি খসড়া প্রস্তাব করেছে। এতে সিরিয়ার দৌমায় রাসায়নিক হামলার ব্যাপারে জাতিসংঘের তদন্তের কথা বলা হয়। এছাড়া সিরিয়ায় যুদ্ধবিরতি, অবিলম্বে উন্মুক্তভাবে মানবিক সহায়তা সরবরাহ করা এবং জাতিসংঘের নেতৃত্বে শান্তি আলোচনায় সিরিয়ার অংশগ্রহণের দাবি করা হয়। তবে এ প্রস্তাবের ওপর কখন ভোটাভুটি হবে, সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি সংশ্লিষ্ট কূটনীতিকরা।
পশ্চিমাদের এ প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে গড়ানোর আগে রাশিয়ার এক নিন্দা প্রস্তাব ইতিমধ্যে বাতিল হয়ে গেছে। সিরিয়ায় পশ্চিমা জোটের ‘আগ্রাসনের’ নিন্দা জানিয়ে রাশিয়া গত শনিবার পরিষদে ওই প্রস্তাব তুলেছিল। প্রস্তাবে হামলার নিন্দা জানানোর পাশাপাশি রাশিয়া দাবি করে, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ব্রিটেন কখনোই সিরিয়ায় হামলা করতে পারবে না। এ প্রস্তাবে মাত্র তিন ভোট পায় রাশিয়া, যেখানে প্রয়োজন ছিল ৯ ভোট। রাশিয়ার নিজের ভোটের পাশাপাশি ছিল কেবল চীন ও বলিভিয়ার সমর্থন।
ভোটে রাশিয়ার প্রস্তাব বাতিল হয়ে যাওয়ার পর জাতিসংঘে নিযুক্ত রাশিয়ার দূত ভাসিলি নেবেনজিয়া সিরিয়ায় হামলাকারী পশ্চিমা জোটের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা নিজেদের কেবল আন্তর্জাতিক আইনের ঊর্ধ্বে স্থাপনের চেষ্টা করছেন, তা-ই নয়, আপনারা আন্তর্জাতিক আইনই পাল্টে ফেলার চেষ্টা করছেন।’ ওই জোটের কর্মকাণ্ডকে ‘গুণ্ডামি’ অ্যাখ্যা দেন এ রুশ কূটনীতিক।
অন্যদিকে জাতিংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের দূত নিকি হ্যালি জানান, আন্তর্জাতিক অঙ্গনের চাপ সত্ত্বেও আবার সিরিয়ায় হামলার জন্য প্রস্তুত তার দেশ। তিনি বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আজ (শনিবার) সকালে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, সিরিয়ার সরকার যদি আবার বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করে, তবে যুক্তরাষ্ট্র হামলায় পুরোপুরি প্রস্তুত।’
এদিকে হামলায় কোনো বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির শিকার না হওয়া সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ বলেন, ‘এ আগ্রাসন সিরিয়া ও এর জনগণকে লড়াই চালিয়ে যেতে এবং দেশের প্রত্যেক ইঞ্চিতে সন্ত্রাসবাদকে গুড়িয়ে দিতে আরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তুলবে।’
গতকাল রবিবার ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এসময় পুতিন বলেন, ‘জাতিসংঘ চার্টার ভেঙে যদি এ ধরনের (সিরিয়ায় হামলা) কর্মকাণ্ড ঘটে, সেটার পুনরাবৃত্তি ঘটে, তবে অনিবার্যভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে।’
সিরিয়ায় সামরিক অভিযান নিয়ে বিশ্বশক্তিগুলোর বক্তব্যের মধ্যেই গতকাল থেকে দৌমায় রাসায়নিক অস্ত্র হামলার তদন্ত শুরু করে ওপিসিডব্লিউ। এ সংস্থা কেবল দৌমায় রাসায়নিক অস্ত্র হামলার সত্যতা যাচাই করবে, কোন পক্ষ দায়ী তা নির্ণয় করবে না।
সিরিয়ায় পশ্চিমা জোটের হামলার বিরোধিতা করে চীন বলেছে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘শক্তিমত্তার প্রয়োগের বিরুদ্ধে’ চীনের অবস্থান। দেশটি আন্তর্জাতিক আইন অনসুারে রাজনৈতিক সমাধানের ওপর জোর দিচ্ছে।
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি পশ্চিমা তিন নেতা ট্রাম্প-ম্যাখোঁ-মেকে ‘অপরাধী’ অ্যাখ্যা দিয়েছেন।
সিরিয়া ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের প্রতি জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের আহ্বান, ‘এ বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে সব সদস্য রাষ্ট্রকে আমি সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানাচ্ছি। তারা যেন এমন যেকোনো কাজ এড়িয়ে চলেন, যা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটাতে পারে এবং সিরীয় জনগণের ভোগান্তি আরো বাড়িয়ে দিতে পারে।’
পশ্চিমা জোটের হামলার প্রতি সমর্থন জানিয়ে সৌদি আরব বলেছে, ‘সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের হামলায় সৌদি আরবের পূর্ণ সমর্থন আছে।’
আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ করার অভিযোগ তুলে তুরস্ক বলেছে, ‘দৌমায় হামলার পরিপ্রেক্ষিতে যে অভিযান মানবতার বিবেককে নাড়া দিয়েছে, সে অভিযানকে আমরা স্বাগত জানাই।’ পশ্চিমা হামলায় সমর্থন জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বিশ্বের অন্যতম সামরিক জোট ন্যাটো। অপরদিকে দক্ষিণ আমেরিকার দুই দেশে কিউবা ও ভেনেজুয়েলা এ হামলার নিন্দা জানিয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘যেকোনো সামরিক কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে অবশ্যই সব ধরনের পূর্ব সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে।’
সূত্র : এএফপি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন