ভারতনিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরে আট বছর বয়সী মুসলিম শিশু আসিফা বানুকে অপহরণের পর গণধর্ষণ শেষে পাথর ছুড়ে হত্যার ঘটনাকে দেশটির স্বাধীনতা-পরবর্তী সবচেয়ে বড় অন্ধকার অধ্যায় আখ্যা দিয়েছেন দেশটির সাবেক আমলারা।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে লেখা এক খোলা চিঠিতে এ কথা বলেন দেশটির সাবেক আইএএস এবং আইপিএস কর্মকর্তারা।
চিঠিতে তারা নরেন্দ্র মোদি ও তার দল বিজেপির কড়া সমালোচনা করেছেন। তারা লিখেছেন- আমাদের আশা ভেঙে গেছে প্রধানমন্ত্রী, এ জন্য দায়ী আপনিই।
খোলা চিঠির নির্বাচিত অংশ তুলে ধরা হল-
‘আমরা অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের একটি অংশ। যে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও উদার মূল্যবোধ আমাদের সংবিধানে সুরক্ষিত, তার অবক্ষয় দেখে গত বছরও আমরা একযোগে উদ্বেগ জানিয়েছিলাম। বর্তমান শাসক নিজের কৌশলে ঘৃণা, ভয়, নৃশংসতার যে আবহাওয়া সৃষ্টি করেছে, তার প্রতিবাদে অন্য বিরোধী স্বরগুলোকে একজোট করার উদ্দেশ্যেই আমরা তা করেছিলাম। আমরা তখনও মুখ খুলেছিলাম, এখনও মুখ খুলছি: এমন কিছু নাগরিক হিসেবে, সাংবিধানিক মূল্যবোধ ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দল বা আদর্শের প্রতি যাদের আনুগত্য নেই।
আমরা আশা করেছিলাম, সংবিধানকে রক্ষা করার শপথ নেওয়া একজন হিসেবে আপনি, আপনার নেতৃত্বাধীন সরকার এবং আপনার দল এই উদ্বেগজনক অবক্ষয় দেখে নড়েচড়ে বসবে। এই রোগের সংক্রমণকে রুখে সবাইকে, বিশেষত সমাজের সংখ্যালঘু ও দুর্বল মানুষদের নতুন করে আশ্বাস দিয়ে বলবে যে, তাদের জীবন ও স্বাধীনতার কোনো ভয় নেই। আমাদের সেই আশা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
পরিবর্তে কাঠুয়া ও উন্নাওয়ের ঘটনার অবর্ণনীয় ভয়াবহতা দেখিয়ে দিয়েছে। মানুষের অর্পণ করা ন্যূনতম দায়িত্ব পালনেও সরকার ব্যর্থ হয়েছে। তার ফলে নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে গর্ববোধ করা এক জাতি হিসেবে আমরা ব্যর্থ প্রতিপন্ন হয়েছি। সভ্যতার উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া সহিষ্ণুতা, সহমর্মিতা ও সৌভ্রাতৃত্বকে লালন করা সমাজ হিসেবে ব্যর্থ হয়েছি। হিন্দুদের নাম করে বর্বর আচরণকে প্রশ্রয় দেওয়ায় মানুষ হিসেবেও আমরা ব্যর্থ হয়েছি।
আট বছরের মেয়ের ধর্ষণ ও খুনের হিংস্রতা ও বর্বরতা বুঝিয়ে দিচ্ছে আমরা কতটা নিচে নেমেছি। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে এটিই সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়। এবং আমরা দেখছি- এতে সরকার, নেতারা ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া ক্ষীণ ও নগণ্য। এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে আমরা কোথাও আলো দেখছি না। লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যাচ্ছে। আমাদের লজ্জা আরও বেড়েছে। কারণ যে অনুজ সহকর্মীরা এখনও চাকরিতে রয়েছেন, বিশেষ করে জেলায়, দুর্বলকে রক্ষা করতে যারা আইনত বাধ্য— মনে হচ্ছে তারাও কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী, আমরা চিঠি লিখছি শুধু আমাদের এই সামূহিক লজ্জাবোধকে ব্যক্ত করার জন্য নয়। সভ্যতার মূল্যবোধের মৃত্যু ঘটতে দেখে আমাদের শোক-যন্ত্রণা বা ক্ষোভ জ্ঞাপন করার জন্যও নয়। এই চিঠি আমাদের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। আপনার দল এবং তার অসংখ্য, বহুলাংশে পরিচয়হীন শাখা-প্রশাখা এক বিভাজন ও ঘৃণার কর্মসূচি আমাদের রাজনীতির ব্যাকরণের মধ্যে এবং আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের দৈনন্দিন বয়ানের মধ্যে সন্তর্পণে চারিয়ে দিচ্ছে। আমাদের ক্রোধ সেই কর্মসূচির প্রতি। এ কর্মসূচিই কাঠুয়া আর উন্নাওয়ের মতো ঘটনার সামাজিক অনুমোদন আর বৈধতা তৈরি করে।
কাঠুয়া জায়গাটা জম্মুতে। সেখানে সঙ্ঘ পরিবারের আস্কারায় সংখ্যাগুরুর রণং দেহি ভাব আর আগ্রাসী সংস্কৃতিই সমাজের উগ্র সাম্প্রদায়িক অংশটাকে তাদের বিকৃত মনস্ক কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহস জুগিয়েছে। তারা জানে, প্রতিপত্তিশালীদের বরাভয় তাদের জন্য আছে। হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণ উসকে দিয়ে যারা আখের গুছিয়েছেন, তাদের সমর্থনও মজুদ আছে।
উত্তরপ্রদেশের উন্নাও। সেখানে পিতৃতন্ত্র আর সামন্ততন্ত্রের নিকৃষ্টতম ঘরানার মাফিয়া ডনদের ওপরেই ভোট আর রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য নির্ভর করা হয়। ধর্ষণ, খুন আর তোলাবাজির স্বাধীনতাকেই এই মাফিয়া নিজস্ব ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রকৃষ্ট উপায় বলে মনে করে। কিন্তু এর থেকেও নিন্দার বিষয় হল, রাজ্য সরকারের ভূমিকা। অভিযুক্তদের বদলে ধর্ষিতা এবং তার পরিবারকেই যেভাবে ধাওয়া করা হয়েছে, সেটিই দেখিয়ে দেয়, সরকারের আচরণ কোনো বিকৃতিতে পৌঁছেছে। হাইকোর্ট বাধ্য করার পর যেভাবে অবশেষে উত্তরপ্রদেশ সরকার নড়ে বসল, তাতে তার ভণ্ডামি আর দায়সারা মনোভাবই পরিস্ফুট।
প্রধানমন্ত্রী, দুই জায়গাতেই আপনার দল ক্ষমতায়। দলের ওপরে আপনার ও দলীয় সভাপতির নিয়ন্ত্রণের কথা মাথায় রাখলে এই আতঙ্কের পরিবেশের জন্য আপনাকেই সবচেয়ে বেশি দায়ী করতে হয়। কিন্তু দায় স্বীকার করার বদলে কাল পর্যন্ত আপনি চুপ ছিলেন। কিন্তু দেশ-বিদেশে নিন্দার ঝড় এমন পর্যায়ে উঠল যে আপনি আর বিষয়টিকে অবহেলা করতে পারলেন না।
ঘটনার নিন্দা করলেও যে সাম্প্রদায়িক মানসিকতার ফলে এমন ঘটনা ঘটে, তার সমালোচনা আপনি করেননি। যে সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিবেশে এমন সাম্প্রদায়িক ঘৃণা জন্ম নেয়, তা বদলানোর মতো দৃঢ়তাও দেখাননি। বিলম্বিত দুঃখপ্রকাশ ও সুবিচারের প্রতিশ্রুতি আমরা অনেক শুনেছি। সঙ্ঘ পরিবারের আশ্রিত বিভিন্ন শক্তি এখনও সাম্প্রদায়িকতার পরিবেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
প্রধানমন্ত্রী, এই দুটি ঘটনা সাধারণ অপরাধ নয় যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সমাজ ও রাজনীতিতে সে ক্ষতের উপশম হয়ে যাবে। এ এক অস্তিত্বের সংকট। এখন সরকার যে পথে হাঁটবে, তা থেকেই বোঝা যাবে দেশ ও গণতন্ত্র হিসেবে সাংবিধানিক মূল্যবোধ, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও নৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার শক্তি আমাদের আছে কিনা!
এ জন্য আপনাকে কয়েকটি পদক্ষেপ করতে বলছি।
প্রথমত উন্নাও এবং কাঠুয়ায় নির্যাতিতাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করুন ও আমাদের সবার হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিন।
দ্বিতীয়ত কাঠুয়ায় অভিযুক্তদের দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করুন। উন্নাওয়ের ক্ষেত্রে আর সময় নষ্ট না করে আদালতকে বিশেষ তদন্তকারী দল তৈরির অনুরোধ জানান।
তৃতীয়ত এই নিষ্পাপ দুটি মেয়ে ও ঘৃণার শিকার হওয়া অন্যদের স্মৃতিকে মাথায় রেখে ফের দলিত, মুসলিম ও অন্য সংখ্যালঘুদের বিশেষ সুরক্ষা দেওয়ার শপথ নিন। প্রতিজ্ঞা করুন মহিলা ও শিশুর জীবন ও স্বাধীনতা রক্ষা করা হবে। তাদের জীবন-স্বাধীনতার ক্ষেত্রে কোনো আশঙ্কা দেখা দিলে তা কাটাতে রাষ্ট্রের পূর্ণশক্তিকে নিয়োগ করা হবে।
চতুর্থত ঘৃণা ছড়ায় এমন বক্তৃতা দিয়েছেন বা ঘৃণা থেকে যে অপরাধ হয়েছে তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন ব্যক্তিকে সরকার থেকে সরান।
পঞ্চমত ঘৃণা থেকে যে অপরাধ হয় তা সামাজিক, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক পথে কীভাবে মোকাবেলা করা যায় তা স্থির করতে সর্বদল বৈঠক ডাকুন।
হতে পারে এই পদক্ষেপগুলো অনেক দেরিতে অতি অল্প কাজের নজির। কিন্তু এগুলো অন্তত কিছুটা স্বাভাবিকত্বের বার্তা দেবে। যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে তা যে বন্ধ করা যায় সেই আশাও তৈরি হবে। আশাতেই বাঁচি।’
jugantor
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন