দীর্ঘদিন ভারতীয় চলচ্চিত্র, ফ্যাশন, আর খাবারে মজে ছিল মালদ্বীপবাসী। রাজধানী মালের সবচেয়ে কাছের ভারতীয় শহর থিরুবনাথাপুরামের সাইনবোর্ডগুলো লেখা ধিভেহি ভাষায়। সেখানকার অধিবাসীরাও মালদ্বীপের ভাষায় অনর্গল কথা বলেন। অপরদিকে প্রতিবছর মালদ্বীপের লাখো মানুষ ভারত সফর করতেন। সাংস্কৃতিক মিল থাকায় যেতেন চিকিৎসার জন্যও।
রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ছোট্ট দ্বীপ রাষ্ট্র মালদ্বীপকে সুরক্ষা ও নিরাপত্তা দিয়ে আসছিল ভারত। তামিল ভাড়াটে হামলাকারীদের থেকে
মামুন আবদুল গাইয়ুম সরকারকে রক্ষার জন্য ১৯৮৯ সালে সৈন্য পাঠিয়েছিলেন রাজীব গান্ধী। আরো সম্প্রতি মালের লবণাক্তমুক্তকরণ প্লান্টটি আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ভারত খাবার পানি দিয়ে নৌবাহিনীর জাহাজ আর বিমান পাঠিয়েছিল। কিন্তু মালদ্বীপ-ভারত এই মাখামাখি এখন কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে, অন্তত রাজনৈতিক ফ্রন্টে। চীনকে গ্রহণ করার জন্য ভারতকে প্রত্যাখ্যান করে চলেছেন প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন।
ভারতবিরোধী অবস্থান গ্রহণ শুরু হয়েছিল সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ওয়াহিদের সময়। তিনি মালদ্বীপ থেকে ভারতের জিএমআরকে বের করে দিয়ে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর উন্নয়নের ৫১১ মিলিয়ন ডলারের চুক্তিটি বাতিল করে দিয়েছিলেন। তিনি মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য ভারতকে অভিযুক্তও করেছিলেন। তার এ বিষোদগার নিয়ে আরো বেশি বিস্ময় সৃষ্টির কারণ ছিল ব্যাপক বিতর্কিত ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে গঠিত তার সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে গ্রহণযোগ্য করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিলেন মনমোহন সিং।
কয়েক দশক ধরে চলা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে প্রথম টানাপোড়নের সৃষ্টি করে জিএমআর জটিলতা। মোহাম্মদ নাশিদের প্রেসিডেন্সির শেষ পর্যায়ে জিএমআরবিরোধী ও ভারতবিরোধী অবস্থানের সৃষ্টি হয়। নাশিদের বিতর্কিত বিদায়ের পর ওয়াহিদ প্রেসিডেন্ট হলে জিএমআরকে বিদায় করা ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু সেখানে না থেমে সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটতে থাকে। ইয়ামিন ক্ষমতায় আসার পর অবস্থার আরো অবনতি ঘটে।
এর কারণ কী? এককথায় চীন। ভারত মহাসাগরে চীনকে পেশীশক্তি প্রদর্শন করার সুযোগ দিয়েছেন ইয়ামিন। আর তা ভারতকে প্রবলভাবে উদ্বিগ্ন করেছে। মালদ্বীপে যাতে বিদেশীরা জমি কিনতে পারে (অন্তত ১০০ কোটি ডলারে) সেজন্য ইয়ামিন সরকার ২০১৫ সালে সংবিধান সংশোধন করেছেন। চীনা ও সৌদিরা যাতে জমি কিনতে পারে, সে সুযোগ দিতেই এ উদ্যোগ বলে মনে করা হচ্ছে। গত বছর বেশ তাড়াহুড়া করে চীনের সাথে বিতর্কিত অবাধ বাণিজ্য চুক্তি করে মালদ্বীপ। ভারতের কষ্ট আরো বাড়িয়ে চীনা একটি কোম্পানির সাথে সবচেয়ে বড় অবকাঠামো চুক্তিটি করেন ইয়ামিন। ওই চুক্তির মধ্যে রয়েছে ‘ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ’, সাত হাজার হাউজিং ইউনিট নির্মাণ, একটি হাসপাতাল নির্মাণ, একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ও লামু লিঙ্ক রোড নির্মাণ।
চীনা বিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রু স্মলের মতে, এসব ঘটনা ভারতকে উদ্বিগ্ন করছে।
সর্বশেষ উত্তেজনা বাড়ে ভারতের উপহার দেয়া দুটি হেলিকপ্টার মালদ্বীপের ফেরত দেয়ার ঘটনায়। গুরুতর অসুস্থ রোগী পরিবহন ও অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযানে মালদ্বীপ সামরিক বাহিনী হেলিকপ্টার দুটি ব্যবহার করত। হেলিকপ্টার দুটি ফেরত নয়া দিল্লির মুখে চড় মারা বলে বিবেচিত হচ্ছে।
ভারতকে আরো বেশি আতঙ্কে ফেলে পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের মালদ্বীপ সফর এবং এই ঘোষণা যে, মালদ্বীপের বিশেষ অর্থনৈতিক জোনে মালদ্বীপের উপকূলরক্ষীদের পাশাপাশি পাকিস্তানি রণতরীগুলো টহল দিতে পারে। ভারতীয় কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার খবরে বলা হয়, পাকিস্তানের সাথে যৌথ টহল নয়া দিল্লির জন্য লাল রেখা।
স্মল বলেন, চীনকে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী বিবেচনা করা হয়। কিন্তু পাকিস্তান হলো সুস্পষ্ট শত্রু। মালদ্বীপ ও পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি সামরিক সহযোগিতাকে ভারত ভালোভাবে নেবে না।
তিনি আরো বলেন, মালদ্বীপে চীনাদের হয়ে পাকিস্তানের আবির্ভাব নয়া দিল্লিকে উদ্বেগে ফেলবে।
এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ভারত বোঝে যে চীনের সাথে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্কের জের ধরে নিরাপত্তা সহযোগিতাও হবে। তাছাড়া চীনের ভারত মহাসাগরীয় বৃহত্তর লক্ষ্যও আছে। কিন্তু পাকিস্তানকে ওই নিরাপত্তা বলয়ে টেনে আনা হলে ভারতের জন্য তা ভিন্ন ধরনের উদ্বেগের সৃষ্টি করবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন