পশ্চিমা বিশ্ব একটি কারণেই অজেয় অস্ত্রাগার স্থাপন করেছে, যাতে বিশ্বে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে পারে। আর সিরিয়াই সম্ভবত সেই জায়গা যেখানে এই অস্ত্র ব্যবহার করা হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময় ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী প্রকৃতির পুঁজিবাদ এখন নতুন রূপ নিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাবেক ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে এই পুঁজিবাদী চরিত্র অনেকটা কাঠামোবদ্ধ রাজনৈতিক স্বাধীনতার ছদ্মবেশ নিয়েছে। প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থানের কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর আর আগের মতো সরাসরি উপনিবেশ স্থাপনের দরকার নেই। সেই সাথে এসব দেশের পণ্য ও অর্থের প্রয়োজনে একচেটিয়া বাজার ধরে রাখারও প্রয়োজন পড়ে না।
আগের মতো রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই সাবেক কলোনির দেশগুলো নিজেদের প্রয়োজনীয় পণ্য, অর্থায়ন ও প্রযুক্তির জন্য এসব সাম্রাজ্যবাদী দেশের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। তাদের এই নির্ভরতা ধরে রাখতে যেখানে সম্ভব আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংককে ব্যবহার করা হয় এবং যেখানে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ দরকার সেখানে তা-ই করা হয়।
অধিক সামরিক শক্তি
নতুন শতাব্দীর সূচনার পর থেকে এ ধরনের নির্ভরতা ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। বিশেষ করে চীনের উত্থান পশ্চিমাদের একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণ ও অর্থায়ন পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে। বিশ্বের দক্ষিণের দেশগুলোতে অর্থাৎ আফ্রিকা, এশিয়া ও ল্যাটিন অ্যামেরিকা অঞ্চলের দেশগুলোকে এখন আর তাদের পণ্যের জন্য মার্কিন বাজারের ওপর নির্ভর করতে হয় না, অথবা নিজেদের দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন শুধু বিশ্বব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল নয়।
চীন এখন এসব কিছুর বিকল্প সরবরাহকারী এবং সাধারণত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোর চেয়েও অনেক সহজ শর্তে সরবরাহ করে। অব্যাহত অর্থনৈতিক অচলাবস্থার সময় তাদের নতুন ঔপনিবেশিক দেশগুলোর এই ক্ষতি পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলোর কাছে মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। সেই সাথে পশ্চিমাদের স্বার্থে অনেক যত্নে গড়ে তোলা জবরদস্তিমূলক বিশ্বব্যবস্থাকেও চোখ রাঙানো।
পশ্চিমা বিশ্ব এখন এই দেশগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে বশে আনতে না পেরে ক্রমাগত নিজেদের প্রভাববলয়ে রাখার চেষ্টা করছে এবং পর্যায়ক্রমে সামরিক শক্তি প্রয়োগের দিকেই এগুচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স নিঃসন্দেহে নতুন শতাব্দী শুরুর আগে থেকেই স্থায়ী যুদ্ধের মধ্যেই আছে। যুগোস্লাভিয়ার সাথে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ যাত্রার শুরু এবং এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, মালি, সিরিয়া এবং ইয়েমেনে (এসবের কোনোটিই প্রক্সিযুদ্ধ নয়, যেমন- কঙ্গোর সাথে হয়েছে বা পাকিস্তান, সোমালিয়া বা অন্যান্য দেশের সাথে ড্রোন যুদ্ধ শুরু হয়েছে)।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের লক্ষ্য একই- স্বাধীন উন্নয়ন সক্ষমতা বাধাগ্রস্ত করা। এটি সামগ্রিকভাবে নির্দেশ করে এই যুগের অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে কমিয়ে আনা বা কমার যে এসব যুদ্ধ তাদের বিরুদ্ধেই হয়েছে, যেসব দেশের শাসকেরা একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশে চলত (যেমন- আফগানিস্তান, ইরাক) অথবা যেসব দেশের নেতাদের অর্থের বিনিময়ে হুকুম মানানো যেত (লিবিয়া, সিরিয়া)।
এভাবে যেখানেই একবার এমনটা হয়েছে, সেখানেই আংশিকভাবে হলেও পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং বর্তমানে এই প্রভাব ক্রমেই এককভাবে সামরিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। মজার ব্যাপার হলো, বর্তমান সময়ে সেই সামরিক শক্তিও প্রতিনিয়ত ক্ষয়ে যাচ্ছে।
বিশ্ব শক্তির ধস
চীনা অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে যেতে কত সময় লাগবে সে ব্যাপারে যে ভবিষ্যদ্বাণী তা প্রতিনিয়তই ভাঙছে। ২০১৬ সালে যেখানে বিশ্ব অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারিত্ব বেড়েছে ২৫ শতাংশ, সেখানে চীনের অংশীদারিত্ব ১৫ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এই বৃদ্ধির হারের ব্যবধান দ্রুত কমতে শুরু করেছে। ব্যবধান কমার হার যেভাবে বাড়ছে, তাতে ২০২৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যাবে চীনা অর্থনীতি।
এমন কি পুতিন নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ইরানকে ছাড় দিতে প্রস্তুত হয়েই আছেন এবং তা চীনের ক্ষেত্রেও একই (যেমন- অবরোধ তুলে নেয়া অথবা ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া ইত্যাদি)। কিন্তু কংগ্রেস ট্রাম্পকে এমন ছাড় দেয়ার সুযোগ কখনোই দেবে না।
বিষয় হলো- কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী এ যুক্তিও তুলে ধরেছেন, শক্তির সমতা ও নানামাত্রিক মূল্য বিশ্লেষণে এটি এখন মীমাংসিত বিষয় যে, চীনা অর্থনীতির আকার এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির আকারের চেয়েও বড় হয়ে গেছে। সেই সাথে গত এক দশক ধরেই চীনা উৎপাদন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি। চীনের রফতানি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এক তৃতীয়াংশ বেশি আর প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীন প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ উৎপাদন করে যাচ্ছে।
এ ধরনের উন্নয়ন কেবল অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ শুধু তা-ই নয়, বরং অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব সামরিক শ্রেষ্ঠত্বে রূপ নেয়া এখন কেবল সময়ের ব্যাপার এবং এটাই যুক্তরাষ্ট্র ও কখনো কখনো তার মিত্রদের বিশ্বময় কমতে থাকা প্রভাব প্রতিপত্তি ধরে রাখার উপায় হিসেবে সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব ব্যবহারের সুযোগও কমিয়ে দিচ্ছে।
ক্ষমতা পরিবর্তনের রাক্ষস
নিজেদের নিরাপত্তা দিতে যথেষ্ট সক্ষম নয়, রাষ্ট্রের ভেতরের এমন সত্যিকারের ও তৎপর মিত্রদের দিকে নজর দেয়ার পরিবর্তে বরং চীন ও এর প্রধান মিত্রদেশ রাশিয়ার সাথে সরাসরি যুদ্ধ এড়াতে এ যাবৎকাল পর্যন্ত যেসব কৌশল নেয়া হয়েছে তা খুবই স্পষ্ট। কিন্তু সিরিয়ায় ক্ষমতার পরিবর্তনের জন্য রাশিয়ার যে ভক্ষকের ভূমিকা তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে স্পষ্ট হয়েছে এটা কখনো সম্ভব নয়।
রাশিয়ার সাথে কেমন আচরণ করতে হবে এ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনেরা বেশ বিভক্ত। এক পক্ষ ভাবছে, ইরান ও চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হলে রাশিয়ার নীরব সম্মতির দরকার (ট্রাম্পের পক্ষের লোকজনের পরামর্শ) আর অন্য অংশ (হিলারি ক্লিনটনের পক্ষ) ভাবছে, রাশিয়া নিজেই ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটাবে।
‘সিরিয়া যুদ্ধের তীব্রতা কিভাবে বাড়তে পারে এটা বুঝতে পারা খুবই সহজ : তবে নিশ্চিতভাবেই এটা বোঝা খুবই কঠিন যে, এ যুদ্ধ আর বাড়বে না’। তবে দুপক্ষের অন্তরেই এই কামনা যে, রাশিয়া ও চীনের সম্পর্কে ফাটল ধরুক। ক্লিনটনের পক্ষ যেমন রাশিয়া থেকে চীনকে দূরে রাখতে চায়, তেমনি ট্রাম্পের পক্ষ চায় চীন থেকে রাশিয়াকে দূরে রাখতে। ভাবনার বিষয় হলো, এদের কারো কৌশলই কাজ করছে না। কেননা, এ বিষয়টি খুবই পরিষ্কার যে, রাশিয়া-চীন সম্পর্ককে দুর্বল করার অর্থ হলো এই দুই দেশকেই দুর্বল করে দেয়া। এখানে আরো একটি বিষয় হলো, পুতিন নিজের স্বার্থে ইরানকে ছাড় দিতে প্রস্তুত হয়েই আছেন এবং তা চীনের ক্ষেত্রেও একই (যেমন অবরোধ তুলে নেয়া অথবা ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া ইত্যাদি)। কিন্তু ট্রাম্পকে এমন ছাড় দেয়ার সুযোগ কংগ্রেস কখনোই দেবে না।
ট্রাম্প খুব আন্তরিকভাবেই চাইবেন অবরোধ তুলে নিতে, কিন্তু এ ক্ষমতা তার হাতে নেই। এমনকি সিরিয়া থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করার মতো প্রশান্ত প্রস্তাব হয়তো তিনি শুধু দিতেই পারবেন অথবা রাশিয়ার মিত্রদেশের ওপর মিসাইল হামলার হুমকি টুকুই কেবল দিতে পারবেন। এটি রাশিয়ার সাথে তার গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদেশগুলোর জোটকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য যথেষ্ট নয়।
অকল্পনীয় যুদ্ধ
এই দ্বিধা ‘রাশিয়ার সাথে সরাসরি যুদ্ধের অ্যাজেন্ডাকে সরাসরি অকল্পনীয় করে তোলে। গত মাসের ঘটনাগুলো পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছে, কিভাবে এবং কতটা দ্রুত এই দ্বিধা বাড়ছে। ব্রিটেনের সচেতন পদক্ষেপ, রাশিয়ার সাথে সারা বিশ্বের কূটনৈতিক ভাঙন ধরানোর চেষ্টা শুরুর পদক্ষেপ হিসেবে পরিষ্কার করে দিয়েছে, তারা আসলে কি করতে চেয়েছিল এবং এটা সম্ভবত ছিল সিরীয় যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই।
অবস্থা দেখে মনে হয়, এর প্রতি রাশিয়ার সমর্থন দেয়া থেকে বিরত রেখে তা এখনই প্রতিহত করা হবে এবং রাশিয়ার দেয়া সরাসরি হুমকির মুখে এ ধরনের অভিযান চালানোর ব্যাপারে পশ্চিমাদের যে ভয়, সামনের দিনগুলোতে এমন ঘটনা শুধু বাড়বেই। রাশিয়াকে এমন পরীক্ষার মধ্যে ফেলা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।
‘সিরিয়া যুদ্ধের তীব্রতা কিভাবে বাড়ছে এটা দেখা খুবই সহজ : তবে নিশ্চিতভাবেই এটা দেখা খুবই কঠিন যে, এ যুদ্ধ আর বাড়বে না। সিরিয়ায় ইরানকে প্রতিহত করার বিষয়ে ওয়াশিংটনে বহু আলোচনা হয়েছে এবং সম্প্র্রতি সিরিয়ায় ইরানি অবস্থানগুলোতে ইসরাইল হামলা জানান দেয়, যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতিতেই হোক আর অসম্মতিতেই, ইসরাইল ইরানের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ইরান-ইসরাইল এই চলমান যুদ্ধ খুব সহজেই রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রকেও প্রভাবিত করবে। রাশিয়া এখান থেকে সরবে এমনটা আশা করা কঠিন। এ পর্যন্ত দুই-আড়াই বছরে ইসরাইল হাড্ডাহাড্ডি যুদ্ধেও লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে, আর এটা থেকে এও বোঝা যায়, তাদের রক্ষার ব্যাপারে রাশিয়া কতটা উদাসীন এমনকি প্রতিশোধও নিতে পারে অথবা কম করে হলেও প্রতিশোধ নিতে তার মিত্রদের সহযোগিতা করবে।
নিঃসন্দেহে বলা যায়, গেল সপ্তাহে নেতানিয়াহুকে পুতিন হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, সিরিয়ায় আক্রমণ করলে তাকেও ছাড়া হবে না। আর একবার যখন রাশিয়া ইসরাইলিদের হত্যা করা শুরু করল, যুক্তরাষ্ট্র সেখানে জড়াবে না এটা ভাবাও কঠিন।
সিরিয়া যুদ্ধ আরো বড় আকার ধারণ করে রাশিয়ার সাথে সরাসরি যুদ্ধের এটি কেবল একটিমাত্র দৃশ্য। চীনের সাথে অর্থনৈতিক যুদ্ধ এরই মধ্যে চলছে এবং দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সরবরাহ লাইন বন্ধ করে দেয়ার জন্য এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ জাহাজ তৈরি হচ্ছে।
এমন প্রত্যেকটি উসকানি এবং যুদ্ধের দামামা যেকোনো একটি বা এদের সব পক্ষকেই প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতা প্রদর্শনে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। আর এটি স্পষ্ট নির্দেশ করে, পশ্চিমা দেশগুলো আবারো সাম্রাজ্যবাদের দিকেই ঝুঁকছে। এরা এরই মধ্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী অস্ত্রাগার স্থাপন করেছে এবং তা একটি মাত্র কারণে- বিশ্বে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে। সেই সময় সন্নিকটে যখন এসব অস্ত্র ব্যবহার করা হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে যারা সত্যিকার অর্থেই রুখে দাঁড়াতে পারে এবং বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনাও আছে।
ড্যান গ্লেজব্রুক, রাজনীতি বিশ্লেষক। স্টপস্টার্ভিং ইয়েমেন ওআরজির সম্পাদক মিডলইস্ট আই থেকে ভাষান্তর করেছেন মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন