সিরিয়ার আফরিনে সফল অভিযান শেষ করে আগাম নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান। কুর্দিদের হটানোর সাফল্যের সাথে বিরোধী দলগুলোকেও নিয়ন্ত্রণে রাখার কারণে এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন এ কে পার্টি নিরঙ্কুশ জয়লাভ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মধ্যবামপন্থী দলের নেতা দেভলেট বাচেলি আগাম নির্বাচন দেয়ার দাবি জানানোর পরই মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৮ মাস আগেই আগাম নির্বাচনের কথা জানান এরদোগান।
আগামী ২৪ জুন দেশটিতে প্রথমবারের মতো নতুন পদ্ধতির সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ওই নির্বাচনের মাধ্যমে আরো বাড়ানো হচ্ছে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা। ২০১৭ সালের এপ্রিলে সংবিধান সংশোধনীর জন্য নেয়া গণভোটের ফলে নতুন করে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা কয়েক গুণ বাড়ানো হয়। দেশটির ভাইস-প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী ও উঁচু পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা ও জ্যৈষ্ঠ বিচারকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের একচ্ছত্র ক্ষমতা দেয়া হয়। নির্বাচনের আগাম ঘোষণা দেয়ার পরই দেশটির মুদ্রার মান বেড়েছে। একে পার্টির সাবেক নেতা আহমেদ দাভাতোগলো জানিয়েছেন, ‘অর্থনৈতিক উদ্বেগ, সিরিয়া যুদ্ধে নিজেদের জড়ানোর কারণেই আগাম নির্বাচন দিচ্ছেন এরদোগান। এরদোগান ও তার শরিক দলের নেতারা চান, বিরোধী দলকে রাজনীতির মাঠ গোছানোর সুযোগ দেয়ার আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ফের ক্ষমতায় ফেরা।’
তুরস্কের নয়া সুলতান এরদোগানের সামনে চ্যালেঞ্জও কম নয়। সিরিয়া ইস্যুতে ওয়াইপিজি ও কুর্দি যোদ্ধাদের দমাতে সিরিয়ায় যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তুর্কি বাহিনী। অথচ ন্যাটো ওয়াইপিজি ও কুর্দিদের সমর্থন দেয়ায় ন্যাটের সাথে তুরস্কের সম্পর্কের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এরদোগানকে। ইরান ও রাশিয়ার সাথে মিলে সিরিয়া সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছে তুরস্ক। ফলে এসব দেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কেবল প্রেসিডেন্ট নিজেই একক সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার বলেও মনে করছে এ কে পার্টি।
আজকের বিশ্বে প্রভাবশালী মুসলিম নেতাদের মধ্যে শীর্ষে এরদোগান। ফিলিস্তিন সমস্যা, কাতার অবোরোধ, সৌদি-ইসরাইল ঘনিষ্ঠতা, জেরুসালেম প্রসঙ্গ, ইয়েমেনে সৌদি হামলা, ইরান-রাশিয়া মিত্রতা, আমেরিকা-ন্যাটো-তুরস্ক বৈপরীত্য, রোহিঙ্গা ইস্যু- এসব কিছুতেই সরব থেকেছে তুরস্ক। দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।
মার্কিন জরিপ সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টারের প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, ‘মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্কের প্রভাব সবচেয়ে বেশি এবং ক্রমবর্ধমান। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে লেবাননে এরদোগান সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। দেশটির ৬৬ শতাংশ মানুষ তাকে নেতা হিসেবে পছন্দ করেন। তিউনিশিয়ার ৫৯ শতাংশ মানুষ এরদোগানের ভক্ত। ইসরাইলবাসীর কাছে এরদোগান সবচেয়ে অপছন্দের ব্যক্তি; তবুও ১৫ শতাংশ ইসরাইলি তার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। গত দশ বছরে মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্কের প্রভাব বেড়েছে ৬৩ শতাংশ, যা একটি রেকর্ড। এর মধ্যে জর্দানে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ৭৬ শতাংশ।’
তুরস্কে এরদোগানের জনপ্রিয়তার অন্যতম মূল কারণ অর্থনীতি। এরদোগানের নেতৃত্বে দেশটিতে স্থিতিশীলতা এসেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে দিন দিন দেশটি উন্নতি করছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি উঠতি শক্তি তুরস্ক। তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেশটিকে মধ্য এশিয়াসহ মুসলিম বিশ্বে বিনিয়োগ বাড়াতে সাহায্য করছে। এরদোগানের সরকার দেশের অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছে, স্বাস্থ্যসেবা খাতেও উন্নতি সাধন করেছে।
২০০২ সাল থেকে ক্ষমতাসীন দলটি প্রতিটি নির্বাচনে জয়লাভ করে আসছে। একে পার্টি ২০০২ সালে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে প্রথমবার ক্ষমতাসীন হয়; আসন পেয়েছিল ৩৬৩টি, ২০০৭ সালে ৩৪১, ২০১১ সালে ৩২৭ এবং ২০১৫ সালের জুন মাসের নির্বাচনে ২৫৮টি আসন। সর্বশেষ নির্বাচনেও ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় একে পার্টি। অপর দিকে, প্রধান বিরোধী দল বামপন্থী রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) ২০০২ সালে ১৭৮টি, ২০০৭ সালে ১১২টি, ২০১১ সালে ১৩৫টি, ২০১৫ সালের জুনের নির্বাচনে ১৩২টি আর সর্বশেষ নির্বাচনে ১৩৪টি আসনে বিজয়ী হয়।
জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ার মূল কারণ হচ্ছে, এর নেতৃত্বের যারা আছেন তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা যায়নি। দলটির বড় সাফল্য সেনাবাহিনীকে গণতন্ত্রমুখী করা। সেনাবাহিনী এখন গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। সেনাবাহিনীর সঙ্গে বৈরিতায় না গিয়ে, তাকে গণতন্ত্রের মূল ধারায় ফিরিয়ে এনেছেন এরদোগান। ইসলাম ও গণতন্ত্র যে একে অপরের পরিপূরক এবং ইসলাম গণতন্ত্রের শত্রু নয় কিংবা গণতন্ত্র ইসলামের বিরোধী নয়, এরদোগানের দল এটা প্রমাণ করেছে।
অপর দিকে, এরদোগানের ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তার পেছনে রয়েছে আদর্শিক চেতনার জাগরণ। ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর এরদোগানের জনপ্রিয়তা শুধু বাড়েনি তিনি হয়ে উঠেছেন তুরস্কের প্রতীক। অভ্যুত্থানের পর পরিচালিত সব জনমত জরিপেই দেখা গেছে, তার জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে। অনেকে মনে করেছিল, ব্যাপক ছাঁটাই ও গ্রেফতারে তার জনপ্রিয়তা কমে যাবে, জনসাধারণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটাতে আগাম নির্বাচনেই প্রমাণিত হবে আসলে তার জনপ্রিয়তা আরো বেড়েছে নাকি কমেছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন