আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম নজরদারি সংস্থা রিপোর্টার্স সঁ ফ্রঁতিয়ে বা আরএসএফ বলছে, নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বড়সড় হুমকির মুখে পড়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিচারের যে আন্তর্জাতিক তালিকা তারা প্রকাশ করেছে, তাতে ভারতের অবস্থান ১৩৮-এ এসে দাঁড়িয়েছে। গত বছর ভারতের অবস্থান ছিল ১৩৬।
সরকারের সমালোচনামূলক অথবা তথাকথিত জাতীয়তাবাদ বিরোধী যে কোনও সংবাদ প্রকাশ করলেই সাংবাদিকদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে - যার সিংহভাগই করা হচ্ছে মোদীর ‘ট্রোলিং বাহিনী’র দ্বারা। খবর বিবিসি
ভারতের পরিচিত টেলিভিশন উপস্থাপিকা ও বর্তমানে টাইমস অফ ইন্ডিয়া গ্রুপের কনসাল্টিং এডিটর সাগরিকা ঘোষ এমন একজন সাংবাদিক, যাকে নিয়মিত হুমকি দেওয়া হয় অত্যন্ত কদর্য ভাষায়। তাকে যেমন প্রাণে মেরে ফেলা বা গণধর্ষণের হুমকি দিয়ে ফোন বা চিঠি আসে। বাদ যায় না তার স্কুল পড়ুয়া কন্যার নাম করেও অপহরণ ও ধর্ষণের হুমকি। মিসেস ঘোষ বলছিলেন, সংবাদ লেখার কারণে তাঁকে কী কী সহ্য করতে হয়।
সাগরিকা ঘোষ বলেন, ‘আমি জানি না কোন লেখা বা প্রতিবেদনের জন্য নিয়মিত হুমকি দেওয়া হয়। কিন্তু অশ্লীল ভাষায় গণধর্ষণ করার বা মেরে ফেলার হুমকিগুলো আসে। ছবি মর্ফ করে পর্ণোগ্রাফিক ভিডিও বানানো হয়। পুরুষ সাংবাদিকদেরও হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে, তবে আমার মতো কয়েকজন নারী সাংবাদিককে হুমকি দেওয়ার সময়ে একটা সেক্সুয়াল ওভারটোন থাকে।’
সাগরিকা ঘোষ আরো বলেন, ‘এমনকি আমার মেয়ের নাম করেও হুমকি দেওয়া হয়। তিনটে অভিযোগ দায়ের করতে হয়েছে পুলিশের কাছে। তার ওপরে বাড়িতে নিরাপত্তা কর্মীও রাখতে হয়েছে আমাকে।‘
শুধু মিসেস ঘোষ নন, ভারতের আরও অনেক সাংবাদিকই সম্প্রতি পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হুমকির মুখে পড়েছেন। রভিশ কুমার বা সিদ্ধার্থ বরদারাজনদের মতো প্রতিথযশা সাংবাদিকদেরও হুমকি দেওয়া হয় নিয়মিত।
সরকার বা তার ঘনিষ্ঠদের সমালোচনা করে লেখা প্রতিবেদনের দায় নিয়ে চাকরি খোয়াতে হয় বর্ষীয়ান সম্পাদকদের। রিপোর্টার্স সঁ ফ্রঁতিয়ে তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে লিখেছে, কট্টর জাতীয়তাবাদীরা ক্রমবর্ধমান হারে সাংবাদিকদের টার্গেট করছে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে।
প্রতিটি বিতর্কের ক্ষেত্রেই যে কোনও ধরণের কথিত জাতীয়তাবাদ বিরোধী প্রশ্নকেই হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা বলপূর্বক সরিয়ে দিতে চাইছে বলে উল্লেখ করেছে আরএসএফ। এবং এই সব হুমকির বেশীরভাগটাই করা হচ্ছে ‘মোদীর ট্রোলিং বাহিনীর দ্বারা’।
সাংবাদিকদের জাতীয় সংগঠন প্রেস ক্লাব অফ ইন্ডিয়ার সভাপতি গৌতম লাহিড়ীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ভারতের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে আরএসএফের এই মন্তব্য কতটা সঠিক?
গৌতম লাহিড়ীর বলেন, ‘বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা যে কী অবস্থা, তা এই প্রতিবেদন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। এটা অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। গত চারবছর ধরে একের পর এক ঘটনায় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপরে হস্তক্ষেপ করা বা সাংবাদিকদের হুমকি দেওয়া চলছে। বিশেষত যারা এই সরকারের সমালোচনা করে থাকেন লেখা বা প্রতিবেদনের মাধ্যমে, তাদের ওপরেই বেশী হুমকি দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। কয়েকজন তো মারাও গিয়েছেন। তবে কোনও ঘটনার ক্ষেত্রেই আজ পর্যন্ত ন্যায় বিচার পাই নি আমরা।’
তিনি আরো বলছিলেন যে অ্যাক্রেডিটেড সাংবাদিকদের মধ্যেও যারা সরকারের সমালোচনামূলক লেখা লেখেন, তাদের কালো তালিকাভুক্ত করে সরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব এনেছিল সরকার। সারা দেশের সাংবাদিককুলের প্রতিবাদে তা থেকে পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছে সরকার।
আরএসএফ আরো বলছে গৌরী লঙ্কেশের মতো সাংবাদিকদের যেমন প্রাণে মেরে ফেলা হয়েছে, তেমনই সরকারের বেশি সমালোচনা করলেই মুখ বন্ধ করার জন্য দেশদ্রোহিতার মামলা করা হচ্ছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। যদিও কোনও সাংবাদিকের এখনও পর্যন্ত সাজা হয় নি ওই সব মামলায়।
আরএসএফ বলছে, একদিকে যেমন সাংবাদিকদের হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে, অন্যদিকে সংবাদমাধ্যম মালিকরা এখন 'সেল্ফ সেন্সরশিপৰ বা স্বেচ্ছা-নিয়ন্ত্রণ শুরু করেছে - যাতে সরকারের সমালোচনামূলক খবর না প্রকাশ পায়।
সাগরিকা ঘোষ বলছিলেন, ‘এখন সংবাদমাধ্যমের মালিকানা এমন হয়েছে, যেন মনে হয় তারা পাবলিক রিলেশন এজেন্ট। সাংবাদিকদের মধ্যেও বহু এমন রয়েছে, যারা মুখ খুলতেই চায় না। আর যারা প্রশ্ন তুলতে চায়, তাদের মুখে বলা না হলেও বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে গুজরাত দাঙ্গার মতো’
‘কিছু কিছু বিষয় নিয়ে লিখলে সেটা ছাপাই হবে না, সরিয়ে দেওয়া হবে সেই সাংবাদিককে। কিন্তু প্রশ্ন করাটাই তো আমাদের কাজ, এটাই তো আমাদের পেশা। আমার তো নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে কোনও ব্যক্তিগত এজেন্ডা নেই।’
তবে কংগ্রেস আমলেও যে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ যে একেবারেই হত না তা নয়, তবে এখন সেটা হচ্ছে ব্যাপক আকারে। ঘটনাচক্রে ১৯৭৫ সালে ভারতে যে জরুরি অবস্থা জারী করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সেই সময়ে আইন করেই সংবাদপত্র সেন্সর করা হত। সেন্সরের ছাড়পত্র না পেলে কোনও কোনও সংবাদ কেটে সরিয়ে দেওয়া হত কাগজ থেকে - সেই জায়গাটা ফাঁকাই থাকত। বহু সাংবাদিককে জরুরী অবস্থার সময়ে জেলেও যেতে হয়েছিল।
প্রেস ক্লাব অফ ইন্ডিয়ার সভাপতি গৌতম লাহিড়ী অবশ্য যোগ করলেন, শুধু যে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে তা নয়, এটা অন্য রাজ্যগুলিতেও হচ্ছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলছিলেন, ‘গৌরী লঙ্কেশ নিহত হয়েছেন কর্ণাটকে, ত্রিপুরাতে বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই কিছুদিন আগে এক সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে সংবাদ সংগ্রহ করার সময়ে।’
লাহিড়ী বলছিলেন এটা ভারতের লজ্জা যে অনেক ছোট দেশও ভারতের থেকে গণমাধ্যম স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে। সাগরিকা ঘোষ আরও স্পষ্ট ভাষায় বলছিলেন, ভারতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্ভবত এখন মৃত।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন