চীনের ফুজিয়ান প্রদেশের নানগুয়ান গ্র্যান্ড মসজিদটিতে প্রত্যেক শুক্রবার বিপুল মুসল্লিদের পদচারণা সেখানে উৎফুল্ল জীবনের সূচনা করে। ইনচুয়ান থেকে স্থানীয় হুই মুসলমানরা সপ্তাহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নামাজটি আদায়ের জন্য এখানে আসেন।
ঠিক দুপুরের পরপরই সাদা টুপি পরে পুরুষেরা মসজিদটিতে প্রবেশ করেন এবং সোনালী রংয়ের ইসলামিক সব ডিজাইন এবং তিনটি সবুজ গম্বুজের মধ্যে যেন তারা অদৃশ্য হয়ে যান।
গম্বুজের চূড়ায় রুপালি রংয়ের চাঁদ আকৃতির প্রতীক রয়েছে যা সূর্যের আলোতে জ্বলজ্বল করে। মসজিদটি ছিল দেশটির প্রথম মধ্যপ্রাচ্য স্ট্যাইলের মসজিদ।
১৯৬৬ সাল থেকে শুরু হওয়া এক দশক ধরে চলা দাঙ্গা-হাঙ্গামায় দেশটির কয়েক হাজারেরও বেশি মন্দির, গির্জা, মসজিদ এবং মঠ ধ্বংস করা হয়। এই হাঙ্গামায় এই মসজিদটিও ধ্বংস করা হলে ১৯৮১ সালে তা পুনর্নির্মিত হয়। কিন্তু এখন এর পেঁয়াজ-আকৃতির গম্বুজ, বিস্তৃত নকশা এবং আরবি লিপি- যা ইসলামিকরণের একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা হিসেবে দেখছে দেশটির কর্তৃপক্ষ।
হুই স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল নিংজিয়াজুড়ে ইসলামিক সব সাজসজ্জা এবং অ্যারাবিক চিহৃসমূহ রাস্তাগুলো থেকে অপসারণ করা হয়েছে। পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য কর্তৃপক্ষ এক দশক আগে হুয়ান জাতিগত সংখ্যালঘুদের সংস্কৃতিকে হাইলাইট করা শুরু করেছিল।
ইনচিয়ন থেকে দক্ষিণে ইয়েলো নদীর ধূলিমাখা সমতলভূমি বরাবর রাস্তার পাশের ভবন, হোটেল এবং পার্ক থেকে পেঁয়াজ আকৃতির সবুজ, সোনালি ও সাদা রংয়ের গম্বুজ রাতারাতি সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
সরকার নতুন ‘আরব স্টাইল’এর মসজিদ নিষিদ্ধ করেছে এবং সেখানে বিদ্যমান কিছু কিছু মসজিদকে চীনা মন্দিরের আকারে রূপান্তর করার পরিকল্পনা রয়েছে।
নানগুয়ান মসজিদের একজন নারী সদস্য বলেন, ‘গত বছরের শেষের দিকে পুরো জিনিসটি শুরু হয়েছিল। এটি এখন এখানকার সবাইকে আতঙ্কিত করছে।’ কয়েক মাস আগে কর্তৃপক্ষ তার বাড়ির গম্বুজ-আকৃতির বৈশিষ্ট্যগুলি টুকরো টুকরো করে ভেঙ্গে ফেলে।
ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা
নিংজিয়াতে ধ্বংস আর অপসারণের গতি বৃদ্ধি পাওয়ায় হুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অস্বস্তি দেখা দিয়েছে; যারা কয়েক দশক ধরে সেখানে শান্তি তাদের বিশ্বাস অনুশীলন করে আসছিল।
আরব এবং মধ্য এশিয়ার সিল্ক রোড ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে আসা হুইদের সংখ্যা বর্তমানে ১০ মিলিয়নেরও বেশি। তাদের বেশিরভাগই ম্যান্ডারিন ভাষায় কথা বলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ হান জনসংখ্যার সঙ্গে শান্তিতে বাস করেন, এমনকি তাদের মতো একই রকম দেখতেও। যদিও তাদের পোশাকের মধ্যে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে।
সরকার একই রকমভাবে উইগুর মুসলিম সম্প্রদায়ের উপরও তার অভিযান আরো গভীর করেছে। জিনজিয়াংয়ের পশ্চিম সীমান্তে বসবাসকারী উইগুররা দেশটির আরেকটি বৃহত্তর মুসলিম গ্রুপ। সন্ত্রাসবাদ ও ইসলামি চরমপন্থার বিরুদ্ধে অভিযান জোরদারের অংশ হিসাবে নিংজিয়ায় হুই মুসলিমরাদেরকেও এখন লক্ষ্যবস্তু করা যাচ্ছে।
শব্দ দূষণের অজুহাতে ইনচিয়নে এখন আজান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নানগুয়ানে এখন আজানের সুরেলা কণ্ঠের পরিবর্তে একটি তীক্ষ্ণ এলার্ম ব্যবহার করা হয়। ইসলামি বই এবং কোরআনের কপিগুলি স্যুভেনির দোকানগুলির তাক থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। কিছু কিছু মসজিদে প্রকাশ্যে আরবি ক্লাস বাতিলের আদেশ দেওয়া হয়েছে এবং অনেক বেসরকারি আরবি স্কুল বন্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
স্থানীয় অধিবাসীরা জানান, টঙ্গজিনে মিং রাজবংশের (১৩৬৮-১৬৪৪) স্মৃতিচিহৃ হিসেবে দাঁডিয়ে থাকা চীনা-শৈলীর মসজিদটিতে নামাজের জন্য মুসল্লিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি তাদের মক্কায় হজে যেতেও বাধা দেয়া হয়েছে। সরকারি কর্মীদের টুপিপরে কাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
‘সিনিসিং ধর্মতত্ত্ব’
চীনা এই দমন-পীড়নের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে ‘সিনিসিং ধর্মতত্ত্ব’ গ্রহণে বাধ্য করা। ২০১৫ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং কর্তৃক এটি চালু করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল তাদেরকে চীনা সংস্কৃতির এক লাইনে নিয়ে আসা এবং কমিউনিস্ট পার্টির পরম কর্তৃত্ব ধরে রাখা।
ওই সময়ে শি বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশের জন্য আমাদের ‘সিনিসিং’ ধর্মতত্ত্বের দিক নির্দেশনা অনুসরণ করা উচিত এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজের সাথে মানিয়ে নিতে এটি একটি সক্রিয় ধর্ম নির্দেশিকা।’
চীনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত পাঁচটি ধর্মের মধ্যে তাওবাদ একমাত্র আদিবাসী ধর্ম। ভারতে উদ্ভূত বৌদ্ধধর্মকেও চীনা ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি ইসলাম, প্রোটেস্ট্যান্টিজম এবং ক্যাথলিক ধর্ম নিয়েও উদ্বিগ্ন এবং এসব ধর্মকে বিদেশি প্রভাব বা জাতিগত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহযোগী হিসেবে আলাদা করা হয়েছে।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট অবলম্বনে
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন