জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করে গত ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থাপনের ঘোষণার পর থেকে ফিলিস্তিন অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে নিজেদের আবাসভূমি হারানোর ৭০ বছর পূর্তি পালন করছে ফিলিস্তিনের জনগণ। জেরুসালেমে আনুষ্ঠানিকভাবে দূতাবাস উদ্বোধনের দিন গাজায় বিক্ষোভরত ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে ৬০ জনের বেশি, আহত হয়েছে ১৫০০-র বেশি মানুষ। গাজায় ইসরাইলি সেনাবাহিনীর গুলিতে যখন ফিলিস্তিনি জনগণের রক্ত ঝরছে, তখন জেরুসালেমে ট্রাম্পের ইহুদি জামাই জ্যারেড কুশনার হাস্যোজ্জ্বলভাবে বক্তব্য রাখছেন। জেরুসালেম ইহুদিদের বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলছেন, ‘একদিন যখন এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন আমরা সবাই এই দিনের কথা মনে করব, আমাদের শান্তির পথে যাত্রা শুরু হয়েছিল সত্যের প্রতি মার্কিন স্বীকৃতির ভেতর দিয়ে।’ কুশনার সেই সত্যর কথা বলছেন, যার মাধ্যমে পুরো জেরুসালেম হবে ইসরাইলের। ফিলিস্তিনিরা আর এ ভূখণ্ডে থাকতে পারবে না। এমন এক সময় এই দূতাবাস উদ্বোধন করা হলো যখন ফিলিস্তিনিরা তাদের ভূখণ্ড থেকে উচ্ছেদের প্রতিবাদে নাকবা দিবস বা বিপর্যয়ের দিন হিসেবে পালন করে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরাইল রাষ্ট্রের ঘোষণার দিনটিকে তারা এই দিন হিসেবে প্রতি বছর পালন করে আসছে। যে এলাকায় ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করা হয়, ইসরাইলি বাহিনী সেখান থেকে বেশির ভাগ আরবকে নিজ ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে। এর পর থেকে জাতিসঙ্ঘের হিসাবে প্রায় ৫০ লাখের বেশি ফিলিস্তিনি শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছে।
জ্যারেড কুশনার শুধু ইসরাইল নয় সৌদি-আমিরাতি শাসকদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কার্যত হোয়াইট হাউজ এখন পরিচালিত হচ্ছে তেলআবিব থেকে। যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাইক পেন্স ও কুশনারের মতো উগ্র ইহুদিরা।
গাজায় ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর নির্বিচার গুলিবর্ষণ মূলত মার্কিন-ইসরাইল-সৌদি মিত্রতার রক্তাক্ত পরিণতি। জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা এবং নতুন করে ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল ইসরাইলি তৎপরতার পেছনে সৌদি আরবসহ কয়েকটি আরব দেশের নীরব সমর্থন আছে। সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতিতে ফিলিস্তিন এখন আর গুরুত্ব পাচ্ছে না এমন ইঙ্গিত পাওয়ার পর থেকে ইসরাইলের বর্বরতা নতুন মাত্রা পেয়েছে। গাজায় এই বর্বরতার প্রতিবাদে বি শ্বজুড়ে ধিক্কার জানানো হয়েছে ইসরাইলকে। যদিও একদিন পর সৌদি বাদশাহ জেরুসালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থাপনকে মেনে নেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন।
মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক রাজনীতিতে নতুন যে মেরুকরণ হচ্ছে তাতে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে ফিলিস্তিনি জনগণকে। ইরানকে মোকাবেলার জন্য সৌদি আরবের নেতৃত্বে কয়েকটি আরব দেশ ইসরাইলের সাথে যে আঁতাতের সম্পর্ক গড়ে তুলেছে তাতে এসব দেশ ফিলিস্তিনি জনগণের নিজের আবাসভূমি ফিরে পাওয়ার দাবিকে ইসরাইলের ইচ্ছার অধীন করে ফেলেছে। অপর দিকে, ফিলিস্তিনি জনগণ রক্তের বিনিময়ে তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। কোন দেশ সমর্থন করছে বা করছে না তা নিয়ে লড়াই থেমে নেই। প্রজন্মের পর প্রজন্ম যে লড়াই চালিয়ে যাবে ফিলিস্তিনি কিশোরদের গুলতি নিয়ে ইসরাইলি সৈন্যদের মোকাবেলার ছবি তার প্রমাণ।
মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো যখন ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ আন্দোলনে সমর্থন দেয়া তো দূরে থাক তারা পরোক্ষভাবে ইসরাইলের নীতিকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে ইসরাইলের গণহত্যার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হলেও অনেক মুসলিম দেশ নীরব ভূমিকা পালন করছে। অপর দিকে, জাতিসঙ্ঘ ও ইউরোপীয় দেশগুলোর ডাবল স্ট্যান্ডার্ড নীতি গ্রহণ করেছে। এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করছে তুরস্ক। দেশটির প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলাকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের গণহত্যা বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি ওআইসির জরুরি বৈঠক ডেকেছেন। একই সাথে কুয়েতকে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আহ্বান ডাকার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। তুরস্ক দেশটিতে নিযুক্ত মার্কিন ও ইসরাইলি রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এ ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে একই সাথে তিন দিনের শোক ঘোষণা করেছে। সারা বিশ্বের রাষ্ট্র নেতারা যখন ফিলিস্তিনকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছে, তখন ফিলিস্তিনি জনগণ রক্ত দিয়ে দখলদার মুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করছে। আধুনিক মারণাস্ত্রের সামনে ইট-পাথর আর গুলতির লড়াই চলছে। এ লড়াইয়ে কোনো পরাজয় নেই।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন