মালয়েশিয়ার সাম্প্রতিক রাজনীতির চিত্রকে ‘শেক্সপিয়রের নাটক’ বলে অভিহিত করেছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি। দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির মাঠে থাকা আনোয়ার ইব্রাহিম প্রতিপক্ষ মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় আসতে চলেছেন। একাধিকবার জেলে কাটানো এই নেতা নিজের রাজনৈতিক উত্থান-পতনের গল্প শুনিয়েছেন।
ব্রিটিশ সাপ্তাহিক অবজারভারকে দেয়া বিশদ সাক্ষাৎকারে নাজিব রাজাক, মাহাথির মোহাম্মদসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেছেন মালয়েশিয়ার সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম।
মালয়েশিয়া নির্বাচনে জিতে দীর্ঘদিন পর আবারও প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন দেশটির আধুনিকায়নের জনক মাহাথির মোহাম্মদ। আর স্বাধীনতার পর থেকে দেশটির ক্ষমতায় থাকা বারিসান ন্যাশনাল প্রথমবারের মতো হেরে গেছে। দেশটির সাম্প্রতিক রাজনীতি বিস্ময় সৃষ্টি করেছে গোটা বিশ্বে। চিরশত্রু থেকে বন্ধুতে রূপান্তরিত হওয়া মাহাথির মোহাম্মদ এবং আনোয়ার ইব্রাহিমের বিষয়টি অনেকটা বিস্মিত করেছে আন্তর্জাতিক বোদ্ধাদের।
মাহাথির মোহাম্মদ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আনোয়ার ইব্রাহিমকে নিঃশর্ত ক্ষমা করার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করেন। যার ফলে খুব দ্রুতই বেরিয়ে আসেন আনোয়ার। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে দুই বছর পর তিনিই হবেন মালয়েশিয়ার আগামী প্রধানমন্ত্রী।
১৯৯৮ সালে উপপ্রধানমন্ত্রী পদ থেকে আনোয়ার ইব্রাহিমকে বহিষ্কার করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। ১৯৯৯ সালে সমকামিতার দায় দিয়ে তাকে জেলে পাঠান মাহাথির।
সেই মাহাথিরের সঙ্গেই জোট বেঁধে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন আনোয়ার। তবে সেই সময়কার কথা জানাতে গিয়ে আনোয়ার ইব্রাহিম জানিয়েছেন, শত্রুর সঙ্গে জোট বাধা কোনও সহজ কাজ ছিলো না। ছিল না পরিবারের সম্মতি। তবুও রাজনীতির কঠিন সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে মাহাথিরের সঙ্গে জোট বাঁধেন আনোয়ার ইব্রাহিম।
একসময়ের রাজনৈতিক সতীর্থ মাহাথির মোহাম্মদ শত্রুতে পরিণত হন ১৯৯৯ সালে। সেসময় সমকামিতার অভিযোগে জেলে যেতে হয় আনোয়ার ইব্রাহিমকে। দীর্ঘদিন কারাবাসের পর ২০০৪ সালে জেল থেকে ছাড়া পান তিনি।
সেসময় মাহাথিরের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল আদায় কাঁচকলায়। ২০০৫ সালে আনোয়ার ইব্রাহিম সম্পর্কে মাহাথির বলেছিলেন, ‘একজন সমকামী ব্যক্তি যদি দেশের প্রধানমন্ত্রী হন তাহলে তো কেউ নিরাপদ থাকবে না।'
তবে হঠাৎ করে কিভাবে এ দুই শত্রু বন্ধুতে পরিণত হলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে আনোয়ার ইব্রাহিম জানান, গত জানুয়ারিতে যখন মাহাথির তার সঙ্গে জেলে দেখা করতে যান। তখন তিনি সন্দিহান হয়ে পড়েন। তখন মাহাথিরকে তিনি বলেন ‘আমি কেন আপনার সঙ্গে সম্পর্ক করবো? আপনাকে আমি ক্ষমা করে দেব। আপনি যেতে পারেন।'
তখন মাহাথিরকে ফেরানোর সিদ্ধান্ত নিলেও পরে কিভাবে জোট বাঁধলেন এমন কথা জানাতে গিয়ে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, ‘এটা আমার জন্য অত্যন্ত কঠিন ছিল।'
শেষ পর্যন্ত মাহাথিরের সঙ্গে জোটের সিদ্ধান্ত নিলেও শুরুর দিকে পাশে ছিলো না আনোয়ার ইব্রাহিমের পরিবার। যে ব্যক্তি তাদের ওপর এক সময় অত্যাচার করেছে তার সঙ্গে কিছুতেই জোট বাঁধতে রাজি ছিলো না আনোয়ার ইব্রাহিমের সন্তানরা।
এ বিষয়ে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, ‘আমার সন্তানরা ঐক্যে অংশ নিতে চাইছিল না। তারা কোনায় গিয়ে কেঁদেছে। তারা বুঝতে পারছিল না, যে লোকটা আমাদের জীবন নরক করে দিয়েছে, তার সঙ্গে আমি কেন সাক্ষাৎ করব। তারা আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করল এবং আমাকে বলল- মাহাথিরের সঙ্গে আমাদের কোনও চুক্তি করা উচিত না। তারা বলল, তার কারণে আপনি ভুগেছেন, আমরা ভুগেছি।'
আনোয়ারের মেয়ে নুরুল ইজ্জাহ নিজের যোগ্যতা দিয়ে রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। তবে তিনি তার সন্তানদের সঙ্গে আলাপ করেছেন জানিয়ে আনোয়ার বলেন, তারা মাহাথিরের সঙ্গে ঐক্যের ব্যাপারে রাজি না হলে আমি তাদেরকে বলি ‘যদি তোমাদের কোনও শত্রু ফিরে আসে এবং বলে চলো আজ থেকে আমরা বন্ধু হই। আর অতীতের সবকিছু ভুলে যাই। তখন তাকে না বলা অত্যন্ত কঠিন।'
দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে নাজিব রাজাক সম্পর্কে আনোয়ার জানান, নাজিব রাজাককে সমর্থন না করার কারণে তাকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। তাছাড়া বিচারবিভাগকে করায়ত্ত করে ২০১৫ সালে তাকে সমকামিতার দায়ে জেলে প্রেরণ করা হয়।
তিনি বলেন, ‘আমি কখনই তাকে (নাজিব রাজাক) সমর্থন করিনি। তার বিরুদ্ধে আমার অবস্থান দৃঢ় এবং এটা তিনি ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছিলেন। এ কারণে তিনি আমাকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন।'
২০১৩ সালে নির্বাচনে হেরে যাওয়ার বিষয়ে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, ২০১৩ সালের নির্বাচন সুষ্ঠু ছিল না। যদি ঠিকমত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো তাহলে তার দলই জয়লাভ করতো।
সাক্ষাৎকারের শেষ দিকে তিনি বলেন, আমার পরিবার যথেষ্ট কষ্ট ভোগ করেছে। আসলেই যথেষ্ট কষ্ট। এবার তাদের স্বপ্ন পূরণের পালা। তারা এতদিন যেটা চেয়েছে সেটা করতে পারবে।
মালয়েশিয়ার ১৪তম সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে মাহাথির মোহাম্মদের নেতৃত্বে থাকা জোট পাকাতান হারাপান। তারপর আবারও প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসেন মাহাথির। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রথমেই আনোয়ার ইব্রাহিমকে মুক্ত করেন তিনি।
খুব দ্রুত দেশটির যে কোনও একটি আসন থেকে উপনির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন আনোয়ার ইব্রাহিম। জোটের চুক্তি অনুযায়ী দুই বছর মাহাথির প্রধানমন্ত্রী থাকার পর পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিবেন আনোয়ার।
বর্তমানে দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন আনোয়ার ইব্রাহিমের স্ত্রী ওয়ান আজিজাহ। মাহাথিরের দিকে কার্যত পাখির চোখ রয়েছে তার।
ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন