চীনের কথিত সংশোধনাগারে মুসলিমদের মদ ও শুকুরের মাংস খেতে বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন সেখান থেকে ফিরে আসা একাধিক ব্যক্তি।ওমর বেকালি তেমনি একজন। তিনি জানান, ‘সংশোধনাগারে প্রায় দশ লাখ দেশি বিদেশি নাগরিককে ধরে নিয়ে কমিউনিস্ট বানানো কাজ চলছে। যারা তাতে রাজি না হয়, তাদের ওপর চলে নানা অত্যাচার। ওমর বেকালি আরো বলেন, ‘আমাকে সম্পূর্ন অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার কারা হয়। কেন গ্রেপ্তার করা হয়, তাও জানানো হয় না। এমনকি আমাকে আইনজীবী নিয়োগেরও সুযোগ দেওয়া হয়নি।’
ওমর কাজাখিস্তানের নাগরিক। তিনি বলেন, ‘গ্রেপ্তারের ২০ দিন পর মনে হয়েছিল আমি আত্মহত্যা করবো। সেখানে আমাকে বিনা বিচারে আট মাস আটকে রাখা হয়।’
শুধু গত বছরই প্রায় দশ হাজার মুসলিমকে ‘সংশোধনাগারে’ নেয় জিংজিয়াং প্রদেশ সরকার। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে দেশি বিদেশি নাগরিক মিলে সেখানে ১০ লাখ বা তার বেশি আটক রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি মানবাধিকার কমিশনের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ইনডিপেন্ডেন্ট জানিয়েছে, ‘সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার এই সংশোধনাগারগুলো বর্তমান বিশ্বে সংখ্যালঘূদের দমনে অন্যতম হাতিয়ার।’ ঐতিহাসিকভাবে এগুলোকে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ বলা হয়।
এই ক্যাম্পগুলো সম্পর্কে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বার্তাসংস্থা এপিকে বলেছে, ‘সেখানে এমন কিছু ঘটে তা আমাদের জানা নেই।’
সেখানে বিদেশিদের কেনো আটকে রাখা হয় এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, ‘কেউ যদি চীনের আইন না মানে তাদের আইন শেখানোর জন্য এমনটি করা হতে পারে।’ তবে জিংজিয়াং প্রদেশ কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে মত দিতে রাজি হয়নি।
সংশোধনাগারে থাকাবস্থায় ওমর বেকালি যখন তাদের দেওয়া খাবার খেতে অস্বীকার করতো, তখন তার ওপর নেমে আসতো নির্যাতনের স্টীম রোলার, এমনকি তাকে না খাইয়েও রাখতো। এক সপ্তাহ পর তাকে নির্জন কারাবাসে পাঠানো হয়। সেটা ছিল আরো যন্ত্রণাময় স্থান। ২০ দিন পর সে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তাদের করা নজরদারির কারণে সেটা সম্ভব হয়নি।
ওমর বলেন, ‘সেখানে শারীরীক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হতো। কোনো দিন আমি একটুও ঘুমতে পরিনি।’
এই গ্রেফতারযজ্ঞ জিংজিয়াং প্রদেশজুড়েই চলছে, এমনকি ভারতের কিছু সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ধরে নিয়ে যায় চীনের সেনারা।
বরাবরই চীন সরকার মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের কথা অস্বীকার করে আসছে। বিশেষ করে কথিত সংশোধনাগারের নির্যাতনের কথা। কিন্তু রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, চরমপন্থি মুসলিমদের মোকাবেলা এবং রাষ্ট্রীয় আইন অমান্যকারীদের সংশোধন করতে এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উইঘু মুসলিমদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হচ্ছে। অভিযোগ আছে স্থানীয় উইঘু ও কাজাখ মুসলিমদের উচ্ছেদ করে সেখানে হান কমিউনিস্টদের বসতি গড়তেই এমন হত্যাযজ্ঞ চালানো হচ্ছে।
ওমর বেকালি কাজাখিস্তানের নাগরিক হওয়ায় মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছে। তবে তার চীনের নাগরিকত্ব বাতিল হয়েছে। তাকে মূলত চীনের নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা আটক করে। কোনো বিচার ছাড়াই ওমরকে আট মাস আটকে রাখা হয়। তবে বিষয়টি যাচাই করা আমাদের জন্য কঠিন হয়েছে। কারণ, চীন সরকার কাজাখিস্তানকে এসব বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য দেয়নি। কাজাখ কূটনৈতিক সূত্র বলছে, তাকে বিনা অপরাধে সাত মাস সংশোধনাগারে রাখা হয়।
সংশোধনাগারের এই প্রক্রিয়াটি চীনের অনেক পুরনো নিয়মের একটি। বর্তমান সি জিংপিং এটা আরো কঠিন করে ফেলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ টাউন ইউনিভারসিটির চীনা ইতিহাসের অধ্যাপক জেমস মিলওয়ার্ড বলেন, ‘জিংজিয়াংয়ে বেইজিং জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালাচ্ছে।’
চীনের এই সংশোধনাগার মানবজাতির ইতিহাসে একটি ভয়ঙ্কর সিস্টেম উল্লেখ করেছেন নিউ ওরলেয়ান্সভিত্তিক লয়লা ইউনিভারসিটির অধ্যাপক রেইন থাম।
গত বছরের জুনে জিংজিয়াং প্রদেশের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫৮৮ জন ব্যক্তিকে সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছে, যারা জানতো না যে তারা ভুল পথে চলছে। পরে অবশ্য তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের ৯৮ দশমিক ৮ শতাংশই ভুল বুঝতে পেরেছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) বলছে, চীন সরকার নিয়মিতই জিংজিয়াংয়ে বিভিন্ন বাড়ি ঘরে অভিযান চালাচ্ছে। অভিযানে দেখা হয় কে অন্য ধর্ম বা দলের সঙ্গে যুক্ত।
এইচআরডাব্লিউ’র গবেষক মায়া ওয়াং বলেন, ‘জিংজিয়াংয়ের মুসলিমরা সারাক্ষণই নিরাপত্তাবাহিনীর নজরদারিতে থাকে। যা তাদের জন্য দুঃসহ জীবনযাপন।’
২০১৭ সালের ২৩ মার্চ সকাল বেলা ওমর বেকালি কাজাখিস্তান থেকে চীনে তার বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে ভ্রমন ভিসায় সীমান্ত পার হন। এরই মধ্যে চীনা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাকে আটক করে ওই সংশোধনাগারে নিয়ে যায়। যেখানে নিয়ে তার হাত পা বেঁধে উল্টোকরে ছাদের সঙ্গে ঝুঁলিয়ে নির্যাতন করা হয়। এভাবেই চলে তিন দিন। তারপর তাকে অন্যান্য আটকদের সঙ্গে রাখা হয়। পাঁচদিন পর তাকে নির্জন কারাবাস দেওয়া হয়। সেখানেই আট মাস কাটে ওমরের।
ওমর ১৯৭৬ সালে চীনের কাজাখ ও উইঘু মুসলিমদের অঞ্চল জিংজিয়াংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। ২০০৬ সালে তিনি কাজাখিস্তানে যান এবং সেখানকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। ২০১৬ সালেও তিনি চীনে গিয়েছিলেন, তখনই নাকি তাকে ‘এই লোকটি সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত এবং স্বাধীনতাকামী’ বলে জিংজিয়াং প্রদেশ কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেন।
এখন ওমরের চীনের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে। তিনি বলেন, জিংজিয়াংয়ে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মুসলিম বাস করে। তাদের মধ্যে উইঘু ও কাজাখ জাতিগোষ্ঠীর মানুষ রয়েছে।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন