সর্বত্র এখন তারুণ্যের জয়জয়কার। আমাদের তরুণরা জাতিকে দেখাচ্ছে নতুন আশা। তারা ছড়িয়ে পড়ছে দেশ থেকে দেশান্তরে। কিছুদিন আগে তেমনি এক তরুণের সাক্ষাৎ পেলাম এক বিয়ে বাড়িতে। বয়স তিরিশের টগবগে যুবক, ব্যবসা করছে অ্যাভিয়েশন যন্ত্রাংশ নিয়ে- দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দেশ-বিদেশ। তার একাট ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার বোধ করলাম। তার কথাবার্তা আমাদের তরুণ-যুবকদের অনুপ্রাণিত করবে যথেষ্ট- সন্দেহ নেই।
কালের কণ্ঠ: সংক্ষেপে আপনার পরিচয়টা জানা যাক। আপনার পেশা কী, আর তা বাংলাদেশ এবং গোটা বিশ্বের জন্যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
আমার নাম ইমরান জাহান। আমি এভিয়েশন উদ্যোক্তা। আমি স্ট্রাটোস্ফিয়ার অ্যাভিয়েশনের প্রেসিডেন্ট। আমার একজন পার্টনার আছেন। তিনি কম্পানির চেয়ারম্যান আহমেদ হাসান। অ্যাভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিতে তার দীর্ঘ বছরের অভিজ্ঞতা এবং এক পরিচিত নাম। আমাদের বিমান বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যিক এবং মিলিটারি অ্যাভিয়েশনের নানা প্রয়োজন মেটায়। এয়ারলাইন্স ব্যবসায় কনসাল্টিংসহ বিমানের যন্ত্রাংশ বিক্রির কাজে জড়িত আমাদের এই প্রতিষ্ঠান।
কালের কণ্ঠ: আপনার শুরুটা বলেন। মানে অ্যারোনটিক্যাল ব্যবসা বা খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ এবং সেবাপ্রদানের শুরুটা কীভাবে হলো?
একজন উদ্যোক্ত হয়ে ওঠার স্বপ্ন আমার সবসময়ই ছিল। নিজের একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চিন্তা করতাম। আর অ্যাভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি আমাকে চুম্বকের মতো টানতো। তবে বিরূপ পরিস্থিতি এবং আমার জাতিগত পরিচয়ের কারণে এ পথে এগোতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। অবশেষে অসংখ্য নেতিবাচক চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে নিজের অসুবিধাজনক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসি। পরিচিত এবং বন্ধুদের সহায়তা মেলে। তারা আমাকে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণের সাহস জুগিয়েছেন। আর প্রায় সব সফল পুরুষের পেছনে একজন নারীর অবদান থাকে- এটা তো আমরা জানি। আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। এই কৃতিত্বের একটা অংশ আমার স্ত্রীর ওপর বর্তায়। আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নে তার সব ধরনের সহযোগিতায় ব্যবসাটা শুরু করতে পারি।
প্রথমদিকে সময়টা কেটেছে চ্যালেঞ্জ, ত্যাগ, মেনে নেয়া আর নির্ঘুম রাত কাটানোর মধ্য দিয়ে। বাজারে যখন আমাদের নাম ছড়াচ্ছে তখন এক প্রতিযোগী স্ট্রাটোস্ফিয়ারের বিরুদ্ধে টুনকো অভিযোগও ঠুকেছিলেন।
স্ট্রাটোস্ফিয়ারকে এক নম্বরে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি
কালের কণ্ঠ: বাংলাদেশের বাজারে কীভাবে আপনার ব্যবসার ভবিষ্যত দেখছেন?
বাংলাদেশের অ্যাভিয়েশন নিয়ে আমি আশাবাদী ছিলাম। এয়ারলাইন ব্যবসায় এদেশের পাবলিক সেক্টর বেশ আগ্রহী। মধ্যবিত্তদের সামর্থ্য বৃদ্ধিতে এবং চাহিদার প্রেক্ষিতে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ বিভিন্ন প্রজন্মের বেশকিছু এয়ারক্র্যাফট কিনেছে। তাছাড়া সময়ের সঙ্গে বাংলাদেশে বিমানযাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে।
কালের কণ্ঠ: বাংলাদেশের আপনাদের ক্রেতা কারা?
বাংলাদেশে রিজেন্ট এয়ারওয়েজ, ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স, নোভো এয়ার্স, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এবং বাংলাদেশ নেভি আমাদের ক্লায়েন্ট।
কালের কণ্ঠ: কয়টি দেশে কাজ করছে মানে সেবা দিয়ে যাচ্ছে আপনার প্রতিষ্ঠান?
বিশ্বজুড়ে বেশ কয়েকটি দেশে কাজ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশ তো আছেই, তার সঙ্গে আমেরিকা, নেপাল, ইন্ডিয়া, মরক্কো এবং মিশরে আমার ক্রেতা রয়েছে।
কালের কণ্ঠ: এ খাতে কত বছর ধরে আছেন? যুক্তরাষ্ট্রে বাস করে একজন বাংলাদেশি-আমেরিকান হিসেবে ব্যবসা এগিয়ে নেওয়ার পথে বাধাগুলোকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
লেখাপড়া করেছি অ্যাভিয়েশন নিয়ে। সবমিলিয়ে ১০ বছর ধরে কাজ করছি। বাংলাদেশি-আমেরিকান হিসেবে আমি উভয়পক্ষ থেকে বেশ সহাযোগিতা পাচ্ছি এখন। আমেরিকান হিসেবে আমি আন্তর্জাতিক মানের উৎসগুলো থেকে সহযোগিতা পাই। এ ক্ষেত্রে সরকার এবং বিভিন্ন কমিউনিটির বন্ধুত্ব পেয়েছি। আমি আমদানি এবং রপ্তানি দুটোই করতে পারি। আবার বাংলাদেশি হিসেবে এদেশের ক্রেতা ধরতে পারছি। এখানকার সাংস্কৃতিক এবং জাতিগত বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা রয়েছে আমার।
কালের কণ্ঠ: আজ থেকে ১০ বছর পর আপনি নিজের প্রতিষ্ঠানকে কোথায় দেখতে চান?
ইতোমধ্যে অ্যাভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিতে শীর্ষস্থানীয়দের মধ্যে পৌঁছাতে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। বছর দশেক পর স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার অ্যাভিয়েশনে আরো কিছু যোগ হবে। এর মধ্যে আছে এফএএ (ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন), ১৪৫ রিপেয়ার স্টেশন এবং যন্ত্রাংশ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান।
কালের কণ্ঠ: আপনার ব্যবসার মূল ভিত্তি কোন দেশে?
প্রাথমিকভাবে আমরা ইউএসএ-ভিত্তিক ব্যবসা করছি। তবে বিভিন্ন দেশে আমাদের এজেন্ট এবং কম্পানির কর্মীরা রয়েছেন।
কালের কণ্ঠ: ছেলেবেলার কথা বলুন। সেই সময়ে আপনার স্বপ্নের কথা বলুন।
সেই ৯ বছর বয়সে আমরা আমেরিকায় চলে আসি। তখনই আমি সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত সমস্যায় জড়িয়ে পড়ি। ছোটবেলা থেকেই অ্যাভিয়েশনের আধুনিকায়ন আমাকে বিস্মিত করতো। দৃষ্টিসীমায় কোনো বিমান উড়ে গেলেই আমি চোখ তুলে চাইতাম। ভাবতাম, এত বিশাল আর ভারী জিনিসটা কীভাবে মাটিতে না পড়ে উড়ে যেতে থাকে? বাংলাদেশে আসলেই, মনে পড়ে, বিমানবন্দরে বিমানগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। বিমানের ওঠা-নামা দেখতাম।
কালের কণ্ঠ: সেই সময় কোনো বাজে সময়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন?
প্রথমেই সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত সমস্যায় আক্রান্ত হই। নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেয়া কঠিন বিষয় ছিল। তবে ভাগ্যক্রমে আমেরিকায় আমি বড় একটা পরিবার পেয়েছিলাম। তাই দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমি শেষ তক তেমন কোনো সমস্যায় খুব বেশি পেরেশান হতে হয়নি।
কালের কণ্ঠ: আপনার বয়স কত? তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে অনুজদের জন্য আপনার পরামর্শ-
এখন আমার বয়স তিরিশ। সাতাশে ব্যবসা শুরু করি। অনুজদের প্রতি আমার পরামর্শ হলো, আপনারা উচ্চাকাঙ্ক্ষী হোন এবং স্বপ্ন পূরণে কঠোর পরিশ্রম করে যান।
কালের কণ্ঠ: আপনি কি মনে করেন যে আমাদের তরুণ প্রজন্ম একসময় ব্যবসা, বিজ্ঞান, আবিষ্কার, সংস্কৃতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশ্বে নেতৃত্ব দেবে?
বাংলাদেশিরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এটা হোক বিজ্ঞান বা চিকিৎসা কিংবা প্রযুক্তি। তবে সমাজের একজন সচেতন সদস্য হিসেবে তরুণ প্রজন্মকে যথাযথ শিক্ষা প্রদানে আমাদের সচেষ্ট থাকতে হবে।
কালের কণ্ঠ: আপনার কম্পানি, এর কর্মী এবং মোটো সম্পর্কে বলুন।
স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার অ্যাভিয়েশন ইউনাইটেড স্টেটস চেম্বার অব কমার্স এবং কলম্বাস চেম্বার অব কমার্সের সদস্য। দ্বিতীয়টিতে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে আমাদের। বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যিক এবং মিলিটারি খাতে বিমানের যন্ত্রাংশ সরবরাহের কাজ করি আমরা। বোয়িং, এয়ারবাস, বম্বার্ডিয়ার, এম্ব্রায়ের, এটিআরএস, অগাস্টা এবং বেল এর মতো বিভিন্ন ফ্লিটের জন্য বড় আকারের ওয়্যারহাউজ পরিচালনা করি আমরা। যন্ত্রাংশ এবং সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের যে কোনো বিষয়ে চব্বিশ ঘণ্টা সাপোর্ট দিয়ে থাকি আমরা। প্রকৌশলী ম্যানুয়েল এবং অন্যান্য কাজের বিষয়েও তাৎক্ষণিক সহযোগিতা দেই।
কালের কণ্ঠ: একদিন আপনি কী নিজেই বিমানের যন্ত্রাংশ নির্মাণের স্বপ্ন দেখেন?
অবশ্যই আমরা স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার অ্যাভিয়েশনকে এই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিতে চাই। এমনকি একটি এয়ারলাইনারও নামাতে চাই।
কালের কণ্ঠ: বাংলাদেশের অ্যারোনটিক্যাল স্কুলগুলো সম্পর্কে আপনার মতামত দিন, এরা কী মানসম্পন্ন?
আমি একটি স্কুলেই গিয়েছিলাম। ওটার নাম আরিরাং। সেখানে গিয়ে তাদের শিক্ষার গুণগত মান আমাকে মুগ্ধ করেছে। সেখানে আধুনিক ফ্লিট এবং যন্ত্রপাতি দেখার সুযোগ রয়েছে শিক্ষার্থীদের।
কালের কণ্ঠ: পেশাজীবনের অনুপ্রেরণাদায়ক কিছু স্মৃতির কথা বলুন।
আমি ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম অ্যাভিয়েশন সিস্টেমস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়তে। আমি বিমান চালনা বিষয়েও শিক্ষা নিয়েছি। উচ্চতাভীতি রয়েছে আমার। মনে আছে, বিমান চালনা বিষয়ক একটি ক্লাসে শিক্ষক আমাকে ইঞ্জিন ফেউলুওর বিষয়ে বলছিলেন। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে প্রশিক্ষক সেসনা বিমানের ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলেন। বিমানটি মাটির দিকে নামতে থাকলো। আমার মনে হলো এখানেই আমার জীবন শেষ হচ্ছে। পরক্ষণেই তিনি ইঞ্জিন চালু করলেন। এভাবে আমাকে এ ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সাহস দিলেন তিনি। এটা যথেষ্ট অনুপ্রেরণাদায়ক অভিজ্ঞতাই বটে।
কালের কণ্ঠ: আপনার পরিবার, জন্মস্থান, শিক্ষা আর বন্ধুদের নিয়ে বলুন।
আমার স্বপ্ন পূরণে পরিবার সবসময় সচেষ্ট ছিল। আমার জন্ম ঢাকায়। পরে আমেরিকা চলে যাই। সেখানেই পড়াশোনা করি। তবে আমি খুব ভাগ্যবান যে একই পেশাখাত থেকে আমি অনেক বন্ধু পেয়েছি। তারা সবাই যে কোনো সহায়তা করে থাকেন।
কালের কণ্ঠ: প্রবাসীদের মূলত কোন সমস্যাগুলো সমাধানে জোর দেয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন। কোনো অভিজ্ঞতা থাকলে দয়া করে শেয়ার করুন।
বিদেশের মাটিতে প্রবসীদের ঐক্যবদ্ধ থাকাটা খুব জরুরি। একের সাহায্যে অন্যকে এগিয়ে আসতে হবে। আমেরিকায় আমার দাদী মারা গেলে আমি কমিউনিটির গুরুত্ব খুব ভালো করে উপলব্ধি করি। গোটা পরিবার মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। কিন্তু তখন কমিউনিটি এগিয়ে আসে এবং কঠিন সময়ে তারাই পাশে থাকে।
কালের কণ্ঠ: আপনার দৃষ্টিতে বাংলাদেশিরা কোন গুণগুলো মৌলিকভাবে ধারণ করে, যা অন্যদের নেই?
ভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন মানুষের মাঝে নানা গুণ রয়েছে। বাংলাদেশিরা মূলত অনেক বেশি বিনয়ী, অতিথিপরায়ণ এবং আত্মত্যাগী।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: আহ্সান কবীর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন