পুষ্প শর্মা নামের একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিকের চালানো স্টিং অপারেশনের কারণে ভারতের মূলধারার বাঘা বাঘা সংবাদমাধ্যমের নিরপেক্ষতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। কয়েকমাস ধরে চালানো এই স্টিং অপারেশনে দেখা গেছে, দেশটির শীর্ষ ও প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমগুলো অর্থের বিনিময়ে ক্ষমতাসীন বিজেপির হিন্দুত্ববাদী আদর্শ প্রচারে রাজি হয়েছে। ২০১৯ সালের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপিকে ক্ষমতায় রাখার উদ্দেশ্যে মিডিয়াগুলো এ প্রস্তাবে রাজি হয়।
সংবাদমাধ্যমগুলোর মধ্যে রয়েছে—জি নিউজ, নেটওয়ার্ক ১৮, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, হিন্দুস্থান টাইমস, দৈনিক জাগরণ, এমটিভি নিউজ, ওপেন মিডিয়া, ভারত সমাচার, ইন্ডিয়া টুডে গ্রুপ, টাইমস অব ইন্ডিয়া এবং বেশ কয়েকটি পত্রিকা ও টেলিভিশনের মালিক-প্রতিষ্ঠান টাইমস গ্রুপসহ অন্তত ২৫টি প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম।
অনেক সময় কঠিন সত্য অনুসন্ধানে ছদ্মবেশ ধারণ করেন সাংবাদিকরা। ছদ্মবেশী সাংবাদিকদের চালানো বিভিন্ন অভিযানকে ‘স্টিং অপারেশন’ বলা হয়। যদিও এটি নিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক বিতর্ক আছে।
পুষ্প শর্মার কাছ থেকে স্টিং অপারেশনের ভিডিও ও প্রতিবেদনগুলো কিনে নেয় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাবিষয়ক ওয়েবসাইট কোবরাপোস্ট। এ ওয়েবসাইটটি ভারতের বিখ্যাত অনুসন্ধানী সাংবাদিক অনিরুদ্ধ বহালের মালিকানাধীন। কোবরাপোস্ট স্টিং অপারেশনের ৪৯টি ভিডিও প্রকাশ করেছে। ভিডিওগুলোতে দেখা গেছে, পুষ্প শর্মা সংবাদমাধ্যমের মালিকদের কাছে যেসব প্রস্তাব করেছেন, সেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই ভারতীয় দণ্ডবিধির লঙ্ঘন হলেও মালিকরা সেসব মেনে নেন। ভিডিওগুলো প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে এ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
পুষ্প শর্মা এর আগেও স্টিং অপারেশন চালিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন। এ দফায় ‘শ্রীমদভগবতগীতা প্রচার সমিতি’র আচার্য সেজে সংবাদমাধ্যমগুলোর কার্যালয়ে গিয়ে অর্থের বিনিময়ে হিন্দুত্ববাদী সংবাদ প্রচার ও বিরোধীপক্ষকে ঘায়েল করার প্রস্তাব দেন তিনি। নির্বাচনের মাঠকে সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ প্রচারের প্রস্তাবও দেন পুষ্প শর্মা।
শ্রীমদভগবতগীতা প্রচার সমিতিকে অনেকেই বিজেপির ভাতৃপ্রতিম সংঘঠন ‘আরএসএস’র ঘনিষ্ঠ বলে মনে করে। সংবাদমাধ্যম অনুসারে দেড় কোটি থেকে ৫০০ কোটি রুপি পর্যন্ত প্রস্তাব করেন ‘অটল’ ছদ্মনামে যাওয়া সাংবাদিক পুষ্ম শর্মা। কোবরাপোস্টের প্রকাশ করা ভিডিওগুলোতে দেখা গেছে, প্রায় সবাই পুষ্প শর্মার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেছেন। কিন্তু অর্থ লেনদেন বা আনুষ্ঠানিক চুক্তির কোনো ঘটনা ঘটেনি। ছদ্মবেশী এ সাংবাদিক শুধু অর্থের প্রলোভন দেখান, আর তাতেই ধরা পড়েন প্রভাবশারী মিডিয়ার মালিকেরা।
তবে কলকাতার দৈনিক বর্তমান ও সংবাদ এ প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে।
এ স্টিং অপারেশনটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন ১৩৬: পার্ট টু’। বিশ্বব্যাপী সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় ২০১৭ সালে ভারতের স্থান ছিল ১৩৬। তার সঙ্গে মিল রেখেই এ নামকরণ করেছে কোবরাপোস্ট।
ইন্ডিয়া টুডে গ্রুপের ভাইস প্রেসিডেন্ট কাল্লি পুরিকে বলতে শোনা যায়, যেকোনো ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচারে তারা কোনো বিষয়বস্তু নির্ধারণ করে দেন না।
অন্য আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, টাইমস গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক বিনীত জৈনকে নগদে ৫০০ কোটি রুপি দেওয়ার প্রস্তাব দেন পুষ্প শর্মা। তবে বিনীত জৈন এ অর্থ চেকের মাধ্যমে দেওয়ার অনুরোধ করে বলেন, ‘এ কাজ করতে আমাদের আপত্তি নেই। তবে জনগণের কাছে আমাদের নিরপেক্ষ ভাব ধরে রাখতে হবে।’
কোবরাপোস্টের প্রতিবেদন ও ভিডিওগুলো প্রকাশ হওয়ার পর প্রথমে ভারতের প্রভাবশালী মিডিয়াগুলো তেমন একটা পাত্তা দেয়নি। ‘দ্য ওয়্যার’, ‘দ্য স্ক্রল’-এর মতো ওয়েবসাইটে প্রথম এ খবরগুলো প্রকাশিত হতে থাকে। পরে ধীরে ধীরে টনক নড়তে শুরু করে স্টিং অপারেশনে নাম আসা মিডিয়াগুলোর। স্টিং অপারেশনে যেসব মিডিয়ার মুখোশ উন্মোচনের দাবি করেছে কোবরাপোস্ট, তারা পুষ্প শর্মার গোপনে ধারণ করা ভিডিওগুলোকে ভুয়া, অাংশিক সত্য বলে বর্ণনা করেছে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পুষ্প শর্মার ভিডিওগুলো মিথ্যা এবং এগুলোতে অন্যায় কোনো কাজের প্রমাণ নেই।’ এ ছাড়া টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে পুষ্প শর্মার ‘অতীত কর্মকাণ্ডের’ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, মিথ্যা সংবাদ ও মিথ্যা স্টিং অপারেশন চালানোর অভিযোগে এর আগে দুবার গ্রেফতার হয়েছিলেন পুষ্প শর্মা।
দৈনিক জাগরণ গ্রুপের প্রধান সঞ্জয় গুপ্তও ভিডিওগুলোকে ভুয়া হিসেবে বর্ণনা করেছে। আর পুষ্প শর্মার সঙ্গে বৈঠকের কথা স্বীকার করলেও তার প্রস্তাবে রাজি হওয়ার কথা অস্বীকার করেছে ইন্ডিয়া টিভির প্রধান বিপণন কর্মকর্তা সুদীপ্ত চৌধুরী। পুষ্প শর্মা ভারতের যেসব বড় বড় সংবাদমাধ্যমকে টার্গেট করেছেন, তাদের অধিকাংশই কয়েকদিন আগ পর্যন্ত স্টিং অপারেশনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু এ ভিডিওগুলো প্রকাশ হওয়ার পর তারাই এখন স্টিং অপারেশনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্টিং অপারেশন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এ ঘটনায় ভারতের সংবাদমাধ্যমের মুখোশ উন্মোচন হয়েছে। ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলো যে এখনো নির্বাচনে অন্যায় প্রভাব বিস্তারে সক্ষম, তা-ও এই ঘটনায় আবারও প্রমাণ হয়ে গেছে।
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন