অবতার কৃষাণ রায়না একজন হিন্দু পণ্ডিত। ১৯৯০ সালে ছেড়ে যাওয়ার পর নিজের জন্মস্থানে প্রথমবারের মতো ফিরেছেন এক ভিন্ন ধরনের শিল্প প্রদর্শনীতে। যে প্রদর্শনী হিন্দু ও মুসলিম শিল্পী ও ভাস্করদের এনে মিলিয়েছে এক জায়গায়।
রায়নার মতো আরো অন্তত দুই লাখ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে কাশ্মীরের এই অংশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় ৯০ দশকের শুরুর দিকে। সে সময় ভারতশাসিত অংশের বিরুদ্ধে সহিংস বিদ্রোহ শুরু করেছিল মুসলিম জঙ্গিদের একটি অংশ।
রায়না বলেন, সেসময় একদিন বাসায় এসে দেখতে পান যে বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গিরা তার বাসায় একটি পোস্টার সেঁটে দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, সে যেন তার কুকুরটিকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে যাতে তারা আশপাশে আসলে সেটি ডাকাডাকি করতে না পারে।
রায়না বুঝতে পেরেছিলেন যে সেই ভয়াবহ মাসটিতেই তাদেরকে হত্যা করা হবে- যেখানে অধিকাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বীই জন্মভূমি ছেড়ে চলে গেছে। এখন তিনি মধ্যপ্রদেশে একজন পেইন্টার হিসেবে কাজ করছেন।
কৃষাণ রায়না বলেন, 'আমি চলে যাওয়ার সময় কিছুই সঙ্গে করে নিয়ে যাইনি। আর এখানে ফিরে আসার কোনো ইচ্ছাই আমার আর কখনো ছিল না।' কিন্তু তিনি যখন প্রদর্শনীটিতে আসলেন তখন পুরনো একজন বন্ধু তাকে সাদরে স্বাগত জানান, বন্ধুটির নাম মোহাম্মদ আশরাফ।
আশরাফ একজন সাবেক আমলা, একটি পেইন্টিং সঙ্গে করে এনেছেন প্রদর্শনীতে। সেটি দেখিয়ে তিনি বলেন যে, এই ছবিটিই একমাত্র বস্তু যা তিনি ২০১৪ সালের বন্যার সময় রক্ষা করতে পেরেছিলেন।
আশরাফ ছবিটি দেখিয়ে রায়নাকে বলেন, 'মনে করে দেখতো, এই ছবিটি তুমিই ১৯৮৫ সালে এঁকেছিলে। আর বন্যার সময় কেবল এই পেইন্টিংটি নিয়েই বাসা ছেড়েছিলাম।'
রায়না যখন ছবিটি নিজের হাতে তুলে ধরেন তখন তার গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। আর এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে এমন একটি পুর্নমিলনই আশা করেছিলেন এর আয়োজকরা।
'শিল্প হলো কঠিন কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা আর কথোপকথন,' এমনটাই বলছিলেন কাশ্মীরি আর্ট প্রোমোটার মুজতবা রিজভী। যিনি সমকালীন আরেক শিল্পী ভীর মুনশীকে সঙ্গে নিয়ে এই আয়োজনের উদ্যোগ নেন। তিনি বলেন, 'অনেক বাধা এবং ভুল ধারণা আজ সরে গেছে। আসলে শিল্প হলো সামাজিক মধ্যবর্তিতার এক মাধ্যম।'
রাজ্যটির রাজধানী শ্রী নগরে একটি শতবর্ষী পুরোনো সিল্ক কারখানার দালানে হচ্ছে সাত দিনের এই প্রদর্শনীটি। একজন কাশ্মীরি হিন্দু শিল্প বোদ্ধা এবং ইতিহাসবিদ রতন পারিমু বলেন, 'একমাত্র শিল্পেরই সেই শক্তি রয়েছে যা দিয়ে দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে সংযোগ ঘটাতে পারে।'
অস্থায়ী গ্যালারিটি পূর্ণ হয়েছে বহু শিল্পকর্মে যার বেশিরভাগই প্রকাশ করছে অঞ্চলটি ঘিরে ঘটে চলা দ্বন্দ্বের গভীরতাকে।
শিল্পী চুষল মাহলাদার একটি আত্মপ্রতিকৃতি সেখানে প্রদর্শিত হচ্ছে। যার শিরোনাম দেয়া হয়েছে 'কষ্টের হাসি'। আর ছবিটিতে দেখা যায় একজন কাশ্মীরি হিন্দু পুরুষের অনাবৃত দেহকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে রেখেছে কাঁটাতার। তার মাঝেও মাথা উঁচু করে মানুষটির মুখে রয়েছে স্মিত হাসি।
শিল্পী তার ছবিটির বর্ণনায় বলেন, 'এটিই একজন সাধারণ কাশ্মীরবাসীর জীবনের বহিঃপ্রকাশ, তা সে হিন্দু বা মুসলিম যেই হোন না কেন।'
সেখানে কিছু ঘূর্ণায়মান যন্ত্র দিয়ে একটি ইন্সটলেশন তৈরি করা হয়েছে যা ভীর মুনসীর ভাষায় সংঘাতের মধ্যকার মানুষের কষ্টকে ফুটিয়ে তুলেছে। মি. মুনশিও একজন জন্মস্থান-ত্যাগী হিন্দু।
প্রদর্শনী স্থলের ঠিক মাঝামাঝি রাখা হয়েছে একটি দৃশ্যকল্প। যে ইন্সটলেশনে দেখা যায় একটি নৌকাকে উল্টো করে রাখা। মুনশি বলেন, 'একটি নৌকার উল্টো পিঠটি দেখা আসলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যবেক্ষণ, কেননা এটি সবসময় পানির নিচেই থাকে।'
একদম ঢোকার মুখে রয়েছে ৩০ ফুট দীর্ঘ একটি চিত্রকর্ম। শিল্পী মামুন আহমাদ একজন কাশ্মীরি মুসলিম। ইঙ্ক ড্রয়িং-এ তিনি এঁকেছেন এমন একটি অরণ্যের ছবি যেখানে বৃক্ষ আর অস্থি পাশাপাশি অবস্থান- যেমনটি মনে করিয়ে দেয় মৃত্যুর মধ্যে থাকা জীবনের।
'রুভেদা' একটি উর্দু শব্দ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই দীর্ঘ পেইন্টিংটি আঁকা হয়েছে, যার অর্থ 'ধীরে হেঁটে যাওয়া।'
শিল্পী কাশ্মীরে চলমান হিন্দু মুসলিম সংঘাতের গল্প বলার মধ্যদিয়েই জানালেন যে, এর মাঝ দিয়েই ধীরে হেঁটে গিয়ে দুইটি সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্য ঘুচিয়ে দেব।
প্রদর্শনীটি এমন একটি সময়ে চলছে যখন ভারতের শাসকদল বিজেপি এবং আঞ্চলিক পিডিপি'র ক্ষমতাসীন জোট সরকারের পতনে অঞ্চলটিতে চলছে একটি রাজনৈতিক সংকট। কিন্তু এমন সময়ও প্রদর্শনী দেখতে ভিড় করছেন শতাধিক দর্শনার্থী।
স্থানীয় একটি কলেজের শিক্ষার্থী সাইবার খান বললেন, 'এটি হৃদয়কে নাড়া দেয়, কিন্তু সেইসঙ্গে এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার জন্ম হয়।' তিনি জানান, তিনি কখনো একজন হিন্দু পণ্ডিতকে দেখেননি তার সম্প্রদায়ের বাইরে এসে এভাবে একা কাজ করছেন।
তার মতে, 'এইসব শিল্পীদের কাজ, তাদের পেইন্টিং, ইন্সটলেশন- সবমিলিয়েই প্রদর্শনীটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পেয়েছে।'
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন