আন্দোলনে যাবেন ব্যবসায়ীরা দমনের ঘোষণা অর্থমন্ত্রীর
বহুল আলোচিত নতুন ভ্যাট আইন ইস্যুতে অর্থমন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের চলমান বিরোধ এবার প্রকাশ্যে রূপ নিল। গতকাল রবিবার রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের আলোচনা সভায় এ ইস্যুতে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যবসায়ী নেতাদের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। পরবর্তী সময়ে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য শেষে ফের বাহাস হয় এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান ও এফবিসিসিআইয়ের সহ-সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিনের মধ্যে। এমন আলোচনার মধ্যেই ব্যবসায়ীদের একটি অংশ ক্ষোভ প্রকাশ করে সভাস্থল ত্যাগ করেন।
আগামী ২ জুন সরকার নতুন অর্থবছরের বাজেট পেশ করতে যাচ্ছে। আর জুলাই থেকে কার্যকর হতে যাচ্ছে নতুন ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আইন। আইনটি ২০১২ সালে পাশ হলেও শুরু থেকেই কয়েকটি বিষয়ে ব্যবসায়ীদের তীব্র আপত্তি রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রথা অনুযায়ী গতকাল এনবিআর ও এফবিসিসিআইয়ের মধ্যে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাজেটপূর্ব পরামর্শক কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ভ্যাট ইস্যুটি আলোচনার কেন্দ্রে আসবে বলে আগে থেকেই আঁচ করা গিয়েছিল।
আলোচনাকালে এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক ও ব্যবসায়ী ঐক্য ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আবু মোতালেব তাদের কয়েকটি দাবি তুলে ফের ব্যবসায়ীরা রাজপথে আন্দোলনের নামবে বলে হুমকি দেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এনবিআরের সঙ্গে পরামর্শ করেই যাচ্ছি। কিন্তু যেদিন বাজেট হবে, সেদিন হতাশ হয়ে ফিরে যাবো।’ প্যাকেজ পদ্ধতির ভ্যাট বহাল রাখা ও বার্ষিক ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত টার্নওভার (বার্ষিক বিক্রি) ভ্যাটমুক্ত রাখার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, এর উপরে টার্নওভার হলে তিন শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা যেতে পারে। নইলে দেশীয় শিল্প টিকতে পারবে না। এ সময় নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে এনবিআরের প্রশিক্ষণে অনিয়মের অভিযোগ তোলেন তিনি। পাদুকাসহ কয়েকটি খাতকে ভ্যাটমুক্ত রাখার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভ্যাট নিয়ে এফবিসিসিআই যে প্রস্তাব দিয়েছে তা আশা করি মেনে নেবেন। নইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মত রাজপথে নামতে বাধ্য হবো। ব্যবসায়ীরা রাজপথে নামলে আপনারাও সমস্যায় পড়বেন, আমরাও সমস্যায় আছি।’
এ পরিস্থিতিতে তাকে থামিয়ে দিয়ে বক্তব্য শুরু করেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আপনারা কয়জন ভ্যাট দেন? আপনার (আবু মোতালেব) সংগঠনের কতজন ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী ভ্যাট দেন? খামাখা আন্দোলন করছেন। আন্দোলন করে কিছুই করতে পারবেন না। আন্দোলনে নামলে কঠোরভাবে দমন করা হবে। আট লাখ নিবন্ধিত ব্যবসায়ীর মধ্যে ৩০ হাজার ভ্যাট দেন।’
অর্থমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের প্রতিবাদে সভাস্থলে হট্টগোল শুরু করেন উপস্থিত ব্যবসায়ীরা। অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে তারা বলতে থাকেন, ‘আন্দোলন দমনের হুমকি দেবেন না।’ কেউ কেউ বলতে থাকেন, ‘আপনি (অর্থমন্ত্রী) কত টাকা ভ্যাট-টাক্স দেন?’
এ পর্যায়ে এফবিসিসিআইর সিনিয়র সহসভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ব্যবসায়ীদের শান্ত হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাজেট এখনো হয়নি। আশা করি আমাদের দাবি মেনে নেবে সরকার। বর্তমান সরকার জনগণের সরকার। নিশ্চয়ই জনগণের কথা শুনবেন। এরপর ব্যবসায়ীরা শান্ত হন।
তবে বক্তব্য প্রদানকালে অর্থমন্ত্রী ফের ইস্যুটি সামনে আনেন। তিনি বলেন, ‘আবু মোতালেব হুমকি দিয়েছেন। সব বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলেছেন। তার এ বক্তব্য পছন্দ হয়নি। এটি আলোচনা নয়, যুদ্ধের বক্তব্য। এ ধরণের হুমকি দেওয়া অন্যায়। তার এ বক্তব্য প্রত্যাহার করা উচিত।’ বক্তব্য শেষে অন্য একটি সভায় যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে সভাস্থল ত্যাগ করেন অর্থমন্ত্রী।
এরপর বক্তব্য দিতে গিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘এ ধরণের সভায় আন্দোলনের হুমকি দেবেন না। এ ধরণের ফোরামের আলাদা একটি ভাষা আছে। গায়ের জোরে কাজ হয় নাকি? কে কী করেন সব জানা আছে। সবার নাড়ি-নক্ষত্র আমাদের হাতে আছে। অনেক তথ্য আছে। এজেন্সির কাছ থেকে নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ করি।’
এর পর বক্তব্য দিতে গিয়ে সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘মতপার্থক্য থাকতেই পারে। ব্যবসায়ীদের কাজ রাস্তায় মানববন্ধন বা আন্দোলন করা নয়। কিন্তু আপনি (নজিবুর রহমান) ব্যবসায়ীদের পরোক্ষ হুমকি দিয়েছেন। উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়া ঠিক নয়। এজেন্সি আমাদের সকলের।’ এ সময় এনবিআরের একটি বিজ্ঞাপনের বিষয়েও আপত্তি তুলে মহিউদ্দিন বলেন, ‘সব মিষ্টির দোকানদারকে অপরাধী হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে। এটি উস্কানিমূলক। এনবিআরের অংশীদারিত্ব দৃশ্যমান দেখতে চাই। ব্যবসায়ীদের প্রতিপক্ষ ভাবার কারণ নেই।’ বক্তব্য শেষে পুরো পরিস্থিতিতে কোন ভুল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার আহ্বান জানান তিনি।
এর আগে বক্তব্য প্রদানকালে এফবিসিসিআই সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমাদ সংগঠনটির প্রস্তাব অনুযায়ী ভ্যাট আইন সংশোধনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমরা নতুন ভ্যাট আইনের বিপক্ষে নই। কিন্তু ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী নতুন ভ্যাট আইন সংশোধন করা না হলে তা বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে যাবে বলে মনে করি। আইনটি পর্যালোচনায় গঠিত কমিটির সাত দফা সুপারিশ ও ওয়ার্কিং কমিটির যৌথ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়ায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। এ সময় তিনি ১৫ শতাংশের পরিবর্তে হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট আরোপ করাসহ আয়কর ও শুল্ক বিষয়ে বেশকিছু প্রস্তাব তুলে ধরেন।
এ সময় শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা ছাড়াও অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
২০১২ সালে সরকার নতুন ভ্যাট আইনটি পাশ করে। নতুন আইনে সব ধরণের পণ্য ও সেবার উপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে সঙ্কুচিত ভিত্তিমূল্যে ভ্যাট দেওয়ার ব্যবস্থা। এছাড়া তুলনামূলক ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য প্যাকেজ পদ্ধতির ভ্যাট (বার্ষিক এককালীন নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ) ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এনবিআর কর্মকর্তাদের হাতে দেওয়া হয় ব্যবসায়ীদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার ক্ষমতাও। এ রকম আরো বেশকিছু ছোট-বড় ইস্যুতে ব্যবসায়ীদের আপত্তি রয়েছে। ফলে তিন বছর পর ২০১৫ সাল থেকে আইনটি বাস্তবায়ন করার কথা থাকলেও কার্যত তা করা যায়নি। ইতিমধ্যে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনাও চলতে থাকে। ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে সরকার আইনটি পর্যালোচনার লক্ষ্যে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি ১৫ শতাংশের পরিবর্তে হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট আরোপসহ সাতটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ দেয়। কিন্তু দৃশ্যত ওই সুপারিশ উপেক্ষা করে আগামী জুলাই থেকে আইনটি কার্যকর করতে যাচ্ছে সরকার। ফলে ব্যবসায়ীদের দাবি উপেক্ষিতই থাকছে বলে মনে করছেন তারা।
এছাড়া নতুন আইনটি বাস্তবায়নের আগেই বিদ্যুত্সহ অনেক খাতেই পণ্যমূল্য বাড়তে পারে বলে ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন। ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তদুপরি, ভ্যাটের মূলনীতি হচ্ছে মূল্য সংযোজনের ওপর হিসাব করা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মোট টাকার উপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়। এতে খুচরা পর্যায়ে পণ্যমূল্য বেড়ে যায় এবং সীমিত আয়ের ভোক্তার উপর চাপ পড়ে।
কোম্পানির কর কমনোর ইঙ্গিত অর্থমন্ত্রীর
আলোচনাকালে কোম্পানির কর্পোরেট করহার পরিবর্তন করার কথা চিন্তা করছেন বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, মোবাইল ফোন কোম্পানির কেউ কেউ ৪৫ শতাংশ বা সাড়ে ৪২ শতাংশ কর দেয়, সেটি যৌক্তিক করার কথা চিন্তা করছি। আবার শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কিছু কোম্পানির ক্ষেত্রে সাড়ে ২৭ শতাংশ করহার রয়েছে। তাদেরকে এ সুবিধা দিয়ে রেখেছি। এসব বিষয়েও পরিবর্তনের চিন্তা রয়েছে। তিনি বলেন, বাজেটে আমাদের প্রস্তাব হবে, কর্পোরেট করকে পুনর্বিবেচনা করা। এছাড়া মোবাইল সেবার ক্ষেত্রে তরঙ্গ ফি’র ভ্যাট নেওয়া উচিত কিনা - বিবেচনা করব। এ সময় টেলিকম অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটবের মহাসচিবের বক্তব্যের সূত্র ধরে অর্থমন্ত্রী বলেন, অর্থনীতিতে সবাই অবদান রাখছে। তাই বলে তো সবাইকে করমুক্ত করে দেওয়া যায় না।
এছাড়া ব্যক্তি শ্রেণীর করমুক্ত আয়সীমা এবার পরিবর্তন করে কয়েক বছরের জন্য স্থায়ী করে দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি। নতুন ভ্যাট আইনে সম্পূরক শুল্ক ব্যবস্থা উঠে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেশীয় শিল্পের সুরক্ষার বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছে উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, নতুন ভ্যাট আইনে দেশীয় শিল্প কীভাবে রক্ষা করা যায়, দেখব।
তামাকের কর হার বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, দেশ থেকে বিড়ি বিদায় হওয়া দরকার।
ইত্তেফাক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন