ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নানা হুমকি-ধমকি এবং ঢাকা সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থার সাজসাজ তদারকি প্রস্তুতির পরও বরাবরের মতো এবারও রমজানের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। রোজার মাসে অধিক ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নিত্যপণ্যের দামও। রোজার প্রথমদিন রোববার নতুন করে আরও চার পণ্যের দাম বেড়েছে। নিয়ন্ত্রণে নেই গরু-খাসির মাংস, এমনকি ব্রয়লার মুরগিতেও।
ভোক্তাদের অভিযোগ রমজান এলেই ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিকভাবে বেশি মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে বাজারকে অস্থির করে তোলেন। সরকারের বাজার মনিটরিংয়ের অভাবেই বাজার অস্থির হয়ে উঠছে বলেও তারা অভিযোগ করেন।
বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) সর্বশেষ হিসেবে দেখা গেছে, চার পণ্যের মধ্যে রসুনের দাম ২৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৩০০ থেকে ৩২০ টাকায়, ব্রয়লার মুরগি ১৫০ টাকা থেকে বেড়ে ১৬০ টাকায়, চিনি ৭০ টাকা থেকে বেড়ে ৭৫ টাকায় এবং ৮৫ টাকা থেকে ৯০ টাকার ছোলা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। টিসিবির তালিকায় নেই এমন পণ্য বেগুনের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫-১০ টাকা।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, যারা বাজারে অস্বাভাবিক দাম বাড়ায় তাদের ব্যাপারে সরকার চাইলে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। প্রয়োজনে সরকার বাজার মনিটরিং করতে পারে। তাহলে আসল তথ্য জানা যাবে। রমজান উপলক্ষে প্রায় সব জিনিসের দাম বেড়েছে। চালের দাম বাড়ানোর কোনো কারণ এখন নেই। দিন দিন মানুষ নিজের পরিবার চালাতে হাঁপিয়ে উঠছেন। এ বিষয়ে সরকারের নজর দেয়া দরকার।
তবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, দাম বাড়ার 'অভিযোগটি অসত্য।'
সরকারের মনিটরিং রয়েছে বলেই রমজানের আগের দিনও বাজার স্থিতিশীল রয়েছে। সব পণ্যের দামই ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতার নাগালে। তবে ক্রেতাদের সমালোচনা করে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, 'রমজান এলেই অনেকে সব ধরনের পণ্য বেশি বেশি কিনে মজুদ করে রাখেন। যার কোনো প্রয়োজন নেই।' ১০ রোজার পর সব পণ্যের দাম এমনিতেই কমে যাবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের অন্যতম একটি বড় মুদির দোকান লক্ষ্মীপুর স্টোর। এর মালিক হুমায়ুন কবির। তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, চিনির দাম বাড়তি। খোলা চিনি প্রতি কেজি ৭৪ থেকে ৭৫ টাকা। আর প্যাকেট চিনি ৭৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মিরপুর এক নাম্বার বাজারে এসেছিলেন বেসরকারি একটি মুঠোফোন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হামিম আহমেদ। বাজারের কী অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'কোনো কারণ ছাড়াই তো চিনির দাম দফায় দফায় বাড়ছে। রোজা এলে দাম বাড়বে, এটা বোধ হয় আমাদের নিয়তি হয়ে গেছে।'
ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সপ্তাহ দুয়েক আগেও রাজধানীর খোলাবাজারে ৬৫ টাকা কেজিতে চিনি বিক্রি হয়েছে। এখন সেই চিনি ৭৫ টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির প্যাকেট চিনি গত সপ্তাহে ৭০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন ৭৩ টাকা। বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) সর্বশেষ তালিকায় চিনির দাম দেখানো হয়েছে ৭৫ টাকা। আর এক মাস আগে এই দাম ৬২ থেকে ৬৪ টাকা।
নিত্যপণ্য ছাড়াও ইফতারির প্রধান দুই উপকরণ মুড়ি ও খেজুরের বাজারেও বেশ ভিড়। কারওয়ান বাজারে খেজুর বিক্রেতা হাবিব উল্লাহ জানান, রোজার সময় অনেক রকমের খেজুর পাওয়া যায়। বাজারে এখন মরিয়ম, তিউনিশিয়া, দামাস, বাংলাসহ নানা ধরনের খেজুর আছে। ১০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত এসব খেজুরের কেজি। গত বছরের চেয়ে এবার এসব খেজুর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ।
রোজায় বেড়েছে মুড়ির দামও। মিরপুর এক নাম্বারে নোয়াখালী দধি স্টোরে মুড়ি, দই, গুড়সহ নানা পণ্য বিক্রি হয়। দোকানদার নুর হোসেন জানান, মুড়ির দাম বেড়েছে। গত সপ্তাহে যে মুড়ির কেজি ৭০ টাকা ছিল, এখন সেটি ৮০ টাকা।
কেবল মিরপুর নয়, হাতিরপুলের ভাই ভাই স্টোরের বিক্রেতা রাশেদুল আলম জানান, বুট, মুড়ি, ছোলা, ডাল, বেসনএগুলোই বেশি বিক্রি করছেন। চিনির দাম একটু বেশি। পেঁয়াজের দাম আগের মতো থাকলেও রসুনের দাম একটু বেশি।
সবজি, মাছের দাম মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও গরুর মাংসের দাম বেড়েছে বলে জানালেন ক্রেতারা। তুহিন রহমান নামের একজন ক্রেতা জানান, গরুর মাংসের দাম ৪৭৫ টাকা নির্ধারণ করা হলেও হাতিরপুল বাজারে ৫২০ টাকা করে কেজি কিনতে হয়েছে।
সরকারি চাকরিজীবী কবির আহমেদ জানান, তিন দিন আগে যে রসুন ২৩০ টাকা কেজি ছিল, আমদানি করা সেই রসুনের কেজি এখন ২৭০ টাকা। দাম বেড়েছে ছোলারও। আগে যে ছোলার কেজি ৮০ টাকা ছিল, এখন তার দাম ৮৫ থেকে ৯০ টাকা। টিসিবির তালিকায় দেখা গেল, এক সপ্তাহ আগে যেখানে আমদানি করা রসুনের দাম ২০০ থেকে ২২০ টাকা ছিল, এখন সেই রসুনের দাম ২৫০ থেকে ২৭০ টাকা। আর ছোলার দাম যেখানে এক মাস আগে ৮০ থেকে ৯০ টাকা ছিল, এখন সেই দাম ৮৫ থেকে ৯৫ টাকা।
একই সঙ্গে রাজধানীর বাজারগুলোয় ব্রয়লার মুরগি ও মাছের দাম বেড়েছে। ব্রয়লা ও লেয়ার মুরগির দাম বেড়েছে কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা। ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকা, লেয়ার ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকা দরে। গত সপ্তাহে যা ছিল যথাক্রমে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা ও ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকা।
রাজধানীর সবজির বাজারেও চলছে চড়া দাম। ৪০ টাকা কেজি দরের নিচে মিলছে না কোনো সবজি। রমজানে সবচেয়ে বেশি চাহিদা কাঁচা মরিচের। সেই চাহিদার কারণে প্রতি বছরই বেড়ে যায় দাম। তবে এ বছরের চিত্র এখনও অনেকটাই ভিন্ন। এখন পর্যন্ত কাঁচা মরিচ ৬০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে বাজারে নতুন সবজি পুরোপুরি আসেনি। যদিও রাজধানীতে গত ৩ মাসের বেশি সময় ধরে ধুন্দুল, করলা, বেগুন, পটল, ঝিঙা, বরবটি, ঢেঁড়স, টমেটোসহ প্রায় সব সবজির দাম ৪০ টাকার ওপরে রয়েছে।
রোজার আগে ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি হওয়া বেগুন গতকাল ৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। চলতি সপ্তাহে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে ধুন্দুল, ঝিঙা, করলা ৫০ টাকা, টমেটো ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, শসা ৪০ থেকে ৫০ টাকা, বরবটি ৬০ টাকা, কচুর লতি ৪০ থেকে ৪৫ টাকা, ঢেঁড়স ৪০ থেকে ৫০ টাকা, আর ডাঁটা (মাঝারি) ২০ টাকা আঁটি।
তবে অনেকটাই স্থিতিশীল রয়েছে তেল, আটা, পেঁয়াজ, রসুন ও আলুর দাম। রোববার দুপুরে রাজধানীর কাওরান বাজারের কিচেন মার্কেটে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৫ লিটারের বোতলজাত তেল বিক্রি হচ্ছে ৪৯০ টাকা থেকে ৫১৫ টাকায়। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৮৫ থেকে ৯০ টাকায়। এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিল তেল বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ টাকায়। প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা, দেশি পেঁয়াজ ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়, খোলা আটা বিক্রি হচ্ছে ২৩ থেকে ২৫ টাকা কেজি দরে।
রাজধানীর বাজারগুলোয় মাছের মধ্যে নানা সাইজের ইলিশ প্রতি পিস ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। রুই ২৫০ থেকে ৪০০ টাকা, কাতল ২৮০-৪০০ টাকা, চাষের শিং ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, চাষের মাগুর ৫০০ টাকা, চাষের পাবদা ৬৫০ টাকা, কাঁচকি ৪০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
জানতে চাইলে কনজ্যুমার অ্যাসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবীর যায়যায়দিনকে বলেন, 'প্রতি বছর রমজান এলেই ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিকভাবে মুনাফা লাভের আশায় বাজারকে অস্থির করে তোলেন। এ বছরও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এ জন্য সরকারের জোরালো মনিটরিং দরকার।'
রমজান মাসে সবকিছুর দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা হবে, সরকার প্রতি বছর এমন কথা বললেও শেষপর্যন্ত দেখা যায় কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কেন এই পরিস্থিতি, জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অভিযোগ কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক মো. মাসুম আরেফিন যায়যায়দিনকে বলেন, 'রোজায় যেন পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে, সে জন্য বাণিজ্যমন্ত্রী কয়েকবার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তাদের দুটি টিম শুক্রবারও বাজার তদারক করেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ টিমও আছে। তারা বাজারের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কাজ করছেন।'
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন