একক ব্যাংক হিসেবে সর্বোচ্চ গ্রাহক সোনালী ব্যাংকের। প্রায় দেড় কোটি গ্রাহককে ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি। রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তি থেকে শুরু করে সচিব ও প্রায় সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরই বেতন পরিশোধ হয় এ ব্যাংকের মাধ্যমে। যদিও ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের কাঙ্ক্ষিত ছোঁয়া লাগেনি রাষ্ট্রায়ত্ত সবচেয়ে বড় এ ব্যাংকটিতে। একই অবস্থা রাষ্ট্রায়ত্ত অন্যান্য ব্যাংকেরও। ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মতো আধুনিক সেবাগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এসব ব্যাংকের গ্রাহকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশের ক্রেডিট কার্ডের মাত্র শূন্য দশমিক ৩২ শতাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর। ডেবিট কার্ডের ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ইন্টারনেট ব্যাংকিং শূন্য।
যদিও বিস্তৃত নেটওয়ার্ক ও জনবল নিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো গ্রাহক আস্থার প্রতীক হতে পারত বলে মনে করেন ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, প্রি-পেইড কার্ড, ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মতো ব্যাংকিং সেবাগুলো বর্তমান সময়ে ব্যাংকিং সেবার প্রধান অনুষঙ্গ। সদিচ্ছা ও দক্ষ জনবলের অভাবে চেকনির্ভর ব্যাংকিং কার্যক্রমেই সীমিত রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সেবা। অথচ দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রায় ৩০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে চলতি দায়িত্ব পালন করছেন ব্যাংকটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তরিকুল ইসলাম চৌধুরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, সোনালী ব্যাংকের শাখাগুলো কোর ব্যাংকিং সলিউশনের (সিবিএস) আওতায় ছিল না। দক্ষ জনবলের সংকট ও যথোপযুক্ত সক্ষমতার অভাবে ব্যাংকের গ্রাহকদের এখনো পুরোপুরি আধুনিক ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। কয়েক বছর ধরে ব্যাংকের আইটি খাতের সিংহভাগ বিনিয়োগ সিবিএসের পেছনে ব্যয় করা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ সিবিএস কার্যক্রম শেষে সোনালী ব্যাংক আধুনিক গ্রাহকসেবায় মনোযোগ দেবে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংকই এখন পর্যন্ত ক্রেডিট কার্ড ও ডেবিট কার্ড সেবায় এগিয়ে রয়েছে।
বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড সেবা। চলতি বছরের জুলাই শেষে দেশে ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৪৩ হাজার ২১৫। এর মধ্যে ৯ লাখ ৪০ হাজার ১৯০টিই দেশের বেসরকারি ও বিদেশী ব্যাংকগুলোর। রাষ্ট্রায়ত্ত আটটি বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের মধ্যে কেবল সোনালী ও জনতা ব্যাংকের গ্রাহকরা ক্রেডিট কার্ড সেবা পেলেও তা খুবই সীমিত পরিসরে। এ দুটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা মাত্র ৩ হাজার ২৫টি। সে হিসাবে দেশের ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকদের মাত্র শূন্য দশমিক ৩২ শতাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর। গত জুলাইয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে মাত্র চার কোটি টাকা। অথচ ওই মাসে ক্রেডিট কার্ডে মোট লেনদেন ছিল ৮৮৭ কোটি টাকা।
ব্যাংকিং সেবার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান ডেবিট কার্ড। জুলাই শেষে দেশে ডেবিট কার্ডের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৯ লাখ ৮৬ হাজার ৪৭৭। এর মধ্যে ১ কোটি ৮ লাখ ১৭ হাজার ৭২২টি ডেবিট কার্ডই দেশের বেসরকারি ও বিদেশী ব্যাংকগুলোর। রাষ্ট্রায়ত্ত আট ব্যাংকের ডেবিট কার্ড রয়েছে মাত্র ১ লাখ ৬৮ হাজার ৭৫৫টি। এ হিসাবে দেশের ব্যাংকিং খাতে ডেবিট কার্ড সেবার মাত্র ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর।
কার্ড সংখ্যায় পিছিয়ে থাকায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর গ্রাহকরা ডেবিট কার্ড ব্যবহারেও পিছিয়ে রয়েছে। গত জুনে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ডেবিট কার্ড গ্রাহকরা এটিএম বুথ, পিওএস মেশিন ও ই-কমার্সের মাধ্যমে মাত্র ৯৯ কোটি টাকা লেনদেন করেছেন। অথচ ওই মাসে দেশের ব্যাংকগুলোর ডেবিট কার্ডে মোট লেনদেন ছিল ৮ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা। সে হিসাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে মোট লেনদেনের মাত্র ১ শতাংশ।
অনেক আগে ডেবিট কার্ড সেবা চালু করলেও এত দিন ব্র্যাক ব্যাংকের এটিএম বুথ ব্যবহার করত রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক। এতে নানা জটিলতা দেখা দেয়ায় সম্প্রতি নিজস্ব এটিএম বুথ চালু করেছে ব্যাংকটি। রাজধানীর হাটখোলায় রূপালী ব্যাংকের একমাত্র এটিএম বুথটি চালু করা হয়েছে।
ঘরে বসেই লেনদেনের জন্য বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবা। জুলাই শেষে দেশের ব্যাংকগুলোর ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবা নিচ্ছে ১৬ লাখ ৩৭ হাজার ১৪৩ জন গ্রাহক। এর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর গ্রাহক রয়েছে ১৪ লাখ ৮৭ হাজার ৯৪৯ জন। বাকি ১ লাখ ৪৯ হাজার ১৯৪ গ্রাহকই বিদেশী ব্যাংকগুলোর। ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত আটটি ব্যাংকের কোনো অংশগ্রহণই নেই।
রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতাউর রহমান প্রধান বলেন, এত দিন ব্যাংকের সব শাখাকে ইন্টারনেটের আওতায় এনে সিবিএস বাস্তবায়নে মনোযোগ ছিল ব্যাংকটির। এখন সিবিএসের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন শেষে গ্রাহকদের আধুনিক ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনার কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। চলতি বছরই নিজস্ব ১০টি এটিএম বুথ চালু করা হবে। আগামী বছরের মধ্যে দেশের সব জেলা শহরে এটিএম বুথ স্থাপন করা হবে। দেশের যেকোনো ব্যাংকের গ্রাহকরা বিনা খরচে রূপালী ব্যাংকের এটিএম বুথ ব্যবহার করতে পারবেন।
দেশের ব্যাংকগুলোর প্রি-পেইড কার্ড গ্রাহক রয়েছে ২ লাখ ৮ হাজার ৪২২ জন। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর প্রি-পেইড কার্ড গ্রাহকের সংখ্যা মাত্র ৩ হাজার ৩০৬, যা এ সেবার মোট গ্রাহকের মাত্র ১ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
ধীরে হলেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের আধুনিক ব্যাংকিং সেবা দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানান অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শামস-উল-ইসলাম। তিনি বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো এখনো পুরোপুরি সিবিএস বাস্তবায়ন করতে পারেনি। বিদ্যুত্ পৌঁছায়নি এমন এলাকায়ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অনেক শাখা রয়েছে। শহরের মানুষ বেসরকারি ব্যাংকনির্ভর হওয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অধিকাংশ গ্রাহকই গ্রামীণ এলাকায়। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের মতো আধুনিক ব্যাংকিং সেবার চাহিদাও কম। তিনি বলেন, আর্থিক ও দক্ষ জনবল সংকটের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় প্রযুক্তির ছোঁয়া কম লেগেছে। তবে পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন