পদত্যাগের পর অন্তরালে চলে যান আলোচিত বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির হোতা আবদুল হাই বাচ্চু। সপরিবারে কখনো নিউইয়র্ক, কখনো লন্ডন, কখনো আবার রোমে অবস্থান করেন। দীর্ঘ সময় বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেসিক ব্যাংকের সাবেক এ চেয়ারম্যান এখন ঢাকাতেই থাকছেন বলে তার ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। তবে কেউই নাম প্রকাশ করেনি। এক সপ্তাহ ধরে বণিক বার্তার পক্ষ থেকে চেষ্টা করেও আবদুল হাই বাচ্চুর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান আবদুল হাই বাচ্চু। ব্যাংকটিতে নজিরবিহীন লুটপাটও শুরু ওই সময় থেকেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষায় মাত্র পাঁচ বছরেই ব্যাংকটি থেকে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা ধরা পড়ে। তার সময় বিতরণ করা অন্য ঋণও পরে খেলাপি হয়ে পড়ে। বর্তমানে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। এসব খেলাপি ঋণের অনেক গ্রাহককেই এখন খুঁজে পাচ্ছে না বেসিক ব্যাংক।
এসব অনিয়ম নিয়ে ব্যাপক আলোচনার পর ২০১৪ সালের ৪ জুলাই চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন আবদুল হাই বাচ্চু। তার পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বেসিক ব্যাংক থেকে পদত্যাগের পর আবদুল হাই বাচ্চু দেশ ছাড়েন। দীর্ঘ সময় তিনি নিউইয়র্ক ও লন্ডনে সপরিবারে বসবাস করে আসছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে প্রায়ই দেশে আসছেন তিনি। দেশে এলে রাজধানীর বনানীর ডিওএইচএসের নিজ বাসায় বেশির ভাগ সময় অবস্থান করেন। মাঝেমধ্যে অবস্থান করেন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তার মালিকানায় থাকা অন্যান্য বাড়ি ও ফ্ল্যাটেও।
আবদুল হাই বাচ্চু পদত্যাগের পর ২০১৪ সালের ৬ জুলাই থেকে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন আলাউদ্দিন এ মজিদ। জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগের পর্ষদের পরিচালকরা বর্তমান পর্ষদের এখতিয়ারের বাইরে। বেসিক ব্যাংক লুটের নেপথ্য নায়কদের বিচার দেশের আইন-কানুন অনুযায়ীই হবে। এক্ষেত্রে আমাদের খুব বেশি করার নেই।
ঋণ বিতরণে অনিয়মের ঘটনায় ৫৬টি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর কোনোটিতেই আসামি করা হয়নি ব্যাংকটির তত্কালীন চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে। তবে একটি মামলায় গত ২৬ জুলাই আবদুল হাই বাচ্চুসহ ব্যাংকটির তত্কালীন পর্ষদের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। আদেশপ্রাপ্তির ৬০ দিনের মধ্যে মামলার তদন্ত সম্পন্ন করে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আবদুল হাই বাচ্চুসহ তত্কালীন পর্ষদ সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি চলছে বলে জানান দুদকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের রূপরেখা প্রণয়ন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আবদুল হাই বাচ্চু বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে। দেশে এলে তিনি কী করেন, কোথায় থাকেন, সে ব্যাপারে আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি।
আবদুল হাই বাচ্চুর দায়িত্ব পালনকালে বেসিক ব্যাংকের পর্ষদে ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের তত্কালীন যুগ্ম সচিব বিজয় ভট্টাচার্য্য, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মহাপরিচালক নীলুফার আহমেদ, বিসিকের তত্কালীন চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগের তত্কালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী আখতার হোসেন, এআরএস ল্যুভ বাংলাদেশ লিমিটেডের এমডি আনোয়ারুল ইসলাম, সাবেক কাস্টমস কমিশনার শাখাওয়াত হোসেন, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্কালীন ভারপ্রাপ্ত সচিব রাজিয়া বেগম ও চাঁদপুর চেম্বারের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জাহাঙ্গীর আকন্দ সেলিম।
পর্ষদ থাকলেও চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতায় ব্যাংক চলত বলে জানান ওই সময়ের বেসিক ব্যাংক পর্ষদের এক সদস্য। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, পরিচালক হিসেবে যোগদানের পর দেখি, চেয়ারম্যান একক ক্ষমতায় ব্যাংক পরিচালনা করছেন। সবকিছুতেই আবদুল হাই বাচ্চুর হস্তক্ষেপের কারণে পরবর্তীতে নিজেকে গুটিয়ে নিতে হয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি তখনই বিভিন্ন মাধ্যমে সরকারের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু যথাসময়ে হস্তক্ষেপ না করায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কছে পেশ করা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের (এফআইডি) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আবদুল হাই বাচ্চু চেয়ারম্যান থাকাকালে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ২ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা বিতরণ করেছে বেসিক ব্যাংক। এর মধ্যে শুধু ভুয়া জামানত ও জামানতবিহীন ঋণ দেয়া হয় ২ হাজার ২৪৮ কোটি ৮১ লাখ টাকার। ৫৫টি ঘটনার মাধ্যমে এ অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়। এর বাইরে আরো পাঁচটি ঋণ দেয়া হয় কার্যক্রমবিহীন নামসর্বস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে, যেখানে ৭০ কোটি টাকার ঋণ নিয়ে লোপাট করা হয়। পাশাপাশি আরেকটি জালিয়াতির ঘটনায় ভুয়া তথ্য দিয়ে ১৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়।
বেসিক ব্যাংকের জন্য নিজস্ব ভবন কেনার নামেও কেলেঙ্কারিতে যুক্ত হয়েছিলেন আবদুল হাই বাচ্চু। চেয়ারম্যান পদে যোগদানের তিন মাসের মাথায়ই এ কেলেঙ্কারির সূত্রপাত হয়। বিরোধপূর্ণ জমিতে ভবন নির্মাণের আগেই বেসিক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের জন্য ১২টি তলা কিনবেন বলে সিঙ্কু আকরামুজ্জামান নামে একজনের সঙ্গে চুক্তি করে বেসিক ব্যাংক। এজন্য ব্যাংক থেকে ৭৬ কোটি টাকা পরিশোধ করে দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত ভবনের একটি তলাও বুঝে পায়নি ব্যাংকটি। বেসিক ব্যাংকের টাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন ও সেনাকল্যাণ ভবনের সামনে অবস্থিত ওই ভবনের কাঠামো দাঁড়ালেও কবে নাগাদ ওই ভবনের কাজ শেষ হবে, তার কোনো সময়সীমা নেই। অর্থ মন্ত্রণালয় এখন দেখছে, ভবন কেনার জন্য বেসিক ব্যাংকের চুক্তির কোনো বৈধতা নেই। আবার যে জমির ওপর ভবন তৈরি হয়েছে, তাও তখন ছিল পরিত্যক্ত সম্পত্তি। জমি নিয়ে আদালতে তখন মামলাও চলছিল। ভবন কেনার পুরো প্রক্রিয়াই ছিল বিদ্যমান নিয়মনীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ভবনটির নির্মাতা সিঙ্কু আকরামুজ্জামান এখন দেশের বাইরে পলাতক বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে বেসিক ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মজিদ বলেন, এ দেশে জমিজামা নিয়ে বিরোধের সমাধান দ্রুততম সময়ে হয় না। নানা প্রদক্ষেপ শেষে বিষয়টি ব্যাংকের পক্ষ থেকে সরকারকে জানানো হয়েছে। সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা ছিল বিশেষ পদক্ষেপ নিয়ে বিষয়টির সুরাহা করার। কিন্তু এখন সেটি আর হবে বলে মনে হচ্ছে না।
আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে ব্যাংকটিতে নিয়োগ-পদোন্নতি নিয়েও। চেয়ারম্যান পদে থাকাকালে বেসিক ব্যাংকের নিয়োগ-পদোন্নতি তিনিই নিয়ন্ত্রণ করতেন। তার মেয়াদে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয় ব্যাংকটিতে। বেসিক ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত নিয়মের বাইরে গিয়ে ব্যাংকটিতে ১ হাজার ৫৫৩ জন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রার্থীদের জীবনবৃত্তান্তের সঙ্গে চিরকুট লিখে এ নিয়োগের ব্যবস্থা করেন আবদুল হাই বাচ্চু। ব্যাংকটির ৫৭ জন কর্মকর্তার পদোন্নতির ব্যবস্থাও করেন নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে।
আবদুল হাই বাচ্চু দায়িত্ব নেয়ার সময় ২০০৯ সালে বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ১৪১ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির ওই সময় পর্যন্ত বিতরণকৃত ঋণের মাত্র ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ। পাঁচ বছর পর ২০১৪ সাল শেষে বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ হাজার ৩০৯ কোটি টাকায়। ওই সময়ে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৫৩ দশমিক ৩২ শতাংশই খেলাপি হয়ে যায়। ভয়াবহ লুটপাটের শিকার হওয়ার পর এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বেসিক ব্যাংক। চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকটির ৭ হাজার ৩৯০ কোটি টাকাই চলে গেছে খেলাপির খাতায়।
এসব ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ হবে বলে জানান আলাউদ্দিন এ মজিদ। তিনি বলেন, খেলাপি গ্রাহকদের কাছ থেকে ঋণ আদায় কঠিন কাজ। তারা সহজে ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করবে, এমনটি মনে হয় না। কিছু গ্রাহকের ঋণ পুনঃতফসিল করে টাকা আদায়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কেউ কেউ সাড়াও দিচ্ছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন