ব্যবসা নেই। প্রারম্ভিক মূলধনও শেষ। টিকে থাকতে তাই ভিন্ন পন্থায় নতুন বীমা কোম্পানিগুলো। চাকরির কথা বলে জনপ্রতি ২০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জামানত সংগ্রহ করেছে একাধিক বীমা কোম্পানি। পরে চাকরি তো হয়ইনি, বন্ধ হয়ে গেছে অফিসও। এসব প্রতারণার অভিযোগে বিভিন্ন সময় একাধিক মামলা হলেও সংশ্লিষ্ট বীমা কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, এর সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
২০১৩ সালে অনুমোদন পাওয়ার পরের বছরই সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোলে হাসিনা ভিলার দ্বিতীয় তলা ভাড়া নিয়ে অফিস খোলে ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। জেলার বিভিন্ন এলাকায় নেয়া হয় প্রতিষ্ঠানটির আরো ছয়টি অফিস। এসব অফিসে চাকরির নামে জনপ্রতি ২০ হাজার থেকে শুরু করে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জামানত নেয়া হয় বলে জানান ভুক্তভোগীরা। বর্তমানে জেলার অধিকাংশ অফিসই বন্ধ। অথবা অফিস থাকলেও কার্যক্রম নেই।
চাকরি পেতে ট্রাস্ট লাইফের কথামতো ৭০ হাজার টাকা জামানত দেন সাতক্ষীরার কলারোয়ার এক বাসিন্দা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ধার-দেনা করে এ টাকা জমা দিয়েছি। প্রথম দিকে কয়েক দিন পর পর অফিসে যেতাম। এভাবে কয়েক মাস চলে যাওয়ার পরও চাকরি না হওয়ায় টাকা ফেরত চাই, কিন্তু তা পরিশোধে অস্বীকৃতি জানায় কোম্পানিটি।
চাকরির নামে জামানত সংগ্রহের বিষয়টি স্বীকার করলেও এর সঙ্গে কোম্পানির কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেন ট্রাস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সের যশোর অঞ্চলের প্রধান ব্যবসা উন্নয়ন কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, যশোর অঞ্চলে যিনি এ ঘটনা ঘটিয়েছেন, তিনি এখন পলাতক। তবে এ অপকর্মের সঙ্গে কোম্পানির কোনো সম্পর্ক নেই। প্রতিষ্ঠানের সুনাম নষ্ট করতে একটি মহল প্রতারণামূলক এ কাজ করেছে।
টাঙ্গাইলেও কোম্পানিটির বিরুদ্ধে একই অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি স্বীকারও করেন ট্রাস্ট ইসলামী লাইফের টাঙ্গাইল জোনাল অফিসের প্রধান কর্মকর্তা নরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমরা আইন অনুযায়ী চাকরির বিনিময়ে জামানতের টাকা সংগ্রহ করি। কোম্পানি কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই এটা করা হয়। এতে আইনের কোনো লঙ্ঘন হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় ট্রাস্ট ইসলামী লাইফের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজুল বারী চৌধুরীর সঙ্গে। তবে তিনি এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
ট্রাস্ট লাইফের মতোই একই পন্থায় অর্থ সংগ্রহের অভিযোগ রয়েছে নতুন অনুমোদন পাওয়া জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধেও। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নাটোরের সিংড়া এলাকার এক ব্যক্তির কাছ থেকে নির্বাহী কর্মকর্তা পদে চাকরি পাইয়ে দেয়ার নামে দেড় লাখ টাকা নিয়েছে জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সিংড়া শাখা। এর পরই কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় ওই প্রতিষ্ঠানটি।
ভুক্তভোগী ওই চাকরিপ্রার্থী নাম প্রকাশ না করে বলেন, বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর বসে ছিলাম। জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সে চাকরির আশায় ঋণ করে জামানতের দেড় লাখ টাকা জমা দিই। এখন তো প্রতিষ্ঠানের কোনো কার্যক্রমই নেই। কিছু বলতেও পারছি না।
বীমা আইন মেনেই তারা এটা করছেন বলে দাবি করেন জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের নাটোরের সিংড়া এলাকার জোনাল অফিসের নির্বাহী পরিচালক মো. আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, আমাদের কোম্পানি অঞ্চলিক অফিসের অভ্যন্তরীণ কাজ পরিচালনার জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে আলোচনাসাপেক্ষে জামানত নিয়ে থাকে। এর পরিমাণ দেড় লাখ থেকে সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা। বীমা আইন মেনেই আমরা এটা করছি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জেনিথ লাইফ এভাবেই ব্যবসা পরিচালনা করছে। কোম্পানি কর্তৃপক্ষও বিষয়টি জানে।
এ ধরনের অভিযোগ এখনো পাননি বলে জানান জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম নুরুজ্জামান। তিনি বলেন, আমরা শিগগিরই শাখাগুলো পরিদর্শনে যাব। আর আলমগীর হোসেন কিছুদিন আগে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। তার সঙ্গে কোম্পানির কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির বিরুদ্ধেও। মোটা বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে কোম্পানিটি এ ধরনের প্রতারণা করছে বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।
এ ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন ফরিদপুরের এসএস ইসহাক। তিনি বলেন, চার্টার্ড লাইফ থেকে ৮০ হাজার টাকা বেতনে সেলস ম্যানেজার পদে চাকরির প্রস্তাব দেয়া হয়। কোম্পানির দাবি অনুযায়ী বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ঋণ করে ২ লাখ টাকা কোম্পানিতে জমা দিই। চাকরি না পেয়ে পরে জামানতের অর্থ ফেরত চাই। কিন্তু এখনো ফেরত পাইনি।
অভিযুক্তদের সঙ্গে কোম্পানির কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেন চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শহিদুল ইসলামও। তিনি বলেন, আমাদের সুনাম নষ্ট করায় অভিযুক্ত ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেছি। কিন্তু এখনো তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
ডায়মন্ড লাইফের সাভার অফিসের দায়িত্বরত (ইডি) বিল্লাল হোসেন বলেন, কার্যক্রম শুরু করার পর পর এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু তা মীমাংসা হয়ে গেছে।
এ ব্যাপারে জানতে কোম্পানির প্রধান নির্বাহীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে ডায়মন্ড লাইফের ডিএমডি নজিবুল হক বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ অবগত নয়।
জামানত নিয়ে চাকরি দেয়ার এসব ঘটনাকে প্রতারণা বলে মন্তব্য করেন বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সদস্য গকুল চাঁদ দাস। তিনি বলেন, বীমা আইনে এ ধরনের কোনো সুযোগ নেই। এ ধরনের প্রতারণামূলক কার্যক্রম যেসব বীমা কোম্পানি চালাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ ধরনের প্রতারণার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেন বীমা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) চেয়ারম্যান শেখ কবীর হোসেন। তিনি বলেন, কোনো বীমা কোম্পানি এমন করতে পারে তা আমার ভাবনায় আসে না। এর আগে যেসব প্রতিষ্ঠান এ ধরনের কার্যক্রম চালিয়েছে, তারা এখন হায় হায় কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। সরকারের খুব দ্রুত বিষয়টি দেখা উচিত।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন