দেয়ালে লাগানো রঙিন পোস্টারে সাতজনের ছবি। প্রতিটি ছবির নিচে নাম লেখা। নামগুলো এ রকম ‘সন্ত্রাসী লিডার সুজন’, ‘সন্ত্রাসী লিডার মামুন’, ‘সন্ত্রাসী ব্যাঙ সোহেল’, ‘ইয়াবা সাফায়েত ফাহিম’, ‘ইয়াবা আমিন ওরফে মুছা’, ‘সন্ত্রাসী জনি সরকার’ এবং ‘ইয়াবা রাজীব’। পোস্টারের ওপরের অংশে লেখা, এদের ধরিয়ে দিন। এক সপ্তাহ ধরে চট্টগ্রামের চাক্তাইয়ের চালপট্টির বিভিন্ন পাইকারি দোকান ও আড়তের সামনে এসব পোস্টার দেখা যাচ্ছে।
চাক্তাই এলাকার ব্যবসায়ীদের চারটি সংগঠনের উদ্যোগে এসব পোস্টার ছাপানো হয়েছে। সংগঠনগুলো হলো চাক্তাই শিল্প ও ব্যবসায়ী সমিতি, চট্টগ্রাম চাউল ব্যবসায়ী সমিতি, চট্টগ্রাম রাইচ মিল মালিক সমিতি ও চট্টগ্রাম চট ব্যবসায়ী সমিতি। এই চার সংগঠনের উদ্যোগে সন্ত্রাসীদের ঠেকাতে এলাকায় প্রচারপত্রও বিলি করা হচ্ছে। ‘বিশেষ সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি’ নামে দুই পৃষ্ঠার এই প্রচারপত্রে পোস্টারে থাকা সাতজনসহ মোট নয় সন্ত্রাসীর (বাকি দুজনের একজন আরিফ ও অন্যজন সুমন) চাঁদাবাজি ও নানা অপকর্ম তুলে ধরা হয়েছে।
নিরীহ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের ধরে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়, বাসাবাড়িতে ডাকাতি, ট্রাকচালকদের কাছ থেকে নগদ টাকা ও মোবাইল সেট ছিনতাইসহ নয় সন্ত্রাসীর নানা অপকর্মের তথ্য পোস্টার ও প্রচারপত্রে উল্লেখ করা রয়েছে। চাক্তাই এলাকার সর্বস্তরের জনসাধারণের নামে ছাপানো পোস্টারে এই সন্ত্রাসীদের দেখামাত্র বাকলিয়া থানা এবং চাক্তাই পুলিশ ফাঁড়িতে খবর দেওয়ারও অনুরোধ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম শহরে চালের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার চাক্তাই। এই বাজারে আছে চালকলও। চাল ছাড়াও নানা ভোগ্যপণ্য এই বাজার থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়। প্রতিদিন গড়ে ৪০-৫০ কোটি টাকা বেচাকেনা চলে এই বাজারে।
চারটি ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা জানান, চিহ্নিত সন্ত্রাসীর হাতে চাক্তাইয়ের ১ হাজার ৪০০ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ী এবং স্থানীয় বাসিন্দারা জিম্মি হয়ে পড়েছে। রাতে সন্ত্রাসীরা মোটরসাইকেলে এসে মহড়া দেয়। এরপর সুযোগ বুঝে ব্যবসায়ীদের মারধর করে চাঁদা আদায় করে। দূরদূরান্ত থেকে আসা ট্রাকচালকেরাও তাদের কাছ থেকে রেহাই পান না। এসব সন্ত্রাসীর নাম সবার মুখে মুখে। এত দিন ভয়ে কেউ এ নিয়ে মুখ খুলতে চাইত না।
ব্যবসায়ীরা বলেন, নয় সন্ত্রাসীর এই দলের নেতৃত্বে রয়েছেন সুজন ও মামুন। এই দুই যুবক নিজেদের যুবলীগ নেতা পরিচয় দেন।
তবে চট্টগ্রাম নগরের বকশিরহাট ওয়ার্ড (চাক্তাই এলাকা এই ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত) আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শান্ত দাশগুপ্ত বলেন, সুজন ও মামুন নগর যুবলীগের কেউ নন। তাঁরা দলের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ করায় দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তাঁদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে যুবলীগের নগর কমিটিকে জানাবেন তিনি।
সুজন ও মামুন বাহিনীর চাঁদাবাজির বিষয়টি সম্পর্কে অবগত রয়েছেন বলে জানান চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৩৫ নম্বর বকশিরহাট ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নুরুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা যুবলীগের কেউ নন। স্থানীয় বাসিন্দাও নন। বাইরে থেকে এসে তাঁরা চাঁদাবাজি করছেন। বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয়েছে।
চাক্তাইয়ের চালপট্টি এলাকার ব্যবসায়ীরা বলেন, সন্ত্রাসীদের চাহিদামতো চাঁদা দিয়ে দেন তাঁরা। জানের ভয়ে ঝামেলায় জড়ান না। চাঁদার পরিমাণ ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা।
চট্টগ্রাম চাউল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম প্রথম আলোকে বলেন, সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এক সপ্তাহ ধরে তাঁরা দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সাঁটিয়েছেন। বিলি করেছেন প্রচারপত্র। সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বাঁচতে ৫ অক্টোবর বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁরা বৈঠক করেছেন। এরপর পুলিশি টহল বেড়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের আতঙ্ক কাটছে না।
এই সংগঠনের সভাপতি এনামুল হক বলেন, গত ২০ বছরে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। এখন সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধে পুলিশ-ব্যবসায়ী সবাই এগিয়ে আসছেন।
সন্ত্রাসীরা চাক্তাইয়ে সর্বশেষ হামলা করে ১ অক্টোবর রাতে। চাক্তাই শিল্প ও ব্যবসায়ী সমিতির কার্যালয়ের সচিব মো. ইউনুছ প্রথম আলোকে বলেন, সেদিন সন্ত্রাসীরা মোটরসাইকেলে করে তাঁদের কার্যালয়ের সামনে আসে। সবার কোমরে অস্ত্র ছিল। চাঁদা না দেওয়ায় তাঁকে মেরে ফেলার হুমকি দেয় সন্ত্রাসীরা। ওই সময় কার্যালয়ে নৈশপ্রহরী আনছার উল্লাহ ও মো. উসমানকেও গালাগাল করে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে চলে যায় তারা।
নৈশপ্রহরী আনছার উল্লাহ সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন, হায়াত থাকায় বেঁচে যান। রাত হলেই মোটরসাইকেল নিয়ে ঘোরাফেরা করা এই বাহিনীর (সুজন-মামুন) অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আরেক নৈশপ্রহরী মো. উসমান বলেন, ‘যতক্ষণ পাহারায় থাকি ভয়ে থাকি।’
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলেন, গত ৩০ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে ১১টায় সুজন-মামুন বাহিনী চাক্তাইয়ের হাজী ইসহাক সওদাগর ভবনের প্রহরী মো. লেদুকে অপহরণ করে। পুলিশকে জানানোর তিন ঘণ্টা পর মারধর করে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর তিন দিন আগে চাক্তাই পুলিশ ফাঁড়ির ৩০ গজ পশ্চিমে সুজন ও মামুন এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেন। গত ১৫ সেপ্টেম্বর সুজন ও মামুন বাহিনীর লোকজন চাক্তাই রাজাখালী রোডে সাবের চৌধুরী মার্কেটের সামনে চাক্তাই ট্রাক শ্রমিক কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি জসিম উদ্দিনকে মারধর করেন। ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, এ সময় মামুনের হাতে পিস্তল ছিল। সুজনের কাছে ছুরি ছিল। অন্যদের হাতে কিরিচ ও হকিস্টিক ছিল।
জসীম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ট্রাকচালকদের কাছ থেকে মোবাইল সেট ছিনতাই ও টাকাপয়সা কেড়ে নেওয়ার সময় তিনি প্রতিবাদ করেন। এ সময় তাঁর ওপর হামলা হয়। হামলার আধ ঘণ্টা পর আবার তাঁর বাসায় গিয়ে হুমকি দেয় সন্ত্রাসীরা।
সুজন ও মামুন পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী নন বলে জানান নগরের বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রণব চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুজনের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়ায়। তারা ছিঁচকে সন্ত্রাসী। ৫ অক্টোবর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকের পর চাক্তাই এলাকায় পুলিশি টহল বাড়ানো হয়েছে। ভুক্তভোগীদের বলা হয়েছে থানায় মামলা করতে। তাদের দেখলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে খবর দিতে ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
আরও সংবাদ
বিষয়:
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন