নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন নেই। তাই ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। তার পরও চলতি দায়িত্বে এমডির পদ ধরে রেখেছেন বীমা খাতের চার শীর্ষ নির্বাহী। প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধার বাইরে থেকেও প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক বিষয়ে এমডি হিসেবেই নিজেদের উপস্থাপন করছেন তারা। বিষয়টিকে রহস্যজনক উল্লেখ করে তা খতিয়ে দেখার দাবি তুলেছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
এমডি নিয়োগের সব শর্ত যথাযথভাবে পূরণ না করায় শহিদুল ইসলামকে এমডি হিসেবে অনুমোদন দেয়নি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। তার পরও প্রাপ্য বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই ২০১৫ সাল থেকে চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের এমডির পদ (চলতি দায়িত্বে) ধরে রেখেছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শহিদুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, বোর্ডের অনুমোদন নিয়েই আমি আছি। নিয়ন্ত্রণ সংস্থার অনুমোদন নেই, তাই এমডি পদের কোনো সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছি না। অতিরিক্ত এমডি পদের বেতন-ভাতা পাচ্ছি।
২০১৬ সালের নভেম্বরে জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের এমডি পদে (চলতি দায়িত্বে) নিয়োগ পান এসএম নুরুজ্জামান। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও আইডিআরএর অনুমোদন ছাড়াই কেন পদটি ধরে রেখেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি তো একা নই। অনেকেই এ রকম আছেন। আর এমডি পদের বেতন-ভাতা বা সুযোগ-সুবিধা কোনোটাই আমি নিই না। অনুমোদনে কেন দেরি হচ্ছে, সেটা আইডিআরএ ও বোর্ডের বিষয়।’
২০১৫ সালের জুলাইয়ে আলফা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের এমডির (চলতি দায়িত্বে) দায়িত্ব পান আপেল মাহমুদ। আইডিআরএর অনুমোদন ছাড়াই কোম্পানিটির ওই পদ ধরে রেখেছেন তিনি।
আপেল মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, আমি এমডি পদের কোনো সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছি না। নির্ধারিত সময়ের পরও পদ ধরে রাখার কারণ কী জানতে চাইলে বলেন, এটা কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ও আইডিআরএর অভ্যন্তরীণ বিষয়।
আইডিআরএ সূত্র জানায়, সম্প্রতি আলফা ইসলামী লাইফের এমডি হিসেবে আপেল মাহমুদকে নিয়োগের অনুমোদন চেয়ে আইডিআরএতে আবেদন জানায় কোম্পানিটি। তবে মাঠপর্যায়ের কর্মীদের নানা অভিযোগ ও অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ না হওয়ায় আপেল মাহমুদকে এমডি হিসেবে অনুমোদন দেয়নি আইডিআরএ। এছাড়া বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণসংক্রান্ত প্রবিধান-২০১২ অনুসারে মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত আগের পদে তিন বছর দায়িত্ব পালনের শর্তও পূরণ করেননি তিনি।
২০১১-১৪ পর্যন্ত টানা চার বছর বায়রা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের এমডি পদে চলতি দায়িত্বে ছিলেন ওমর ফারুক ভুঁইয়া। সর্বশেষ গত জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত কোম্পানিটির একই পদে রয়েছে তিনি।
ওমর ফারুক ভুঁইয়া এ প্রসঙ্গে বলেন, এখানে আমার কিছু করার নেই। নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কাছে অনুমোদন চাইলেও তারা দেয়নি। তবে ছয় মাসের বেশি এ পদে থাকার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি তিনি।
বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ প্রবিধানমালা অনুযায়ী, একাধারে তিন মাসের বেশি পদটি শূন্য রাখা যাবে না। তবে অপরিহার্য পরিস্থিতি বিবেচনায় আরো তিন মাস সময় বর্ধিত করতে পারবে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। এ সময়ের মধ্যেও কোনো বীমা কোম্পানি মুখ্য নির্বাহীর পদ পূরণ না করলে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ একজন প্রশাসক নিয়োগ করতে পারবে। কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত বেতন-ভাতা প্রশাসককে প্রদান করবে কোম্পানি। কিন্তু মুখ্য নির্বাহীর পদ শূন্য থাকলেও বেতনহীন চলতি দায়িত্বের এমডি দিয়েই কাজ চালিয়ে নিচ্ছে বেশক’টি বীমা কোম্পানি।
অনুমোদনহীন এসব এমডির বক্তব্য, নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না থাকায় তারা এমডি পদের বেতন-ভাতা নিচ্ছেন না। তবে পরিচালনা পর্ষদের অনুমতি নিয়েই পদটি ধরে রাখা হয়েছে। অনুমোদনহীন পদে বেতনহীন থেকেও এ নিয়ে কোনো অনুযোগ নেই তাদের।
এ প্রসঙ্গে আইডিআরএর সদস্য গকুল চাঁদ দাস বলেন, বেশকিছু কোম্পানি নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও চলতি দায়িত্ব দিয়ে এমডির কাজ চালাচ্ছে। অনুমোদন না নিয়ে যারা পদে অধিষ্ঠিত আছেন, তাদের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
এভাবে পদ ধরে রাখা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খাতসংশ্লিষ্ট অনেকেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইডিআরএর একাধিক কর্মকর্তা জানান, অবৈধ ও অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিতেই পরিচালনা পর্ষদ কোম্পানিতে অযোগ্য এমডি নিয়োগ দেয়। দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের বীমা খাতে এমন হয়ে আসছে, যা সবাই জানে।
আইডিআরএর সাবেক সদস্য সুলতান উল আবেদীন মোল্লা এ প্রসঙ্গে বলেন, অনুমোদন নেই, তাদের বক্তব্য অনুযায়ী এ পদের সুযোগ-সুবিধাও নিচ্ছেন না তারা। কিন্তু বঞ্চিত হয়েও এমডির পদ ধরে রেখেছেন কেন, তা খতিয়ে দেখা জরুরি। নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই যদি কেউ এমডি পদের সুযোগ-সুবিধা নেন, তাহলে তা হবে আইনের লঙ্ঘন। জীবন বীমা কোম্পানির তহবিলের ৯০ শতাংশের মালিক গ্রাহক। তাই এর যথেচ্ছা ব্যবহার হলে এর দায়ভার কোম্পানিসহ আইডিআরএকেও নিতে হবে।
অনুমোদন ও বেতনহীন এমডি দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালানোর এ সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া উচিত বলে মনে করেন বীমা কোম্পানির মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) চেয়ারম্যান শেখ কবীর হোসেন। তিনি বলেন, এখন সময় বদলেছে। আমাদের উচিত আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা দিয়ে শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের সুযোগ করে দেয়া। কিন্তু তা না করে আমরা কম টাকায় কোম্পানি চালাতে চাইছি। এ সংস্কৃতি থেকে সরে এসে আইন অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে যোগ্য ব্যক্তিকে এমডি পদে নিয়োগ দেয়া উচিত।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন