বাংলাদেশের ইলিশ মাছ এবার আসামেও ধরা পড়ছে। গত রোববার রাতে ইলিশ ধরার ওপর ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর ব্রহ্মপুত্রের ওপারেও প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। আসামে এভাবে ব্যাপক ইলিশ ধরা পড়ার ঘটনা এবারই প্রথম বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সেখানে ৭০০–৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ মাত্র ১০০ রুপিতে বিক্রি হচ্ছে।
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ব্রহ্মপুত্রে এবার প্রচুর ইলিশ মাছ পাওয়া যাচ্ছে। ভারতের সঙ্গে সীমান্ত এলাকা উলিপুর। দুদিন আগে ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর এখানকার জেলেরা সীমান্ত পর্যন্ত মাছ ধরতে গেছেন। জেলেদের মাধ্যমে জানা গেছে, ওপারে ভারতের আসাম রাজ্যের ধুবড়ি জেলার খাগড়ারচরেও প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সরকারের সংরক্ষণ নীতি ও জাটকা নিধন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপের কারণে ইলিশের উৎপাদন বেশি হচ্ছে। মেঘনা ও যমুনা নদীতে বাধা না পেয়ে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত চলে আসছে ইলিশ। এর সুফল এবার আসামও পাচ্ছে। উৎসবমুখর পরিবেশে সেখানে ইলিশ ধরার ধুম পড়েছে। আসামে ব্যাপক হারে ইলিশ ধরা পড়ার ঘটনা এবারই প্রথম বলে তিনি জানান।
প্রথম আলোর আগরতলা প্রতিনিধির তথ্যেও ঘটনার সত্যতা মিলেছে। বিচিং চর, ফকিরগঞ্জ, জলেশ্বরসহ কয়েকটি এলাকায় ধুবড়ির ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। ৭০০-৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ সেখানে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১০০ রুপি। সেখানের মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ইলিশ সংরক্ষণে কঠোর পদক্ষেপের কারণে লাভবান হচ্ছে আসাম। পদ্মাকে পাশ কাটিয়ে ব্রহ্মপুত্র ধরে এখন আসামমুখী ইলিশের ঝাঁক। অন্য সময় জেলেরা হা–পিত্যেশ করে মরলেও ইলিশের টিকিটিরও দেখা মিলত না। এখন প্রচুর ইলিশ উঠছে বাজারে। ধুবড়ি থেকে আইনজীবী ড্যানিয়েল হাসান শেখ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে জানান, গত তিন-চার বছর ধরে স্থানীয় বাজারে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। আগে আসত বাংলাদেশ থেকে চোরাপথে। এখন টাটকা ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশের মতো ভারতেও ইলিশ ধরা নিয়ন্ত্রণ করা হলে আরও বেশি সংখ্যক মাছ পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশ মাছ সংরক্ষণের জন্য গত ১ অক্টোবর থেকে ২২ অক্টোবর রাত ১২টা পর্যন্ত ইলিশ ধরা, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ ও বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়। মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, এবারের এই অভিযান ৯০ ভাগ সফল হয়েছে। বিভিন্ন সমস্যার কারণে ১০ ভাগ সফল হয়নি। তবে আগের চেয়ে জেলেরা অনেক সচেতন হয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম নিয়ামুল নাসের প্রথম আলোকে বলেন, ব্রিটিশ ভারতে আসাম, মেঘালয়, কলকাতায় বাংলাদেশের ইলিশ মাছ বাজারজাত করা হতো। ইলিশ সংরক্ষণ কার্যক্রমের কারণে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। পানি প্রবাহ স্বাভাবিক থাকায় ইলিশ যমুনা হয়ে ব্রহ্মপুত্রে চলে যাচ্ছে। সংরক্ষণ ও নদী প্রবাহ যদি স্বাভাবিক রাখা যা, য় তাহলে এভাবে ইলিশের সুফল এপার-ওপার দুই বাংলা সহজে পেতে পারে। তিনি জানান, ইলিশের পরিপক্কতার মাত্রা পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে বছরে দুটি প্রধান প্রজনন মৌসুম নিরূপণ করা হয়েছে। একটি ভাদ্র-আশ্বিন (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) ও অন্যটি অগ্রহায়ণ-পৌষ (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) মাসে।
ইলিশ সারা বছরই অল্প বিস্তর প্রজনন করে থাকে। ইলিশের প্রজনন সাধারণত সান্ধ্যকালীন সময়ে হয় এবং ভাদ্র-আশ্বিন ও অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসের ভরা পূর্ণিমার আগের সাত দিন, পূর্ণিমার দিন ও পূর্ণিমার পরবর্তী সাত দিন পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। ইলিশ মাছ যত বড় হয়, তা তত সুস্বাদু হয়। সাধারণত আমরা যেসব ইলিশ খাই, সাড়ে ৩শ থেকে এক কেজি ওজনের, সেগুলো এক থেকে দুই বছর বয়সী। এগুলোকে অন্তত চার বছর পর্যন্ত বড় হওয়ার সুযোগ দিলে তিন কেজির ইলিশ পাওয়া সম্ভব। এতে উৎপাদনও বাড়বে।
ভারতের বাজারে বিক্রি হচ্ছে ইলিশ।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) এর ইকোসিস্টেম ফর লাইফ নামের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৮৭-৮৮ সালে দুই লাখ টনের নিচে ছিল ইলিশের উৎপাদন। এরপর থেকে প্রায় এক যুগ পর্যন্ত আড়াই লাখ টনের মধ্যে ওঠা-নামা করেছে ইলিশের উৎপাদন। তবে ২০০২-২০০৩ সালের দিকে আশঙ্কাজনক হারে দুই লাখ টনের অনেক নিচে নেমে আসে উৎপাদন। মাছের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ওই সময় পরীক্ষামূলকভাবে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়। যার সুফল পরের বছর থেকেই পাওয়া যেতে থাকে। এখন প্রতি বছরই বাড়ছে ইলিশের উৎপাদন। সর্বশেষ ইলিশের উৎপাদন হয়েছে প্রায় চার লাখ।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুসারে, ২০১০-১১ অর্থ বছরে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৮৪৫ টন ইলিশ ধরা হয়। এর মধ্যে ১ লাখ ১৪ হাজার ৫২০ টন নদ-নদী ও উপকূলীয় এলাকা থেকে এবং ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৫ টন সাগর থেকে ধরা হয়। আগে প্রায় ৯০ ভাগ ইলিশই পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, কুমার, বলেশ্বর, ধলেশ্বরী, গড়াই, চিত্রা, পায়রা নদী থেকে ধরা হতো। পরবর্তীতে পদ্মার উজানে ভারতের অংশে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে পদ্মা নদীর প্রবাহ ও নাব্যতা বহুলাংশে কমে যায় এবং স্থানে স্থানে চর পড়া শুরু করে। ফলে ধীরে ধীরে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে ইলিশের আহরণ কমতে থাকে এবং মেঘনার নিম্ন অববাহিকা, উপকূলীয় অঞ্চল ও সমুদ্র থেকে ইলিশের আহরণ বাড়তে থাকে। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ নদ-নদী থেকে যে পরিমাণ ইলিশ আহরণ করা হয়, এর দ্বিগুণ পরিমাণ সাগর থেকে আহরিত হচ্ছে। ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে ৩ লাখ ৯৮ হাজার টন ইলিশ মাছ উৎপাদন হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন