আর্থিক সূচকগুলোয় ক্রমাগত অবনতিতে চরম ঝুঁকিতে পড়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক। প্রচলিত নিয়ম না মেনে নিজের মতো করে প্রস্তুত করা বিভিন্ন বিষয়ের দুর্বলতা ধরা পড়েছে ব্যাংটিতে। হিসাব কারসাজির মাধ্যমে লোকসান, মূলধন ঘাটতি, প্রভিশন, খেলাপি ঋণ কম দেখানো হয়েছে। কোনো ঋণ আদায় না করেই আদায় দেখিয়ে আয় বেশি দেখানো হয়েছে। গত বছরের কার্যক্রমের ওপর বিশদ পরিদর্শনে এসব অনিয়মের তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রধান কার্যালয়সহ ছয়টি বড় শাখা পরিদর্শন এবং অন্য ৬৩টি শাখার তথ্য পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলী আলাউদ্দিন এ মজিদ আমাদের সময়কে বলেন, বেসিক ব্যাংক কিছু অনিয়মের মধ্য নিয়ে চলেছে। বর্তমানের প্রতিবেদনটি দেখা যাচ্ছে, তা আগের। তবে ব্যাংকটি নতুন করে বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকটি লাভজনক অবস্থায় আসবে বলে জানান তিনি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর শেষে ব্যাংকটির মূলধন দেখানো হয়েছে ১ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। অন্য বিধিবদ্ধ সংস্থানের পর মূলধন ঘাটতি হয়েছে ১ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া ব্যাসেল-৩ অনুসারে ব্যাংকের মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ দশমিক ৬২৫ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকটির ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ ১১ হাজার ২০১ কোটি টাকা হওয়ায় আরও ১ হাজার ১৯০ কোটি টাকা মূলধন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল, যা ব্যাংকটি করেনি। অন্য ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে আরও ৫৫৭ কোটি টাকা মূলধন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল। এসব মিলে ব্যাংকটির সর্বমোট মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে ২০১৪ ও ২০১৫ সাল সরকার ২ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা বাজেট প্রদান করে।
আয়-ব্যয়ের হিসাবে কারসাজির মাধ্যমে লোকসান কম দেখানো হয়েছে বলে পরিদর্শনে পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত বছরে ব্যাংকটি পরিচালন মুনাফা দেখিয়েছে ৯ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে কয়েকজন গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় না করেই ২০ কোটি টাকা আয় দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ প্রকৃতভাবে হিসাব করলে ব্যাংকটির পরিচালনায় লোকসান ১১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। অন্যদিকে নিট হিসাবে ১ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা লোকসান দেখানো হয়েছে। মন্দ ঋণ ও অন্য ঋণগুলোর বিপরীতে ব্যাংকটির ৪ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা সংরক্ষণের প্রয়োজন থাকলেও করেছে মাত্র ২ হাজার ১৪ কোটি টাকা। সব শাখার ক্ষতি সমন্বয় করে হিসাব করলে ব্যাংকটির প্রকৃত লোকসান হতো ৪ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা।
কয়েক বছর ধরে ব্যাংকটিতে ঋণের নামে ডাকাতির ঘটনায় কয়েকজন গ্রাহকের কাছে ঋণের টাকা আটকা পড়েছে। এর বেশিরভাগই খেলাপি। বিগত দুই বছর ধরে সেই টাকা আদায় করতে পারছে না। এদিকে ব্যাংকটির সার্বিক সূচকে উন্নতির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে স্বাক্ষর করা সমঝোতা স্মারকের (এমওইইউ) শর্তগুলো পরিপালন করছে না ব্যাংকটি। পরিদর্শন সময়ে শীর্ষ ২০ ঋণগ্রহীতার কাছে ব্যাংকটির পাওনা ২ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১১ হাজার ৩৮ কোটি মন্দমানের খেলাপি ঋণ। আদায় অযোগ্য মন্দ ঋণ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের ৪৭ দশমিক ৩১ শতাংশ। এ ছাড়া মাত্র ২৪ গ্রাহককে ৩ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি; বিতরণকৃত মোট ঋণের ২৭ শতাংশ। ঋণ কেন্দ্রীভূত না করার এমওইউয়ের শর্ত লঙ্ঘন করেছে ব্যাংকটি।
এ ছাড়া মোট খেলাপি ঋণের ১৪ দশমকি ৮৬ শতাংশ আটকে রয়েছে শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে। মোট ১৩ হাজার ৪৮৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে আটকে রয়েছে ২ হাজার ৪ কোটি টাকা। কিন্তু শীর্ষ খেলাপির কাছ থেকে আদায় অতি নগণ্য। গত বছরে মাত্র ১২ কোটি ১৮ লাখ টাকা আদায় করা হয়েছে শীর্ষ খেলাপিদের কাছ থেকে।
পরিদর্শন প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়, ব্যাংকটিতে আমানত রয়েছে ১২ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। এই আমানত থাকার পরও ২০১৬ সালের বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম না মেনে আরও ১ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। এত অনিয়মের মধ্যেও বেসিক ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া কোনো নির্দেশনাই মানছে না বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। যার মধ্যে বলা হয়েছে, ব্যাংকের বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করার জন্য ত্রৈমাসিক সভার কথা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা ‘মুখ্য কর্ম সম্পাদনা নির্দেশক’ ও ‘মুখ্য কর্ম সম্পাদন নির্দেশক’ নামে দুটি প্রজ্ঞাপনও মানা হয়নি। একই সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক ২০১১ সালে অনুমোদিত ব্যাংকের ক্রেডিট পলিসি পরিদর্শনকালীন পর্যন্ত রিভিউপূর্বক অনুমোদন করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ গাইডলাইন অনুযায়ী ব্যাংকের অ্যান্ট্রি মানি লন্ডারিং (এএমএল) গাইডলাইন ছাড়া অন্য কোনো ঝুঁকিভিত্তিক গাইডলাইন করা হয়নি। এ ছাড়া ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমকে শক্তিশালী ও আর্থিক কার্যকর করলে ২০১৬ সালে কোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এ ছাড়া ব্যাংকটির অ্যাসেট লাইয়াবিলিট ম্যানেজমেন্ট, ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিপালনসংক্রান্ত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, অডিট ডিভিশনের কার্যক্রমের দুর্বলতাসহ কম্পøায়েন্স ডিপার্টমেন্ট কার্যক্রমের দুর্বলতার বিষয়টি উঠে এসেছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন