১৭টি মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করে; তার মধ্যে ৪টি কোম্পানিকে প্রথম বছর অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তী বছর ওই কোম্পানিগুলোর লাইসেন্স আর নবায়ন করা হয়নি। বর্তমানে কোনো এমএলএম কোম্পানির অনুমোদন নেই। তারপরও খোদ রাজধানী ঢাকায় শতাধিক এমএলএম কোম্পানি রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে।
.
সরকারের এই প্রতিষ্ঠানটি এমএলএম কোম্পানির লাইসেন্স দিয়ে থাকে। লাইসেন্স অনুমোদনের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানটির সহকারী রেজিস্ট্রার মো. হারুনুর-অর-রশিদ পরিবর্তন ডটকমকে ওইসব তথ্য নিশ্চিত করে জানান, এসব নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তাদের নয়। নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।
অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে দেশের বৃহৎ এমএলএম কোম্পানি ডেসটিনি-২০০০ কয়েক বছর আগে বন্ধ হয়ে যায়। এর শীর্ষ কর্তারা এখনও কারাগারে রয়েছেন।
কিন্তু যথাযথ তদারকির অভাবে বিভিন্ন কৌশলে রাজধানীতে গড়ে উঠছে শত শত এমএলএম কোম্পানি। ই-কমার্স, ই-বিজনেস ও ডাইরেক্ট টেলিমার্কেটিং ইত্যাদি নামে এসব কোম্পানি গড়ে উঠেছে।
এসব কোম্পানির লোভনীয় অফারের ফাঁদে পড়ছেন সরলমনা হাজার হাজার মানুষ। এমন কি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীরাও নিজেদের অজান্তে তাদের ফাঁদে পড়ছে। বিদেশ ভ্রমণ, ফ্ল্যাট, গাড়ি-বাড়ির আশায় তারা ‘প্রতারণার বৃত্তে’ ঘুরছে। তাই এ ব্যাপারে কেউ মুখ খুলছে না।
গত কয়েকদিন সরেজমিনে রাজধানীর পল্টন, বিজয়নগর ও কাকরাইল এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, বৃহৎ পরিসরে অফিস নিয়ে রাতারাতি ধনী হওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করছে এসব কোম্পানি। এরপর তাদের প্রতারণার ফাঁদে পা দিলেই ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন প্যাকেজের পণ্য। এসব প্যাকেজে আছে গৃহস্থালী পণ্য, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স পণ্য, হোম এপ্লায়েন্স পণ্য, প্রসাধন ও টয়লেট্রিজ পণ্য এবং হারবালসহ নানা ধরনের পণ্য।
আইনে কী আছে?
বাংলাদেশ সরকার এই ধরনের মার্কেটিং কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট ক্রেতা, ক্রেতা-পরিবেশক ও ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ২০১৩ সনের ৪৪নং আইন অনুসারে মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৩ পাস করে।
আইনটির দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৪নং ধারার (১) উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি লাইসেন্স ব্যতীত মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম পরিচালনা করিতে পারিবেন না।
(২) এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, লাইসেন্সের অধীন যেসব পণ্য বা সেবার ক্ষেত্রে মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম পরিচালনা করা যাইবে তার মধ্যে রয়েছে (ক) গৃহস্থালী পণ্য (খ) ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স পণ্য (গ) হোম এপ্লায়েন্স পণ্য (ঘ) প্রসাধন ও টয়লেট্রিজ পণ্য (ঙ) হারবাল পণ্য (চ) টেলিযোগাযোগ সেবা বা উহার ব্যবহারযোগ্য পণ্য (ছ) প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত পণ্য ও সেবা এবং (জ) কৃষিজ ও কৃষিজাত পণ্য।
ওইসব এমএলএম কোম্পানি মার্কেটিংযের ক্ষেত্রে নীতিমালায় উল্লেখিত পণ্যের তালিকা অনুসরণ করছে। কিন্তু কোম্পানিগুলোর কোনো লাইসেন্স নেই ব্যবসা করার জন্য।
নয়াপল্টনের নোভেরা
নয়াপল্টনে নোভেরা প্রোডাক্টস লিমিটেড নামে একটি এমএলএম কোম্পানি পরিচালিত হচ্ছে। কোম্পানিটি নিষিদ্ধ পিরামিড সদৃশ বিক্রয় কার্যক্রম করে যাচ্ছে।
অথচ মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৩ আইনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এই আইন কার্যকর হইবার পর মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম পরিচালনার আওতায় (ক) পিরামিড সদৃশ বিক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা করা যাইবে না; এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, ‘পিরামিড সদৃশ বিক্রয় কার্যক্রম’ অর্থ এইরূপ বিপণন ব্যবস্থা বা প্রক্রিয়া যাহাতে জ্যামিতিক হারে অধিক সংখ্যক ক্রেতা সংযুক্তির শর্তে নির্দিষ্ট লভ্যাংশ বা কমিশনপ্রাপ্তির বা প্রদানের প্রত্যাশায় বা প্রতিশ্রুতিতে অগ্রিম ফি প্রদানপূর্বক অংশগ্রহণ করিতে হয় এবং যাহার ফলশ্রুতিতে নিম্নোক্ত এক বা একাধিক অবস্থার সৃষ্টি হয়।
(ক) উচ্চস্তরের বিক্রেতার লভ্যাংশ বা কমিশনপ্রাপ্তি নিশ্চিত হইলেও নিম্নস্তরের ক্রেতা-পরিবেশকের লভ্যাংশ বা কমিশনপ্রাপ্তি অনিশ্চিত থাকে; (খ) পণ্য বা সেবা প্রকৃতমূল্যে বিনিময় হয় না; বা (গ) পণ্য বা সেবার বাস্তব অস্তিত্ব থাকে না।
নোভেরা প্রডাক্ট লিমিটেড নামের একটি এমএলএম কোম্পানির অফিসে গিয়ে দেখা যায়, ই-কমার্স ও ডাইরেক্ট সেলিংয়ের কথা বলে ক্রেতাদের যেকোনো একটি আইটেম পণ্য ক্রয়ের শর্তে রেজিস্ট্রেশন করাচ্ছে। যিনি পদ্ধতি মেনে রেজিস্ট্রেশন করছেন তিনি একটি কোড নম্বর পান। এভাবে কোড নম্বরপ্রাপ্ত ব্যক্তি অধিক সংখ্যক মার্কেটিং ম্যানেজার নিয়োগ দিয়ে পণ্য বা সেবা বিক্রয়ে কমিশন দিচ্ছেন।
দেখা গেছে, নোভেরা কোম্পানি থেকে সাত হাজার টাকার একটি পণ্য-প্যাকেজ ক্রয় করলে হওয়া যাবে কোম্পানির একজন ‘অংশীদার’। একজন নতুন ক্রেতা সংগ্রহ করলে তিনি পাবেন ৬০০ টাকা কমিশন। দু’জন কনভিন্স করতে পারলে মোট কমিশন হবে এক হাজার সাতশ টাকা। এরপর প্রতি ধাপে পণ্য বিক্রয়ের ওপর মিলবে কমিশন। একজনের মাধ্যমে সাতজন ক্রেতা যুক্ত হলে তিনি হবেন একজন ‘এক্সিকিউটিভ’। সে সঙ্গে পাবেন ভারত ভ্রমণের সুযোগ। এভাবে ধাপে ধাপে মালয়েশিয়া ভ্রমণ, ল্যাপটপ উপহার, ফ্ল্যাট ভাড়া, হজের সুযোগ, গাড়ি-বাড়ি ও কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট পদমর্যাদাসহ অঢেল সুযোগ-সুবিধা। শুধু তাই নয় এভাবে কারোর উদ্যোগে কোম্পানির ক্রেতা সংখ্যা বাড়তে থাকলে ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকবে আয়, যাকে বলা হচ্ছে রিয়্যালিটি ইনকাম বা স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা। এছাড়া বিক্রির পর আট ধাপে ছয় লাখ ৩৩ হাজার টাকা পেয়ে যাবেন ম্যাচিং সেল কমিশন হিসেবে। যার চিত্রে অংকিত হলে পিরামিডের আকৃতি ধারণ করে।
পিরামিডের আকৃতির এই পদ্ধতির ব্যবসায় লোভনীয় প্রলোভনে কোম্পানিটির সাথে প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে শত শত বেকার যুবক। নতুনভাবে আগতদের বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত করে দীর্ঘমেয়াদে ট্রেনিং করিয়ে মগজ ধোলাইয়ের কাজ করছে নোভেরা প্রোডাক্টের ট্রেনিং ডিপার্টমেন্টের কর্তাব্যক্তিরা।
এ বিষয়ে নোভেরা প্রডাক্টের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মো. কামরুল ইসলাম এ প্রতিবেদকের কাছে প্রথমে তারা এমএলএম ব্যবসা করছেন তা স্বীকার করতে চাননি।
কিন্তু প্রতিবেদকের সাথে তাদের কোম্পানির একাধিক এজেন্টের কথা হয়েছে। তারা পিরামিড ও এমএলএম প্রক্রিয়ায় পণ্য বিক্রয়ের বিষয়টি তুলে ধরেছেন বলে অবহিত করলে নোভেরার এই কর্মকর্তা বলেন, দেখুন আমরা এমএলএম ব্যবসার জন্য সরকারের কাছে লাইসেন্স চেয়ে আবেদন করেছি। সরকার আমাদের কোনো রেসপন্স করেনি।
প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর এর আগে ডেসটিনি-২০০০ এর ‘ডায়মন্ড’ (ডেসটিনির উচ্চ কর্মকর্তা) পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা ছিলেন বলে জানা গেছে।
নোভেরা প্রডাক্টের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সেসাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফজলুল রশিদ মৃধা (অব:)।
লাইসেন্স বিহীন এমএলএম কোম্পানির সাথে আপনি কিভাবে জড়িত এমন প্রশ্নের জবাবে নোভেরা প্রডাক্টের চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফজলুল রশিদ মৃধা (অব:) পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি কিছুই বলতে চাই না। আপনি এমডি সাহেবের সাথে এ বিষয়ে কথা বলুন।
আমার বাজার ডটকম
‘আমার বাজার ডটকম’ নামের এমএলএম কোম্পানির অফিস নয়া পল্টনে।
সেখানে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানির পণ্য বিক্রয়ে পিরামিড সদৃশ বিক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। শুরুতে কোম্পানিটির ডিএমডি ডেসটিনির এক সময়ের কর্ণধার আশরাফুল আমিন প্রতিবেদকের কাছে এমএলএম প্রক্রিয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন।
কিন্তু প্রতিবেদক কোম্পানিতে যোগদানের কথা বলে আরেক এজেন্টের কাছ থেকে নেওয়া তথ্য তার (আশরাফুল আমিন) কাছে তুলে ধরলে তিনি এমএলএম ব্যবসার বিষয়টি স্বীকার করে দু:খ প্রকাশ করেন।
‘ভিশন ২১’
রাজধানীর বিজয় স্মরণীর হোটেল ৭১ এর পাশের বিল্ডিংয়ে ‘ভিশন ২১’ নামের কোম্পানিও একই প্রক্রিয়ায় এমএলএম ব্যবসা করছে। কোম্পনির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফখরুদ্দিন জুয়েলের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদেরও এ ব্যবসার জন্য কোনো লাইসেন্স নেই।
এ ব্যাপারে লাইসেন্স প্রদানের দায়িত্বে থাকা জয়েন্ট স্টক কোম্পানির সহকারী রেজিস্ট্রার মো. হারুনুর-অর-রশিদ পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, এসব লিখে লাভ নেই, এমন প্রতিটি কোম্পানির সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও জড়িত।
তিনি বলেন, কোম্পানিগুলো যেসব ওষুধ জাতীয় প্রোডাক্ট বিক্রয় করছে তার দুই একটি আমিও ক্রয় করি। ভাল তো, তাদের পণ্যের মান তো খারাপ নয়।
এ ব্যাপারে এমএলএম ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘দেখুন, এ বিষয়গুলো এর আগে কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ আকারে পেশ করেনি। এমনকি গণমাধ্যমেও কোনো খবর প্রকাশ হতে দেখেনি। আপনার প্রতিবেদনটি প্রকাশ পেলে তার সূত্র ধরে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
ডেসটিনি-২০০০ বন্ধের পরও শতাধিক নিষিদ্ধ এমএলএম ব্যবসা কিভাবে পরিচালিত হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘এমএলএম ব্যবসার মাধ্যমে কেউ প্রতারিত হোক আমি এর ঘোর-বিরোধী। যথাযথ প্রমাণ পেলে এ ধরনের কোম্পানির বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের মাঝামাঝি বর্তমান সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির বৈঠকে ডেসটিনিসহ বিভিন্ন মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানির অবৈধ ব্যাংকিং এবং লেনদেন বন্ধের সুপারিশ করে।
এছাড়া এমএলএম কোম্পানি আইন দ্রুত জাতীয় সংসদে উত্থাপনের পরামর্শ দেওয়া হয়। তারই ধারাবাহিকতায় একই সালে দেশের সরলমনা মানুষের অর্থ আত্মসাৎ বন্ধে ‘ডেসটিনি ২০০০’ এর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় এবং সাধারণ মানুষের অর্থ আত্মসাতের কারণে কোম্পানিটির উচ্চ পদস্থ কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে সরকার।
সাজার বিধান
মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৩ আইনের পঞ্চম অধ্যায়ে ‘অপরাধ, দণ্ড ও বিচার’ বিভাগের ২৪ নম্বর উপধারায় পরিস্কার বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি ধারা ৪ এর বিধান লঙ্ঘন করেন অর্থ্যাৎ লাইসেন্স ব্যতীত এমএলএম ব্যবসায় পরিচালনা করেন তাহা হইলে উক্ত আইন লঙ্ঘন হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনূর্ধ্ব ১০ (দশ) বৎসর এবং অন্যূন ৫ (পাঁচ) বৎসর কারাদণ্ড এবং ৫০ (পঞ্চাশ) লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন