করের চাপাচাপি থাকছে না * অপ্রয়োজনীয় কর অব্যাহতি দেয়া হবে * ভর্তুকিতে বরাদ্দ জিডিপির ১.১% * অতিরিক্ত বরাদ্দ পাচ্ছে মেগা ১০ প্রকল্প * এমপিও’র মতো বন্ধ কর্মসূচি চালু হতে পারে
আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন খাতে পৌনে দু’লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে, যা চলতি বছরের তুলনায় প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ বেশি। নির্বাচন সামনে রেখে ভোটারদের খুশি করতে বেশ কিছু ‘রাজনৈতিক’ প্রকল্প নেয়ার সম্ভাবনা আছে। বরাদ্দ বাড়ানো হবে বিদ্যমান প্রকল্পে। এ কারণে উন্নয়ন বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ছে। একই কারণে বাজেটে করারোপের ক্ষেত্রে জনগণের ওপর চাপাচাপি থাকছে না। অপ্রয়োজনীয় কর থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে। ভর্তুকির পরিমাণও বাড়ানো হবে। মোট জিডিপির ১ দশমিক ১ শতাংশ বরাদ্দ থাকছে ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে। এমপিও’র মতো বন্ধ অনেক কর্মসূচি ফের চালুর বিষয় বিবেচনায় নেয়া হতে পারে। এছাড়া পদ্মা সেতুসহ দশ মেগা প্রকল্পে বেশি টাকা ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ২০১৮-১৯ সালের বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। উন্নয়ন খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রাথমিকভাবে বাজেটের সম্ভাব্য আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৬৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা। মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪০ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। এ বছর ঘাটতি বাজেটের আকার হবে ১ লাখ ২৭ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। আগামী বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
জানতে চাইলে অর্থসচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, এটি নির্বাচনী বছর। এ জন্য স্বাভাবিক বাজেট দেয়া হবে। নতুন কোনো পদক্ষেপ থাকবে না। তবে বাজেটে গুরুত্ব পাবে ফাস্টট্র্যাক প্রকল্পগুলো। তিনি বলেন, নতুন কিছু না থাকলেও উন্নয়নসহ অন্য খাত গুরুত্ব পাচ্ছে।
সূত্র মতে, চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৮ দশমিক ৩২ শতাংশ বেশি রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর আয়ের লক্ষ্য হচ্ছে ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। নন-এনবিআর রাজস্বের লক্ষ্য ১১ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। করবহির্ভূত রাজস্ব হচ্ছে ৩৩ হাজার ১১০ কোটি টাকা। নতুন বাজেটেও বড় অঙ্কের ঘাটতি থাকছে। এই ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেয়া হবে। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্য ৩৮ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেয়া হবে ৮৮ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকার ঋণ। তবে অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয়া হবে ৫৯ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা।
২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কাজেই এবারের বাজেটকে নির্বাচনী বাজেট হিসেবে আখ্যায়িত করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ভোটারদের তুষ্ট করতে নতুন অর্থবছরের বাজেটে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হবে। যাতে ভোটাররা কোনোভাবেই চাপের মুখে না পড়েন সেদিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে। এর অংশ হিসেবেই আগামী বাজেটে সব ধরনের অপ্রয়োজনীয় কর থেকে অব্যাহতি দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। আয়কর দেয়ার ক্ষেত্রে হয়রানি কমাতে ই-পেমেন্ট এবং ই-ফিলিং চালু করার ঘোষণা আসতে পারে। একই সঙ্গে রাজস্ব আদায় বাড়াতে সংশোধন করা হবে বিটিআরসির আইন। এছাড়া রাজস্ব ব্যয়ের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ১৩ ডিজিটের পরিবর্তে ৩৭ ডিজিটের বাজেট ও অ্যাকাউন্টিং ক্লাসিফিকেশন পদ্ধতি চালু করা হবে। এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগীদের ভাতা জিটুপি (গভর্মেন্ট টু পাবলিক) পদ্ধতিতে সরাসরি প্রদান পদ্ধতি চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি পেনশন ডাটাবেজ প্রণয়ন, ই-চালান ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে সরকারের অর্থ অপচয় রোধ এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা গতিশীল করা হবে। আসন্ন বাজেটে ভর্তুকির পরিমাণও বাড়ানো হবে। এতে (বাজেটে) মোট জিডিপির ১ দশমিক ১ শতাংশ বরাদ্দ থাকছে ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে খাদ্য ভর্তুকি বাবদ ৪ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। খাদ্যশস্যভিত্তিক কর্মসূচি অভিন্ন থাকায় এ খাতে ভর্তুকি খুব বেশি পরিবর্তন নাও করা হতে পারে।
সূত্র জানায়, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকার দৃশ্যমান উন্নয়ন দেখিয়ে ভোট টানার চেষ্টা করবে। এ জন্য পেদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রোরেল লাইন, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, রামপাল থার্মাল পাওয়ার প্লান্ট, চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে গুনদুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর এবং এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। এজন্য এসব প্রকল্পে চলতি বছরের তুলনায় অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। চলতি বছর এ খাতে ৩৩ হাজার ১৮২ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। সরকার এসব প্রকল্পের অগ্রগতি দেখিয়ে শেষ সময়ে ভোটারদের কাছে উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরবে। এ লক্ষ্যেই প্রকল্পগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
উন্নয়ন খাতের বরাদ্দ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আগামী বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) সম্ভাব্য বরাদ্দ ধরা হয়েছে এক লাখ ৭৮ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এডিপিতে বরাদ্দ আছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। এর আগের বছরে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৯১ হাজার কোটি টাকা। সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম বাজেট ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয় ৭৫ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ শতাংশের সমান। কিন্তু শেষ বাজেটে এডিপিতে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে জিডিপির প্রায় সাত শতাংশ। টাকার অঙ্কে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের তুলনায় ১৩৭ শতাংশ বেশি।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবিএম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, রামপাল পাওয়ার প্লান্ট ও পদ্মা সেতুসহ বড় প্রকল্পগুলোর ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বরাদ্দ বাড়তে পারে। তিনি বলেন, প্রতি মাসে একনেক বৈঠকে হাজার হাজার কোটি টাকা প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। অনুমোদিত প্রকল্পগুলো এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। যার ফলে বরাদ্দ বাড়ছে। তবে এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনী বছরে ব্যয়ের মাত্রা বাড়াতে চাইবে সরকার। কারণ জনগণের সামনে বলতে পারবে আমরা মানুষের উপকার চাই। এ জন্য ব্যয় বেশি করা হচ্ছে।
এদিকে উন্নয়নের পাশাপাশি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে বেশ কিছু খাতকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে দক্ষতা উন্নয়ন। এ জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ বাড়ছে। সার্বিক মানবসম্পদ উন্নয়নে নানা ধরনের পরিকল্পনাও নেয়া হচ্ছে। এছাড়া ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সড়ক, রেলপথ ও বন্দর উন্নয়ন অগ্রাধিকার পাচ্ছে। পাশাপাশি কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন, কর্মসৃজনও অগ্রাধিকার খাতে থাকছে। অগ্রাধিকার তালিকায় আরও রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সক্ষমতা অর্জন, সরকারি সেবাদানে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন। এছাড়া বহির্বিশ্বের অর্থনৈতিক সুযোগ অধিক ব্যবহার, প্রবাসী আয় বৃদ্ধি ও নতুন রফতানির বাজার অনুসন্ধানের বিষয়ও এর অন্তর্ভুক্ত।
সূত্র মতে, আগামী অর্থবছরে জিডিপি টাকার অঙ্কে দাঁড়াবে ২৫ লাখ ৪৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে জিডিপির আকার হচ্ছে ২২ লাখ ২৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। নতুন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার সহনীয় মাত্রায় থাকবে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ার সম্ভাবনা নেই। পাশাপাশি ভারত ও চীনে মূল্যস্ফীতির নিন্মমুখী প্রবণতা বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির ওপর নিন্মমুখী চাপ সৃষ্টি করতে পারে। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতির সম্ভাবনা কম। এছাড়া উন্নত, উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোতে ২০১৭ সালে উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। নানা কারণে শিল্পের উৎপাদন বাড়বে, বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে এবং ভোক্তার আস্থা ফিরে প্রবৃদ্ধির সহায়ক হবে।
সেখানে আরও বলা হয়, আগামী অর্থবছরে দেশে বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ বড় আকারের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে পরের বছরে সম্ভাবনা কম থাকে। চলতি বছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বড় ধরনের বন্যা হয়েছে। অনেক ফসল নষ্ট হয়। ফলে আগামীতে ধানসহ বিভিন্ন শস্যের উৎপাদন হবে ভালো এমন ধারণা করা হচ্ছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন