ব্যাংক কোম্পানি সংশোধন আইন সংসদে পাস -পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের চারজন থাকতে পারবেন টানা ৯ বছর -প্রতিবাদে জাতীয় পার্টির ওয়াকআউট - বিশেষজ্ঞদের মতে, আর্থিক খাত ঝুঁকিতে পড়বে
সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির তীব্র আপত্তির মুখে আইন সংশোধনের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলো। ব্যাংক কোম্পানি আইনের এ সংশোধনের ফলে একই পরিবার থেকে চারজন কোনো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে থাকতে পারবেন। একই সঙ্গে পরিচালক পদে টানা থাকার মেয়াদ বাড়িয়ে নয় বছর করা হয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) বিল উত্থাপন করেন। বিলটি পাসের প্রতিবাদে জাতীয় পার্টির সদস্যরা সংসদ থেকে ওয়াকআউট করেন।
এর আগে আলোচনায় অংশ নিয়ে একাধিক সংসদ সদস্য বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাতকে সমূলে ধ্বংস করতে এ বিল আনা হয়েছে। এতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে গঠিত দশম জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি চতুর্থবারের মতো ওয়াকআউট করল। এর আগে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো, বিচারপতিদের বেতন-ভাতা এবং বিমানের সাবেক এমডি জামাল উদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে তারা ওয়াকআউট করেছিলেন। তবে গতকাল বিলটি পাসের পর তারা আবারও সংসদের বৈঠকে যোগ দেন।
আইন সংশোধনের উদ্যোগের পর থেকেই এ নিয়ে আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞদের আপত্তি ছিল। আইনের খসড়া প্রণয়নের সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এভাবে পারিবারিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে মত দিয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে আর্থিক খাত ঝুঁকির মধ্যে পড়বে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব আপত্তি টিকল না। গত ১২ সেপ্টেম্বর সংসদের অধিবেশনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত 'ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) বিল, ২০১৭' উত্থাপন করেন। বিল উত্থাপনের বিরোধিতা করে জাতীয় পার্টির সাংসদ ফখরুল ইমাম বক্তব্য দেন। এরপর অর্থমন্ত্রী বিলটি উত্থাপনের পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেন। পরে ফখরুল ইমামের আপত্তি কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। এর আগে বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রথম সভায় বিলের বিপক্ষে মত দিলেও পরে ইতিবাচক রিপোর্ট দেওয়া হয়।
গতকাল বিকেল সাড়ে ৪টায় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বৈঠক শুরু হয়। বিলটি পাসের আগে বিরোধীদলীয় সদস্য ও স্বতন্ত্র সদস্যদের একাধিক জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নিষ্পত্তি করা হয়।
গতকাল সংসদের বৈঠকে বিলটির সমালোচনা করে স্বতন্ত্র সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, এই বিল পাস হলে ব্যাংকিং খাতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করা হবে। ব্যাংকের পরিচালক ও চেয়ারম্যান যারা হন তারা নিজেদের স্বার্থে নামে-বেনামে ঋণ নেন। এই ঋণ এক পর্যায়ে খেলাপি হয়ে পড়ে। এই খেলাপি ঋণ আর কখনোই পরিশোধ হয় না। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণের এই সংস্কৃতি বন্ধ করা সম্ভব না হলে দেশের ব্যাংকিং খাতে কখনোই শৃঙ্খলা ফিরে আসবে না। সামনে দেশের জন্য মহা অশনিসংকেত বলে দাবি করে রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, কয়েকজন লুটেরার জন্য আইন সংশোধন করা যায় না।
জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম বিলটির কঠোর সমালোচনা করে বলেন, ব্যাংককে কেউ নিজের বলে দাবি করতে পারেন না। পরিচালকদের স্বার্থেই এই আইন করা হচ্ছে। এই অর্থমন্ত্রী যখন বলেন- ব্যাংকিং খাতে 'পুকুর নয়, সাগর চুরি হয়েছে', যখন বলেন, 'অল আর রাবিশ'- সেটা তিনি দেশপ্রেম থেকেই বলেন। তাকে বোঝানোর কিছু নেই। যখন এই সংসদের প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'সবাইকে কেনা গেলেও আমাকে কেনা যায় না।' তাই আইনটি প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিতে চাই। বিলটি বাতিল করলে জাতি উপকৃত হবে।
বিরোধীদলীয় হুইপ নূরুল ইসলাম ওমর বলেন, পাকিস্তান আমলের মতো ২২ পরিবার সৃষ্টি করতে এই সংশোধনী আনা হচ্ছে। একই ব্যক্তি এক পদে দীর্ঘদিন থাকলে আধিপত্য বিস্তার লাভ করে। আমানতকারীদের স্বার্থহানি হয়। বিরোধী দলের সদস্য নূরুল ইসলাম মিলন বলেন, দেশের ব্যাকিং খাত ধ্বংসের মুখোমুখি। বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক ও ফারমার্স ব্যাংকের কথা মানুষ জানে। আর্থিক খাত সমূলে ধ্বংস করতে এ বিলটি আনা হয়েছে। মানুষ এখন ব্যাংকে টাকা রাখতে ভয় পান।
রওশন আরা মান্নান বলেন, সারাদেশের মানুষ আজ ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। এই সংশোধনী ব্যাংকের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। পরিচালকদের আত্মীয়-স্বজনরাই শুধু ঋণ পাবে। খেলাপির সংখ্যাও বাড়তে থাকবে। ব্যাংক মালিকদের চাপে এই আইন করা হচ্ছে।
নূরে হাসনা লিলি চৌধুরী বলেন, দেশে আজ ব্যাংকিং খাতের যে পরিস্থিতি তাতে এ নিয়ে আলোচনার মনমানসিকতা আর নেই। আবারও ২২ পরিবার তৈরির পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, এ প্রস্তাবটি দেড় থেকে দুই বছর ধরে আলাপ-আলোচনার পরে মন্ত্রিসভায় পাস করা হয়। এরপর সংসদীয় কমিটির সুপারিশকৃত আকারে সংসদে এসেছে। তাই এ পর্যায়ে আর যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ নেই। তাই সাংসদদের প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেওয়ার আহ্বান জানান মন্ত্রী।
এ পর্যায়ে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী ও কাজী ফিরোজ রশীদ দাঁড়ালে সভাপতির আসনে থাকা ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, এ পর্যায়ে ফ্লোর দেওয়ার সুযোগ নেই। এর প্রতিবাদে রাত পৌনে ৮টার দিকে ওয়াকআউট করেন বিরোধী দলের সদস্যরা। পরে সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর আলোচনার জন্য স্পিকার আহ্বান জানালেও তারা আর ফিরে আসেননি। জাপা সদস্যদের অনুপস্থিতিতেই বিলটি পাস হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকের কার্যপত্র থেকে জানা যায়, কমিটির সভাপতি আবদুর রাজ্জাক ২৯ অক্টোবর কমিটির বৈঠকে বলেছিলেন- এক পরিবার থেকে চারজন একটানা নয় বছর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন এ বিষয়গুলো পুনর্বিবেচিত হওয়া দরকার। কমিটির অন্য সদস্যরাও সভাপতির বক্তব্যকে সমর্থন দিয়েছিলেন। ওই বৈঠকে কমিটির সদস্য ফরহাদ হোসেন বলেছিলেন, বিলটি পাস হলে ব্যাংক খাত আরও বেশি পরিবারকেন্দ্রিক হয়ে উঠবে। আরেক সদস্য বেগম আখতার জাহানের মত ছিল বিলটি পাস হলে ব্যাংক খাত পরিবারকেন্দ্রিক হবে, মানুষের আস্থা হারাবে এবং এ খাতে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গত ২১ নভেম্বর কোনো ধরনের পরিবর্তন ছাড়াই বিলটি পাসের সুপারিশ করে দেয় সংসদীয় কমিটি।
বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, কোনো পরিবারের কেউ পৃথকভাবে ব্যবসা করলে এবং নিজেই করদাতা হলে তাকে পরিবারের ওপর নির্ভরশীল বলা যায় না। বর্তমান বিধানে একক পরিবার থেকে পরিচালক পদে নিয়োগযোগ্য সদস্য সংখ্যা দু'জনে সীমিত। একক পরিবার থেকে দু'জনের স্থলে চারজনকে সুযোগ দেওয়া হলে এ সমস্যা অনেকাংশে দূর হবে।
এতে আরও বলা হয়, 'কোম্পানি আইনের বিধান অনুযায়ী প্রথম পর্ষদের মেয়াদ এক বছর এবং পরে প্রতি বছর এক-তৃতীয়াংশ পরিচালকের পদত্যাগের বিধান রয়েছে। ফলে পরিচালকরা ধারাবাহিকভাবে কাজের সুযোগ পাচ্ছেন না। নতুন ব্যাংকগুলোর সমস্যা বিবেচনায় নিয়ে সব ক্ষেত্রেই যাতে ধারাবাহিকভাবে সর্বোচ্চ নয় বছর পর্যন্ত পরিচালক পদে থাকতে পারে সেজন্য এ সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়েছে।'
ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ পাস হওয়ার পর থেকে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিচালকদের মেয়াদ-সম্পর্কিত ধারাটি পাঁচবার সংশোধন করা হয়েছে। সর্বশেষ সংশোধন করা হয় ২০১৩ সালে।
আইন করে এভাবে ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তীব্র সমালোচনা করেছেন আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞরা। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ব্যাংক খাত এমনিতেই নানা সমস্যায় জর্জরিত। এর মধ্যে এক পরিবার থেকে চারজন এবং টানা ৯ বছর পরিচালক থাকার সুযোগ দিতে আইনের এ সংশোধন অনাকাঙ্ক্ষিত। এটি ব্যাংক খাতে সুশাসনের পরিপন্থী। এর ফলে ব্যাংকের পর্ষদে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ আরও বাড়বে, যা সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্তরায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, ব্যাংক এবং অন্য কোম্পানি আলাদা। অন্য কোম্পানিতে উদ্যোক্তাদের টাকায় ব্যবসা পরিচালিত হয়। আর ব্যাংকে যে টাকা থাকে তার বেশিরভাগই আমানতকারীদের। ফলে কোনো ব্যাংকে পুরোপুরি পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলে আমানতকারীর স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যথাযথ সেবা নিশ্চিত না হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। এ কারণে ব্যাংক কোম্পানি আইন এভাবে সংশোধন না করতে তারা পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। তিনি বলেন, আইন যেহেতু পাস হয়েই গেছে সেহেতু কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আরও কঠোর হতে হবে। একজন পরিচালক বা ব্যবস্থাপক অন্যায় করলে তাকে শুধু বিদায় করলে হবে না, তার বিরুদ্ধে কঠোর প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
আইন সংশোধনের উদ্যোগের পর থেকে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বিশিষ্ট এই ব্যাংকার সমকালকে বলেন, এ সংশোধনীর পক্ষে ছিলেন ব্যাংকের মুষ্টিমেয় কয়েকজন পরিচালক। শেয়ারহোল্ডার, গ্রাহক কিংবা ব্যাংকের কর্মীদের কারও সমর্থন ছিল না। অর্থনীতিবিদসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে যারা এ বিষয়ে কথা বলেছেন, তাদেরও কোনো সমর্থন ছিল না। দেশব্যাপী প্রতিবাদ সত্ত্বেও এ আইন পাস করার কী প্রয়োজনীয়তা ছিল, তা বোধগম্য নয়। এ আইন পাসের কারণে পরিণতি আরও খারাপ হবে বলে তিনি মনে করেন।
ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) গত বছরের মার্চে ব্যাংক কোম্পানি আইনের বিভিন্ন ধারায় সংশোধনের দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব জমা দেয়। পরে এই প্রস্তাবের বিষয়ে মতামত চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি পাঠায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। ব্যাংক খাতের এ নিয়ন্ত্রক সংস্থা সংশোধনীর বিপক্ষে মত দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতামত উপেক্ষা করে পরে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা থেকে সংশোধনের প্রস্তাব পাস করা হয়। সমকাল
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন