অগ্রণী ব্যাংকে চলছে লোপাট। এগারো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা রয়েছে ব্যাংকটির ৩৫৭ কোটি ৩৪ লাখ ৭৬ হাজার ৫৯৫ টাকা। নীতিমালা ভঙ্গ করাসহ অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ দেয়ায় ব্যাংকের ক্ষতি হয়েছে উক্ত টাকা। কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব না থাকায় ঋণের টাকা আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ অর্থ আত্মসাতের চেষ্টায় রয়েছেন এগারো প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। এতে সহযোগিতা করেছেন ব্যাংকটির অসাধু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ব্যাংকটির মতিঝিল প্রধান শাখা থেকে উক্ত টাকা ঋণ প্রদান করেছেন তারা। ১১টি ব্যবসয়ী প্রতিষ্ঠানের ঋণের নথি ও হিসাব বিবারণী থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা কমিশন নিয়ে জাল-জালিয়াতি করে এই ঋণ প্রদান করেছেন ব্যাংকটির জড়িত কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শামসুল ইসলাম মানবকণ্ঠকে বলেন, আমরা কিছু টাকা আদায় করেছি এবং আদায় করার চেষ্টা করব। আগের চেয়ে ভাল অগ্রগতিতে আছি। আমরা এবার বাংকের ৫৭৬ কোটি টাকা ক্যাশ আদায় করেছি। এই ঘটনায় জড়িত ব্যাকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়েছি এবং নিচ্ছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করছি।
অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান শাখা মতিঝিলের ২০১০-২০১১ সালের হিসাব ২৬-০৪-২০১২ থেকে ২৫-০৭-২০১২ তারিখ পর্যন্ত মেসার্স এম আর সোয়েটার কম্পোজিট লিঃ, মেসার্স জুলিয়া সোয়েটার কম্পোজিট লিঃ, মেসার্স অ্যাডভান্সড কম্পোজিট টেক্সটাইল লিঃ, মেসার্স রুপগঞ্জ ট্রেডিং কোম্পানি, দি আর্থ ইন্টারন্যাশনাল ট্যানারি লিঃ, মেসার্স রোকো এন্টারপ্রাইজ লিঃ, মেসার্স যশ লেদার ইন্ডাঃ লিঃ, মেসার্স ফজলুর রহমান অ্যান্ড কোম্পানি (প্রা.) লিঃ, মেসার্স এসারশন ডিজাইনার্স লিঃ, মেসার্স গচিহাটা অ্যাকোয়া কালচার ফর্মস লিঃ ও মেসার্স সাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল লিমিটেডের ঋণের নথি ও হিসাব বিবারণী পর্যালোচনায় দেখা যায়, ব্যাংকটির ৩৫৭ কোটি ৩৪ লাখ ৭৬ হাজার ৫৯৫ টাকা ক্ষতি হয়েছে।
এর মধ্যে মেসার্স এম আর সোয়েটার কম্পোজিট লিমিটেডের ঋণের নথি ও হিসাব বিবরণীর কাগজপত্রে পাওয়া যায়, অপর্যাপ্ত ডাউন পেমেন্টের ভিত্তিতে বার বার তফসিল সুবিধা দিয়েও টাকা আদায়ে ব্যর্থতায় শ্রেণি বিন্যাসিত ঋণের কারণে ব্যাংকের ক্ষতি হয়েছে ১০৬ কোটি ৯৩ লাখ ৪৮ হাজার ৮৬১ টাকা। মেসার্স অ্যাডভান্সড কম্পোজিট টেক্সটাইল লিমিটেডের ঋণের নথি ও হিসাব বিবরণীতে নীতিমালার শর্ত ভঙ্গ করে পুনঃতফসিল করা, শর্ত মোতাবেক টাকা আদায় না করা এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ ডিমান্ড লোনের টাকা আদায় না করায় ৫৪ কোটি ৮ লাখ ২৬ হাজার ৮১৯ টাকা ব্যাংকের ক্ষতি হয়েছে। মেসার্স রুপগঞ্জ ট্রেডিং কোম্পানির ঋণের নথি ও হিসাব বিবরণীতে দেখা গেছে, নীতিমালার শর্ত ভঙ্গ করে ডাউনপেমেন্ট ব্যতীত এলটিআর ঋণ পুনঃতফসিল করা, জামানতবিহীন দীর্ঘদিন পূর্বের এলটিআর ঋণের টাকা আদায় না করে ব্যাংকের ক্ষতি করা হয়েছে ৪৯ কোটি ২৮ লাখ ৬৫ হাজার ৬৭০ টাকা।
দ্য আর্থ ইন্টারন্যাশনাল ট্যানারি লিমিটেডের ঋণের নথি ও হিসাব বিবরণীতে পাওয়া গেছে নীতিমালা উপেক্ষা করে অনিয়মিতিভাবে ঋণ দেয়া, সিসি ঋণের অর্থ বন্ধক হিসেবে রাখা, ঋণের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও টাকা আদায় না করে ফেলে রাখায় ৪৮ কোটি ৩৫ লাখ ৬৪ হাজার ৮৫২ টাকা ব্যাংকের ক্ষতি করা হয়েছে। স্বল্প সময়ে ঋণ সীমা দ্বিগুণ বৃদ্ধি করায় ব্যাংকের ক্ষতি হয়েছে ২০ কোটি ৪০ লাখ ২৮ হাজার ৬৩৬ টাকা মেসার্স রোকো এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের নথি ও হিসাব বিবরণীতে দেখা যায়, বার বার পুনঃতফসিল সুবিধা দেয়া, জামানতের অবমূল্যায়ন করে অনিয়মিতভাবে সুদ মওকুফ সুবিধা দেয়া, অপ্রতুল জামানত, প্রকল্পের সমুদয় যন্ত্রপাতি গ্রাহক কর্তৃক ব্যাংকের অগোচরে বিক্রি করে আত্মসাৎ করার ফলে মেসার্স যশ লেদার ইন্ডাঃ লিমিটেড ব্যাংকের ১৪ কোটি ১৮ লাখ টাকা ক্ষতি করেছে।
মেসার্স ফজলুর রহমান অ্যান্ড কোম্পানি (প্রা.) লিমিটেডের ঋণের নথি ও হিসাব বিবরণীতে দেখা গেছে, ব্যাংক কর্তৃক সহজামানত সম্পত্তির মূল্যায়ন না করে ঋণ সীমা বর্ধিতসহ নবায়ন করা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব না থাকা, দীর্ঘদিন ধরে সীমাতিরিক্ত দায় সত্ত্বেও পুনঃনবায়ন করায় ৬ কোটি ৬৮ লাখ ৮৩ হাজার ৪৯০ টাকা ব্যাংকের ক্ষতি করা হয়েছে। ব্যাক টু ব্যাক এলসির বিপরীতে আমদানিকৃত মালামাল দ্বারা তৈরি পণ্য রফতানি অযোগ্য হওয়ায় সৃষ্ট ডিমান্ড লোনের টাকা আদায় না হওয়ায় এবং অপর্যাপ্ত জামানতের বিপরীতে সীমাতিরিক্ত দায় সৃষ্ট হওয়ায় ব্যাংকের ২ কোটি ৭ লাখ ৩৯ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে মেসার্স এসারশন ডিজাইনার্স লিমিটেডের ঋণের নথি ও হিসাব বিবারণীতে দেখা যায়। প্রকল্প চালু থাকা সত্ত্বেও মঞ্জুরী পত্রের শর্তানুযায়ী ঋণের টাকা আদায় না করা এবং আংশিক অবলোকন করে ফেলে রাখায় খেলাপী ঋণ বাবদ মেসার্স গচিহাটা অ্যাকোয়া কালচার ফর্মস লিমিটেড ব্যাংকের ২৯ কোটি ১৭ লাখ ৩৭ হাজার ৩৯০ টাকা ক্ষতি করেছে। মেসার্স সাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল লিমিটেডের প্রকল্প চালু থাকা সত্ত্বেও মঞ্জুরীপত্রের শর্তানুযায়ী ঋণের টাকা পরিশোধ না করায় খেলাপী ঋণ বাবদ ব্যাংকের ক্ষতি হয়েছে ২৬ কোটি ১৬ লাখ ৮১ হাজার ৮৭৭ টাকা। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব না থাকায় এই ঋণের টাকা আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
তবে এ বিষয়ে বাণিজ্যিক অডিট অধিদফতরের মহাপরিচালক জিনাত খান স্বাক্ষরিত একটি অডিট রিপোর্ট সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে পেশ করা হয়েছে। রিপোর্টে নীতিমালা ভঙ্গ করে ঋণদান এবং ঋণ আদায়ে ব্যর্থতার এ সমস্ত অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয়/প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ/প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে আপত্তিকৃত টাকা দ্রুত আদায়ের সুপারিশ করা হয়। এর পর ১৬ জানুয়ারি সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এ বিষয়ে একটি বৈঠক করেন। বৈঠকে রিপোর্টটি নিয়ে আলোচনা হয়।
মানবকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন