রোজার জন্য ঢাকা সিটি কর্পোরেশন গরুর মাংসের দাম বেঁধে দিয়েছে। কেজি প্রতি ৪৫০ টাকা। কিন্তু রোজার আগে থেকেই গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৫শ’ টাকা কেজিতে। বুধবার শান্তিনগর বাজার থেকে শুরু করে বেশিরভাগ বাজারের মাংস বিক্রেতারা জানিয়েছেন, ৪৫০ টাকায় কেজিতে মাংস বিক্রি করা সম্ভব না। কেন সম্ভব না, এই প্রশ্নের সাফ জবাব পড়তায় পড়ে না। এমনকি ওদের দাবি, যাদের সঙ্গে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বৈঠক করেছেন, তারা মাংস ব্যবসায়ী সমিতি থেকে বহিষ্কৃত। এই পাল্টাপাল্টি সমিতির গ্যাড়াকলে পড়ে এবার ভোক্তাদের অবস্থা ত্রাহি ত্রাহি।
রোজা শুরু হওয়ার আগে থেকেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। এমনকি, সবাইকে আশ্বস্ত করেছে, পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু কে কার কথা শোনে। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ নিজেই ব্যবসায়ীদের সতর্ক উচ্চারণ করে বলেছেন, কারসাজি করলে কঠোর ব্যবস্থা। সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিভাগীয় কমিশনারদের সমন্বয় সভায় এ বিষয়ে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তিনি বলেছেন, দ্রব্যমূল্য জনগণের ক্রয়সীমার মধ্যে ও সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশনা দিতে হবে। এর পাশাপাশি মোবাইল কোর্ট পরিচালনার পরামর্শ দেন। বুধবার এ ব্যাপারে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, রোজার মাসে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিটি জেলা প্রশাসককে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করার জন্য নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। এই বার্তা ব্যবসায়ী সমাজের কাছে ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে। কিন্তু ফলাফলে তেমন প্রভাব পড়ছে না।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, রোজার মাসে চিনির চাহিদা হচ্ছে ৩ লাখ টন। কিন্তু মজুদ রয়েছে ৪ লাখ ৩৫ হাজার টন। আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম নিম্নমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে যেখানে প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে শূন্য দশমিক ৩২ ডলারে, মার্চে এসে তা দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ২৯ ডলারে। ব্যবসায়ীরা সে কথা স্বীকারও করেন। এর পরও রোজাকে সামনে রেখে বেশ কিছু অসাধু ব্যবসায়ী চিনির দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। রোজার মাসে পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে ৪ লাখ টন। মজুদ রয়েছে ১৭ লাখ টনের বেশি। পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ার কোনো কারণ দেখেন না সাধারণ ভোক্তারা। বৃষ্টির অজুহাতে কোনো কোনো মহল পেঁয়াজের দামে হাত দিয়েছে। কিছুদিন আগে যে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৩০ টাকা, আজ সেই পেঁয়াজ লাফিয়ে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা হয়ে গেল।
শুধু তাই নয়, পাইকার থেকে খুচরা পর্যায়ে দামের বেশ হেরফের লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একাধিক বিক্রেতার অভিযোগ বৃষ্টিতে বেশ কিছু পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে।
রোজার মাসে ভোজ্যতেলের ব্যবহার বেশি হয়, সে কথা সবাই জানেন। এর পরও এই মাসে ভোজ্যতেলের চাহিদা হচ্ছে ২ লাখ ৫০ হাজার টন। কিন্তু মজুদ রয়েছে ২২ লাখের কাছাকাছি। তবে আশার কথা এখনো ভোজ্যতেলের দামের তেমন হেরফের হয়নি। মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মওলা স্বীকার করেছেন মজুদের পরিমাণ অনেক ভালো। তবে মিলগেট থেকে যেন সরবরাহ ব্যবস্থা সুষ্ঠু থাকে সেটি তিনি প্রত্যাশা করেন। একইভাবে পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির হাজি আবূল হাশেম জানান, সময়মতো যেন মিলগেট থেকে সরবরাহ করা হয়। তিনি পথে পথে চাঁদাবাজি বন্ধ করার দাবি জানান।
অবশ্য বেশ কিছুদিন আগে ঢাকা চেম্বার আয়োজিত রমজানে দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখার ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের নিয়ে এক বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে চাঁদাবাজি নিয়ে অভিযোগের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, চাঁদাবজি কঠোর হাতে দমন করা হবে। এর পরও নীরব চাঁদাবাজির অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। এমনকি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি অনেকে শুনছেন না। কোনো কোনো স্থানে ইফতার আয়োজনের নামে চলছে চাঁদাবাজি। এ ব্যাপারে কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি সাবেক বাণিজ্য সচিব গোলাম রহমান মনে করেন, ইফতারের দৌরাত্ম্য বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। এমনকি, তার পরামর্শ হচ্ছে, সবাই যেন একসঙ্গে সব পণ্য না কিনি। একসঙ্গে সবাই কেনার ফলে বাজারে এর প্রভাব পড়ে। অল্প অল্প করে কিনলে এর তেমন প্রভাব পড়বে না।
রোজার মাসে প্রতিদিন ইফতারে ছোলার প্রয়োজন হয়। এই মাসে এর চাহিদা হচ্ছে ৮০ হাজার টন। কিন্তু মজুদ রয়েছে ৭ লাখের বেশি টন। তাহলে এর ওপর দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। তবে সুযোগ বুঝে কেউ কেউ কেজিতে ছোলার দাম বেশি নিচ্ছেন। খেজুরে বাজার ছেয়ে গেছে। এই রোজায় খেজুরের প্রয়োজন হয় ১৮ হাজার টন। আর মজুদের পরিমাণও কম নয়। প্রায় ৬৪ হাজার টন মজুদ রয়েছে। এর পরও বাড়তি দামের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দামের দিক থেকে প্যাকেটজাত আর খোলা খেজুরের দাম অনেক হেরফের রয়েছে।
রোজা এলেই বেগুনের দাম যেন হঠাৎ করে বেড়ে যায়। অথচ এই বেগুন এ দেশেরই পণ্য। বৃষ্টির অজুহাতে এর দামের যেন কোনো বাধাধরা নিয়ম নেই। যে বেগুন দুদিন আগে বিক্রি হয়েছে কেজিতে ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়, সেই বেগুন এখন ৭০ থেকে ৮০ টাকায় উঠেছে। মুরগির দামের ক্ষেত্রে যেন চড়া ভাব। শুধু মরগি বলি কেন, তরিতরকারির দামও ঊর্ধ্বমুখী। রোজার মাসে প্রত্যেকে কমবেশি কলা কেনেন। চম্পা বলি আর সাগর কলা বলি সব ধরনের কলার দাম যেন বাড়তির দিকে। অথচ ফলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফলন হয় এই কলার। আর সব ঋতুতে এই কলা পাওয়া যায়। কিন্তু এর পরও কেউ কোনো কথা শোনেন না। সরকারের পক্ষ থেকে বার বার বলা হয়, রোজার মাসে দাম বাড়িও না। কম লাভ করো। কিন্তু ওরা মানে না মানা।
মানবকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন