আমদানি-রফতানি অর্থায়ন থেকে শুরু করে পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট কার্যক্রম— এমন অনেক উপাদান ২০১৭ সালে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে। তবে খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে গিয়ে কর-পরবর্তী মুনাফা হিসেবে যথেষ্ট অর্থ শেষ অবধি ধরে রাখতে পারেনি অধিকাংশ ব্যাংক।
শুধু মুনাফা নয়, একটি ব্যাংক সার্বিক বিচারে ভালো না মন্দ করছে, তা পরিমাপে বৈশ্বিক কিছু মানদণ্ড রয়েছে। সম্পদের বিপরীতে আয় (রিটার্ন অন অ্যাসেট বা আরওএ), শেয়ারহোল্ডারদের মালিকানার বিপরীতে আয় (রিটার্ন অন ইকুইটি বা আরওই), শ্রেণীকৃত ঋণ (এনপিএল) অনুপাত, শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস), শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস), মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত (ক্যাপিটাল অ্যাডেকোয়েসি রেশিও বা সিএআর) ও শাখাপ্রতি পরিচালন মুনাফা (ওপিবি) এগুলোর অন্যতম। একাধিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংক কোম্পানির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে প্রতি বছরের মতো এবারো সেরা ব্যাংকের র্যাংকিং করেছে বণিক বার্তা।
২০১৭ সালের আর্থিক প্রতিবেদনের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এক বছরের ব্যবধানে আবার শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড। আগের বছর ১২ থেকে ২ নম্বরে উঠে আসা ব্র্যাক ব্যাংক এবারো একই স্থান ধরে রেখেছে। তবে গত বছর শীর্ষস্থানে উঠে আসা ইস্টার্ন ব্যাংক এবার ৩ নম্বরে নেমে গেছে। তাদের স্কোরও আগের বছরের তুলনায় কমেছে। শীর্ষ দশের বাকি ব্যাংকগুলো হলো— মার্কেন্টাইল, ওয়ান, দ্য সিটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ট্রাস্ট, আল-আরাফাহ্ ও ব্যাংক এশিয়া। সার্বিক র্যাংকিংয়ে নিচের দিক থেকে ৩০, ২৯ ও ২৮তম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে আইসিবি ইসলামিক, পূবালী ও রূপালী ব্যাংক।
সাতটি নির্দেশকের ভিত্তিতে তৈরি করা সার্বিক পয়েন্ট টেবিলে একেকটি ব্যাংকের জন্য মোট স্কোর ধরা হয়েছে ৭০। এর মধ্যে ডাচ্-বাংলা ছাড়া কেউই অর্ধেক স্কোর অর্জন করতে পারেনি। ৩০-এর বেশি স্কোরপ্রাপ্ত ব্যাংকের সংখ্যা ৩-এ অপরিবর্তিত রয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালে ডাচ্-বাংলা (৪১ দশমিক ১৪ পয়েন্ট) ছাড়া কোনো ব্যাংকই ৩০- এর ওপর পয়েন্ট পায়নি।
তালিকা তৈরিতে প্রতিটি নির্দেশকের ভিত্তিমান ধরা হয়েছে সর্বোচ্চ ১০। প্রতিটি নির্দেশকেই নির্দিষ্ট মান নির্ধারণের ভিত্তিতে পয়েন্ট হিসাব করা হয়েছে। যেমন আরওই ৩০ শতাংশের বেশি হলে তার জন্য পূর্ণ ১০ নম্বর বরাদ্দ করা হয়েছে। এভাবে আনুপাতিক হারে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের প্রাপ্ত মানের ওপর পয়েন্ট হিসাব করা হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ এ বছর শীর্ষস্থানে উঠে আসা ডাচ্-বাংলার আরওই ১৩ দশমিক ২২। এতে আরওইর সারণীতে ব্যাংকটির প্রাপ্ত স্কোর দাঁড়ায় (১৩.২২–১০/৩০) বা ৪ দশমিক ৪১। অন্য নির্দেশকগুলোয়ও একইভাবে পূর্বনির্ধারিত মানদণ্ডের ভিত্তিতে পয়েন্ট বণ্টন করা হয়েছে। অন্যান্য নির্দেশকে সর্বোচ্চ পয়েন্ট প্রাপ্তির মানদণ্ড ধরা হয়েছে আরওএ ৫, এনপিএল সর্বনিম্ন ১, সিএআর ২০ শতাংশ, ইপিএস ১৫ টাকা, শেয়ারপ্রতি এনএভি ১০০ টাকা ও শাখাপ্রতি পরিচালন মুনাফা ১০ কোটি টাকা। পরে সাতটি সূচকে মোট ৭০ পয়েন্টের মধ্যে ব্যাংকগুলোর প্রাপ্ত স্কোরের ভিত্তিতে ২০১৭ সালের শীর্ষ ১০ ব্যাংক নির্বাচন করা হয়েছে।
সাতটি নির্দেশকে প্রাপ্ত স্কোরের যোগফলে ২০১৭ সালে সবার উপরে থাকা ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের স্কোর ৭০-এর মধ্যে ৩৬ দশমিক ৬৮। ২০১৬ সালে তাদের স্কোর ছিল ৩১ দশমিক ৩৪। স্কোরের এ উন্নতিতে ২০১৬ সালে সেরা ব্যাংকের তালিকায় ৩ নম্বর থেকে ২০১৭ সালে শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে ব্যাংকটি। সাতটি নির্দেশকের মধ্যে প্রতিটিতেই ২০১৬ সালের চেয়ে এগিয়েছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক।
দেশের সেরা ব্যাংক হওয়ার পেছনে বেশকিছু বিষয় অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে বলে জানান ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল কাশেম মো. শিরিন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, সর্বশেষ বছরে ব্যাংকের মুনাফা বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে ইপিএসের ক্ষেত্রে। বলা যায়, এ সময়ে আমরা ব্যবসায় আরো মনোনিবেশ করেছি। খেলাপি ঋণও কমেছে। ব্যাংকের কার্যক্রমের এ উন্নয়ন ঘটেছে ব্যবস্থাপনা সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণেই। গত বছর শীর্ষ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতাকে গুরুত্ব দিয়ে বেশকিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। পুনর্গঠনের মাধ্যমে নতুন করে সাজানো হয়েছে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা। পাশাপাশি কর্মীদেরও বেশকিছু প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। কার্যমূল্যায়নের ভিত্তিতে এক বছরের মধ্যে পদোন্নতিও পেয়েছেন তাদের অনেকেই। ফলে কর্মীদের এ উদ্দীপনাও ব্যাংকের সামগ্রিক কার্যক্রম উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে।
সেরা ব্যাংকের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রাখা ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের মোট স্কোর ৩১ দশমিক ৪ থেকে বেড়ে ৩৩ দশমিক ৪১-এ উন্নীত হয়েছে। ২০১৬ সালে কোনো নির্দেশকেই ব্যাংকটি ১ নম্বরে জায়গা করে নিতে পারেনি। তবে মূলধন পর্যাপ্ততা ছাড়া বাকি ছয়টিতেই তাদের অবস্থান ছিল শীর্ষ পাঁচে। ২০১৭ সালে ব্যাংকটি আরওই ও আরওএতে সবার উপরে উঠে এসেছে, আগের বছর যেখানে তাদের অবস্থান ছিল ৩ নম্বরে।
সাতটি নির্দেশকের মধ্যে চারটিতে তাদের প্রাপ্ত স্কোর আগের বছরের তুলনায় কমেছে। নির্দেশকভিত্তিক র্যাংকিংয়ে ব্র্যাক ব্যাংক ২০১৭ সালে দুটিতে আগের বছরের তুলনায় পিছিয়েছে। এর মধ্যে মূলধন পর্যাপ্ততায় তাদের অবস্থান ১৩ থেকে ১৭ নম্বরে এবং এনএভিপিএসে ৫ থেকে ৬ নম্বরে চলে এসেছে। খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে প্রাপ্ত স্কোর সামান্য কমলেও তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে এক্ষেত্রে ৪ নম্বর অবস্থানে অপরিবর্তিত রয়েছে দ্রুতবর্ধনশীল ব্যাংকটি। শাখাপ্রতি পরিচালন মুনাফার বিবেচনায়ও স্কোর সামান্য কমেছে। তবে এখানেও ব্র্যাক ব্যাংক ৪ নম্বর স্থানে অপরিবর্তিত রয়েছে।
সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কর্মীদের কঠোর পরিশ্রমের ফলে ব্র্যাক ব্যাংকের এ সাফল্য বলে জানান ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আরএফ হোসেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, গত দুই বছরে ব্র্যাক ব্যাংকের অসামান্য অর্জনে আমরা গর্বিত। ২০১৭ সাল ছিল ব্র্যাক ব্যাংকের জন্য মাইলফলক। প্রযুক্তি ও মানবসম্পদের উন্নয়নে আমরা উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছি, যা দেশের সেরা ব্যাংক হওয়ার পথে একধাপ এগিয়ে নিয়েছে। ব্যাংকিং মূল্যবোধ রক্ষায় আমরা সবসময় আপসহীন।
নিট স্কোর কমে যাওয়ায় এক নম্বর অবস্থান থেকে তিনে নেমে আসা ইস্টার্ন ব্যাংকের স্কোর দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ৪৭, ২০১৬ সালে যা ছিল ৩১ দশমিক ৬৫। খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ ও শাখাপ্রতি পরিচালন মুনাফা বিবেচনায় ইস্টার্ন এবারো ইন্ডাস্ট্রিতে সবচেয়ে ভালো ব্যাংক। এ দুই নির্দেশকে তাদের প্রাপ্ত স্কোরও আগের তুলনায় বেড়েছে। তবে আরওএ ও আরওই স্কোর কমার পাশাপাশি এ দুই ক্ষেত্রে র্যাংকিং যথাক্রমে ৫ থেকে ১২ এবং ১৩ থেকে ১৫ নম্বরে অবনমন হয়েছে ব্যাংকটির। মূলধন পর্যাপ্ততায় ২০১৬ সালে সবার উপরে থাকলেও এবার ইবিএলের স্থান হয়েছে ৪ নম্বরে।
বণিক বার্তার র্যাংকিংয়ে গত দুই বছরে সবচেয়ে দ্রুত উন্নতি করা ব্যাংকগুলোর একটি মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড। ২০১৬ সালের হিসাব-নিকাশে ২৪ থেকে ১১ নম্বরে উঠে এসেছিল ব্যাংকটি। সিটি ব্যাংককে হটিয়ে এবার তাদের অবস্থান চার নম্বরে। ২০১৬ সালে কোনো নির্দেশকেই ব্যাংকটি শীর্ষ পাঁচে ঢুকতে পারেনি। তবে ২০১৭ সালে আরওএতে ৩ নম্বর, আরওইতে ৪ নম্বর এবং ইপিএসে তৃতীয় শীর্ষ ব্যাংক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে মার্কেন্টাইল। শুধু মূলধন পর্যাপ্ততার প্রতিযোগিতায় আগের চেয়ে পিছিয়ে ১৮ নম্বরে নেমে এসেছে ব্যাংকটি। শাখাপ্রতি পরিচালন মুনাফায় তাদের র্যাংকিং ১৯ থেকে ১১-তে উন্নীত হয়েছে।
মার্কেন্টাইল ব্যাংকের এমডি কাজী মসিহুর রহমান বলেন, সব সূচকেই প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে কয়েক বছর ধরে মার্কেন্টাইল ব্যাংক সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা মেনে গ্রাহকদের সর্বোচ্চ সেবা প্রদানে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দক্ষ জনবল ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে মার্কেন্টাইল ব্যাংক বিপুল বিনিয়োগ করেছে। উন্নতির ধারাবাহিকতা রক্ষায় এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ব্যাংকের বিজ্ঞ পরিচালনা পর্ষদও এক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। মার্কেন্টাইল ব্যাংক সুস্থ প্রতিযোগিতায় বিশ্বাসী, আগ্রাসী বিনিয়োগে নয়। ব্যাংকের সব উন্নয়ন ও অগ্রগতি যেন টেকসই হয়, সে লক্ষ্যেই কাজ করছি আমরা।
সার্বিক স্কোর ২৭ দশমিক ৮৭ থেকে ২৬ দশমিক ৬৫-এ নেমে এলেও সেরা ব্যাংকের তালিকায় ৬ থেকে ৫ নম্বরে উঠে এসেছে ওয়ান ব্যাংক লিমিটেড। আগেরবারের আরওই চ্যাম্পিয়ন ওয়ান ব্যাংক এবার এক্ষেত্রে ২ নম্বরে অবস্থান করছে। ওপিবি আর এনএভিপিএসে তাদের স্কোর ২০১৬ সালের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। অন্যগুলোতে পয়েন্ট কমেছে।
আগামী দিনে ওয়ান ব্যাংক নিজেকে আরো ভালো অবস্থানে নিয়ে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন ব্যাংকটির এমডি এম. ফখরুল আলম। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে ওয়ান ব্যাংকের কার্যক্রমে অমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে। ব্যাংকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে দক্ষ জনবল। যুগোপযোগী প্রযুক্তির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে গ্রাহকসেবা দ্রুত ও নিরাপদ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আন্তরিকতার সঙ্গে চেষ্টা করলে যেকোনো সাফল্যই যে অর্জন করা যায়, ওয়ান ব্যাংক তার প্রমাণ। বিদায়ী বছর আমরা বৈদেশিক বাণিজ্যে জোর দিয়েছি। ভারী শিল্পের পাশাপাশি এসএমই ও রিটেইল ব্যাংকিংয়ে বিনিয়োগ বাড়ানো হয়েছে। গ্রীন ফাইন্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে ওয়ান ব্যাংক প্রথম সারিতে রয়েছে। বিদেশী অনেক বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে আমরা গ্রীন ফাইন্যান্স করে যাচ্ছি।
সেরা ব্যাংকের তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে থাকা দ্য সিটি ব্যাংক সাতটি নির্দেশকের মধ্যে খেলাপি ঋণ, মূলধন পর্যাপ্ততা ও শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্যে ২০১৬ সালের তুলনায় ভালো করেছে। অন্যদিকে সম্পদ ও বিনিয়োগের বিপরীতে আয়, শেয়ারপ্রতি আয় এবং শাখাপ্রতি পরিচালন মুনাফায় ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭-তে অবনতি হয়েছে। ফলে ২০১৬ সালের ২৯ দশমিক ৩০ স্কোর নিয়ে তালিকায় চতুর্থ স্থানে থাকলেও ২৫ দশমিক ৯৪ স্কোর নিয়ে এবার ষষ্ঠ অবস্থানে নেমে গেছে ব্যাংকটি।
দ্য সিটি ব্যাংকের এমডি সোহেল আরকে হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, নিট মুনাফার দিক থেকে সিটি ব্যাংক এ মুহূর্তে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। আমরা আর একটু ভালো চেয়েছিলাম। কিন্তু নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে গিয়ে কিছুটা পিছিয়ে যেতে হয়েছে। আমরা ব্যাংকের হিসাবায়ন প্রক্রিয়ায় কিছুটা পরিবর্তন এনেছি। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে ভালো করেছি। আশা করছি, বছর শেষে বিদায়ী বছরের চেয়ে অনেক ভালো করব।
একটি বাদে সবক’টি নির্দেশকেই ২০১৬ সালের তুলনায় এগিয়েছে সপ্তম স্থানে থাকা মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক। ২০১৭ সালে এসে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। তবে সার্বিকভাবে আগের তুলনায় ব্যাংকটির স্কোর ও র্যাংকিংয়ে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। যেখানে ২২ দশমিক ৭১ স্কোর নিয়ে ২০১৬ সালে ব্যাংকটির ১২তম অবস্থানে থাকলেও ২০১৭ সালে ২৫ দশমিক ৯০ স্কোর পেয়ে তালিকায় সাতে উঠে এসেছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) এমডি পরিচালক আনিস এ খান বণিক বার্তাকে বলেন, কমপ্লায়েন্স মেনে এমটিবি ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির পথে রয়েছে। তবে ব্যাংকটির আরো ভালো করা উচিত। এমটিবি নতুন কোর ব্যাংকিং স্যালুয়েশনে (সিবিএস) যাচ্ছে। এছাড়া সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ব্যাংকের মূলধন বাড়াতে হবে। মূলধন না বাড়ালে ব্যাংকের আর্থিক সক্ষমতা বাড়বে না। এ বছর শেষে এমটিবি নতুন উদ্যমে এগিয়ে যেতে পারবে।
খেলাপি ঋণ ও শাখাপ্রতি পরিচালন মুনাফায় ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে ভালো করেছে ট্রাস্ট ব্যাংক। তবে ব্যাংকটির সম্পদ ও বিনিয়োগের বিপরীতে আয়, মূলধন পর্যাপ্ততা, শেয়ারপ্রতি আয় ও শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য ২০১৬ সালের তুলনায় অবনতি হয়েছে। সার্বিকভাবেও ২০১৭ সালে আগের বছরের তুলনায় ব্যাংকটির স্কোর ও র্যাংকিংয়ের অবনতি ঘটেছে। ২০১৬ সালে ২৮ দশমিক শূন্য ৭ স্কোর নিয়ে সেরা ব্যাংকের তালিকার ট্রাস্ট ব্যাংক ৫ নম্বরে থাকলেও ২৫ দশমিক ৮৫ স্কোর নিয়ে এবার অষ্টম স্থানে নেমে গেছে।
শীর্ষ ১০ ব্যাংকের তালিকায় সপ্তম থেকে নবম স্থানে নেমে যাওয়া আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের স্কোর ২৬ দশমিক ৯৮ থেকে কমে হয়েছে ২৪ দশমিক ৯৪।
আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, বিদায়ী বছরে আমাদের আমদানি, রফতানি ও রেমিট্যান্সে ২২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে এ মুহূর্তে আমরা মানসম্মত বিনিয়োগ ও কমপ্লায়েন্স ব্যাংকিংয়ের প্রতি বেশি জোর দিচ্ছি।
২০১৬ সালে ব্যাংক এশিয়ার সার্বিক স্কোর ছিল ২১ দশমিক ৫৩। ২০১৭ সালে তা বেড়ে হয়েছে ২৪ দশমিক ৫৯। ফলে ২০১৬ সালের তালিকায় ১৯তম স্থানে থাকা ব্যাংকটি এবার দশম স্থানে উঠে এসেছে।
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী বলেন, ব্যাংকিং একটি দীর্ঘ সময়ের ব্যবসা। সুনাম অক্ষুণ্ন রেখে দীর্ঘ সময় ধরে যে ব্যাংক ব্যবসা করতে পারবে, সেটি গ্রাহক আস্থার শীর্ষে যাবে। ব্যাংক এশিয়া সে পথেই চলছে। আমরা শ্রম দিচ্ছি ব্যাংকটিকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংক এশিয়া এরই মধ্যে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। এসএমই ও রিটেইলে জোর দিয়ে ব্যাংক এশিয়াকে টেকসই ভিতের ওপর দাঁড় করানো হচ্ছে। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সব নীতিমালা আমরা নেমে চলার চেষ্টা করছি। ব্যাংক এশিয়া সব ক্ষেত্রেই কমপ্লায়েন্ট।
শীর্ষ দশের বাইরে থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে যমুনা ব্যাংক। ২০১৬ সালে ২২ দশমিক ৩৬ স্কোর নিয়ে সার্বিক তালিকায় ১৪ নম্বরে থাকলেও ২৩ দশমিক ৫৩ পয়েন্ট নিয়ে এবার একাদশ অবস্থানে উঠে এসেছে ব্যাংকটি।
ছয় ধাপ এগিয়ে ২০১৭ সালের সার্বিক তালিকার ১২ নম্বরে অবস্থান করে নিয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাংকটির সার্বিক স্কোর ২১ দশমিক ৬৭ থেকে বেড়ে ২৩ দশমিক ৩৩-এ উন্নীত হয়েছে।
সাত নির্দেশকে প্রাপ্ত স্কোরের যোগফলে তালিকায় ১৩তম অবস্থান অটুট রেখেছে আরেক শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক এক্সিম। সার্বিক তালিকায় তাদের স্কোর ২২ দশমিক ৬৭। ২০১৬ সালে ব্যাংকটির সার্বিক স্কোর ছিল ২২ দশমিক ৫২।
আগের বছর ৮ নম্বরে থাকলেও এবার সার্বিক স্কোর আড়াই পয়েন্টের বেশি কমায় ১৪তম স্থানে নেমে গেছে প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড।
পয়েন্ট কিছুুটা বাড়ায় সার্বিক তালিকায় দুই ধাপ এগিয়ে ১৫ নম্বরে উঠে এসেছে প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড। এক ধাপ পিছিয়ে ১৬ নম্বরে অবস্থান করা ঢাকা ব্যাংকের সার্বিক স্কোর ২২ দশমিক ৩৫ থেকে ২১ দশমিক ৭৫-এ নেমে এসেছে। ২৩ থেকে ১৭ নম্বরে উঠে আসা ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের সার্বিক স্কোর ২০ দশমিক ৭৯ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ৪৩। পয়েন্ট টেবিলে উন্নতির পাশাপাশি র্যাংকিংয়েও ৬ ধাপ এগিয়ে ১৮তম স্থানে রয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটির সার্বিক স্কোর ২০ দশমিক ৭২ থেকে বেড়ে হয়েছে ২১ দশমিক ৩৫।
স্কোর কমায় ১৬ থেকে ১৯ নম্বরে নেমে গেছে ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক (এনসিসি) লিমিটেড। ৭০-এর মধ্যে ব্যাংকটির সার্বিক স্কোর ২২ দশমিক ৩৪ থেকে ২১ দশমিক শূন্য ৮-এ নেমে এসেছে। স্কোর সামান্য কমলেও উত্তরা ব্যাংকের অবস্থান এক ধাপ এগিয়েছে। সেরা ব্যাংকের তালিকায় তাদের অবস্থান ২০তম।
সার্বিক তালিকায় শীর্ষ ২০-এ জায়গা করতে না পারা ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। ২৬ থেকে ২১তম স্থানে উঠে এসেছে ব্যাংকটি। তাদের স্কোরও সামান্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ২৩। এক বছরের ব্যবধানে সার্বিক তালিকায় ১০ থেকে ২২ নম্বরে নেমে এসেছে সাউথইস্ট ব্যাংক। সার্বিক তালিকায় তাদের স্কোর ২৪ দশমিক ৪ থেকে ২০ দশমিক শূন্য ৩-এ নেমে এসেছে।
গত বছর ৯ নম্বরে থাকা সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক এবার সার্বিক তালিকায় ২৩ নম্বরে নেমে এসেছে। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকটির সার্বিক স্কোরও ২৪ দশমিক ৫২ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ৪। দুই ধাপ পিছিয়ে এবার তালিকায় ২৪ নম্বর অবস্থানে নেমে গেছে শরিয়াহভিত্তিক আরেক ব্যাংক শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড।
দুই ধাপ এগিয়ে তালিকায় ২৫তম স্থানে রয়েছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড। ২৫ থেকে ২৬ নম্বরে নেমে যাওয়া প্রাইম ব্যাংক লিমিটেডের স্কোর কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৩৮ পয়েন্টে। এবি ব্যাংক তালিকায় ২০ থেকে ২৭ নম্বরে নেমে গেছে। তাদের স্কোর ৫ পয়েন্টের বেশি কমে ১৫ দশমিক ২৫-এ নেমে এসেছে। স্কোর ৮ দশমিক ১৩ থেকে ১২ দশমিক ৩৩ পয়েন্টে উন্নীত হওয়ায় তালিকায় এক ধাপ এগিয়ে ২৮ নম্বরে অবস্থান করছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক লিমিটেড। উচ্চসঞ্চিতির কারণে তালিকায় এক ধাপ পিছিয়ে ২৯-এ নেমে গেছে পূবালী ব্যাংক লিমিটেড। সার্বিক স্কোর ১৫ দশমিক ৬৫ থেকে কমে ১১ দশমিক ৬৯-এ নেমে এসেছে ব্যাংকটির।
এদিকে শূন্যের কাছাকাছি পয়েন্ট নিয়ে ৩০ নম্বর স্থানে অপরিবর্তিত আছে কেলেঙ্কারি, পুনর্গঠন ও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার মধ্য দিয়ে যাওয়া আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। তাদের স্কোর শূন্য দশমিক ১৪ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ১২।
সার্বিক বিবেচনায় দেশের ব্যাংকগুলো এখনো আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে পিছিয়ে আছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো এখনো ব্যাংকিং নরমস-রেগুলেশন পরিপালনে অনেক পিছিয়ে। গ্রাহকসেবার মান, নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, সামগ্রিক অর্থনীতিতে ব্যাংকগুলো এখনো কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করার যোগ্য হয়ে ওঠেনি।
তিনি বলেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বিশ্বমানে উন্নীত করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংককে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। রীতিনীতি পরিপালনে ব্যাংকগুলোকে আরো বেশি আন্তরিক হতে হবে। ব্যাংকিং মূল্যবোধ ও সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গায় অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন