রাজধানীর মিরপুরের বেনারসি পল্লী। ঈদ সামনে রেখে এখন ব্যস্ত দোকানগুলো। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সম্পূর্ণ বাঙালিয়ানায় নিজেকে সাজাতে বাঙালি নারীদের ব্যস্ততা যেমন বেড়েছে, তেমনি ব্যস্ত ঐতিহ্যবাহী নানা ধরনের শাড়ির কারিগররা।
রাত-দিন চরকা ঘুরাচ্ছেন সুতার ললি তৈরিতে, ভিমে (শাড়ি তৈরি ও নকশা তোলার যন্ত্র) একের পর এক শাড়ি ও নকশা বুনে যাচ্ছেন। দোকানিদের অর্ডার শেষ করতে দম ফেলার ফুরসত নেই তাদের।
সোমবার মিরপুরের বেনারসি পল্লীর শাড়ির দোকানগুলো ঘুরে ঈদ আয়োজনের এমন ব্যস্ততা দেখা গেল। আর সেই শাড়ি যদি হয় একেবারে নতুন ও ভিন্ন রকমের তাহলে তো কথাই নেই। তেমনই এসেছে নানা আঙ্গিকে সোনালি, মেরুন, মেজেন্টা, সবুজ ও অ্যাশ কম্বিনেশনের বেনারসি স্বর্ণকাতান শাড়ি।
পছন্দের জিনিসটি ক্রয় করতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মার্কেটে ভিড় জমাচ্ছেন বিভিন্ন শ্রেণীপেশার ক্রেতা সাধারণ।
আবার ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে বিপণিবিতানগুলো সাজানো হয়েছে বাহারি সাজে। তবে রোজার প্রথমদিকে আশানুরূপ ক্রেতার দেখা না মিললেও ১৫ রোজার পর বিক্রি বাড়ার প্রত্যাশা বিক্রেতাদের।
বাঙালি নারীদের পোশাকে শাড়ি একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তাই যত কেনাকাটাই হোক না কেন, অনেক বাঙালি নারী ভাবেন শাড়ি ছাড়া ঈদের কেনাকাটা অপূর্ণই থেকে যায়। তাই ঈদবাজারে শাড়ির দোকানে তরুণীসহ সব বয়সী নারীর বিপুল চাহিদারই প্রতিধ্বনি যেন।
সরেজমিন সোমবার রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বরের বেনারসি পল্লী ঘুরে দেখা যায়, বিয়ের শাড়ি কেনার জন্য এখনও বেশিরভাগ মানুষের প্রথম পছন্দ মিরপুরের বেনারসি পল্লী।
তবে ঈদ সামনে রেখে তরুণী থেকে শুরু করে মধ্যবয়সীদের আনাগোনায় জমজমাট বেনারসি পল্লী। সাধ ও সাধ্য মিলিয়ে শাড়ি কিনতে ক্রেতার ভিড়। দেশি তাঁত, জামদানি, টাঙ্গাইল শাড়ির পাশাপাশি সিল্ক, কাতানও বিক্রি হচ্ছে প্রচুর।
এছাড়া পছন্দের শাড়ির সঙ্গে মানানসই অলংকার ও আনুষঙ্গিক কেনাকাটার ধুম পড়েছে রাজধানীর বিপণিবিতানগুলোয়।
বেনারসি পল্লী ঘুরে আরও দেখা যায়, ঈদ সামনে রেখে পুরনো শাড়িগুলোর সঙ্গে এসেছে নতুন রং ও বাহারি ডিজাইনের বিভিন্ন ধরনের শাড়ি। ঈদ উপলক্ষে পাওয়া যাচ্ছে বিয়ের স্বর্ণকাতান, বেনারসি জর্জেট, গাদওয়াল, কাঞ্জিভরম, অপেরা কাতান, পাছারা কাতান, তসর কাতান, ধুপিয়ান, বালুচুরি তাঁত, মসলিন কাতান, ঢাকাই জামদানি, স্বর্ণ কাতান, ভেলভেট কাতান, চুন্দ্রি কাতান, পিওর কাতান, ফুলকলি কাতান, মসলিন জামদানি, জুট কাতান, চেন্নাই কাতানসহ বিভিন্ন ধরনের শাড়ি।
এছাড়া রয়েছে কাতান থ্রি-পিস, শেরওয়ানি, পাঞ্জাবি, পায়জামা, লুঙ্গি, গামছা, ছোটদের ড্রেসসহ রকমারি পোশাকের সমাহার। তবে নারীদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের কাতান শাড়ি। ঈদ উপলক্ষে বেনারসি স্বর্ণকাতানের চাহিদা বেশি। এছাড়া বিক্রিও ভালো।
দোকানিরা জানালেন, এবার ঈদে বেনারসি স্বর্ণকাতান বাজার মাত করবে- এটা আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি। দামও রাখা হয়েছে ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই। দাম রাখা হয়েছে সাড়ে তিন হাজার থেকে সর্বোচ্চ বিশ হাজার টাকার মধ্যে। যার যেমন সাধ্য। ৩৫ বছর ধরে এখানে ব্যবসা করেন ইমন। জানালেন, এতকাল দোকানদারি করে মা-বোনদের মন-মর্জি বুঝতে পারব না তা কি হয়?
বিশ্বদরবারে স্বতন্ত্র মহিমায় সমুজ্জ্বল আমাদের অভিজাত তাঁতবস্ত্র ঘিরে তৈরি করা বেনারসিসহ নানা নামের শাড়ি। এ শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে এ দেশের সংস্কৃতি ও কৃষ্টি। বিশ্ববিশ্রুত অনন্য মসলিন শাড়ির সংস্করণ আধুনিক ডিজাইনের এ শাড়ি।
সোমবার বেনারসি পল্লীতে শাড়ি কিনতে মগবাজার থেকে এসেছেন চায়না বেগম। তিনি জানালেন, তাঁতীদের হাতে তৈরি হওয়ার কারণে এখানকার শাড়ির মানটা অনেক ভালো হয়। এ ছাড়া শাড়ির দামটাও হাতের নাগালের মধ্যে থাকে।
কানাডা থেকে সাত দিন হল দেশে ফিরেছেন আবির হাসান। তিনি বিয়ের জন্য শাড়ি কিনতে এসেছেন বেনারসি পল্লীতে। তিনি জানান, বিয়ের শাড়ির জন্য সবচেয়ে ভালো মিরপুরের বেনারসি পল্লী। সাধ ও সাধ্যের মধ্যে পছন্দসই শাড়ি পাওয়া যায় এখানে। এ ছাড়া বিয়ের শাড়ি বলে কথা। তাই নিজের পছন্দসই শাড়ি শুধু এখানেই পাওয়া যায়।
বেনারসি পল্লীর হানিফ সিল্কের শাড়ি বিক্রেতা মোহাম্মদ আলী জানান, সারা বছরই আমাদের বেচাবিক্রি ভালো। তবে রমজানে সবচেয়ে বেশি বেচাবিক্রি হয়। ঈদ উপলক্ষে যে বিক্রি হয় তা এখনও বাড়েনি, তবে ১৫ রোজার পর বিক্রি বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন এ বিক্রেতা।
মিরপুরে বেনারসি পল্লীর যাত্রা শুরু সেই ১৯০৫ সালে। মানে একশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে এখানে বেনারসি, কাতান, জামদানিসহ দারুণ সব শাড়ি বেচাকেনা চলছে।
১৯৯০ সাল পর্যন্ত গদিঘর তেমন ছিল না বললেই চলে। গদিঘরগুলোয় বেনারসি শাড়ির খুচরা ও পাইকারি কেনাবেচা হতো সাধারণত। পরবর্তী সময়ে চাহিদা বাড়তে থাকায় এগুলোর সংখ্যা বাড়তে থাকে। পুরনোদের সঙ্গে নতুন নতুন উদ্যোক্তা যোগ দেয়। পরবর্তী সময়ে কারখানাগুলো অন্য জায়গায় সরে যায় ও গদিঘরগুলো আধুনিক শোরুমে পরিণত হয় এবং দেশে-বিদেশে এখানকার পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন