খাতুনগঞ্জে একসময় ভোগ্যপণ্যের রমরমা ব্যবসা ছিল হারুন-অর-রশিদের। ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা থেকে চট্টগ্রাম নগরী ও আশপাশ এলাকায় প্রচুর জমি কেনেন তিনি। নগরীর বাকলিয়া, অক্সিজেন, খুলশী ও চকবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে তার অর্জিত সম্পত্তি। বিকে ট্রেডিংয়ের এ কর্ণধারের কক্ষচ্যুতির শুরু এক দশক আগে। চট্টগ্রামের বাঁশখালী এলাকার আনু ফকিরের ভক্ত বনে যান হারুন-অর-রশিদ। বিভিন্ন সময়ে সম্পত্তি বিক্রি করে ওই ফকিরের হাতে অর্থ তুলে দিতে থাকেন। ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়ায় ব্যাংকের পাওনা বাড়তে থাকে। একের পর এক সম্পত্তি বিক্রি করে এখন পথে বসার জোগাড়। অর্থকষ্টে থাকা হারুনের সন্তানদের পড়ালেখাও এখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
প্রবীণ এ ব্যবসায়ীর পরিচিতজনরা জানান, ব্যবসায় পুরোদমে প্রসার থাকাকালেই চট্টগ্রামের বাঁশখালী এলাকার আনু ফকিরের ভক্ত হয়ে পড়েন হারুন-অর-রশিদ। খাতুনগঞ্জে নিজের অফিসে আসার পরিবর্তে তিনি নগরীর বাকলিয়া থানার উল্টো দিকে আনু ফকিরের প্রতিষ্ঠিত কামাল ইশকে মোস্তফা কমপ্লেক্সে যাতায়াত শুরু করেন। ২০০৯-১০ সাল থেকে আনু ফকিরের কমপ্লেক্সে তার যাতায়াত বেড়ে যায়। মুখ থুবড়ে পড়তে থাকে দেড়-দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বিকে ট্রেডিং।
জানা গেছে, বিকে ট্রেডিংয়ের কাছে সবচেয়ে বেশি পাওনা ব্যাংক এশিয়া খাতুনগঞ্জ শাখার। প্রতিষ্ঠানটির কাছে এ ব্যাংকের পাওনা প্রায় ৯৮ কোটি ২০ লাখ টাকা। এছাড়া ৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা পাওনা আদায়ে বিকে ট্রেডিংয়ের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছে সাউথইস্ট ব্যাংক সিডিএ শাখা। ৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা পাওনা আদায়ে আরেকটি মামলা করেছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। এছাড়া হারুনের কাছে দেশের শীর্ষস্থানীয় এক শিল্প গ্রুপের মালিকের পাওনা রয়েছে প্রায় ১৩ কোটি টাকা। ২০১১ সালে গ্রুপটির কাছ থেকে এ টাকা ধার নেন তিনি।
ব্যাংকের তথ্যমতে, বিকে ট্রেডিংয়ের সাথে ব্যাংক এশিয়ার ব্যবসা দীর্ঘদিনের। ২০০৪-০৫ সময়ে বিভিন্ন দফায় মেসার্স বিকে ট্রেডিং ও মেসার্স বিকে ওভারসিজ নামে ঋণ সুবিধা নেন প্রতিষ্ঠানের মালিক হারুন-অর-রশিদ। প্রথম দিকে ব্যাংকের কিস্তিগুলো ভালোভাবে শোধ করলেও একসময় তিনি ব্যাংকের টাকা পরিশোধ বন্ধ করে দেন।
এরপর ২০১২ সালের দিকে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। পাঁচটি চেকের মামলায় এরই মধ্যে তিনটির রায় দিয়েছেন আদালত। তিন মামলার প্রত্যেকটিতে হারুন-অর-রশিদের এক বছর করে কারাদণ্ড ও ১৫ কোটি টাকা অর্থদণ্ড হয়েছে। ৫ কোটি টাকা করে আরো দুটি চেকের মামলা বিচারাধীন। এছাড়া অর্থঋণ আদালতে দায়ের হওয়া মামলায়ও অর্থঋণ আইনের ১০-এর ৩ ধারায় প্রতিষ্ঠানটির সব বন্ধকি সম্পত্তি ব্যাংকের অনুকূলে সার্টিফায়েড করেছেন আদালত। ফলে বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে বিক্রি করে ব্যাংকের ঋণের টাকা সমন্বয় করতে কোনো আইনি বাধা নেই।
ব্যাংক এশিয়া খাতুনগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, খাতুনগঞ্জের অন্যতম ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক ছিলেন হারুন-অর-রশিদ। কিন্তু হঠাত্ ব্যবসা ছেড়ে দরবারমুখী হয়ে পড়েন এ প্রবীণ ব্যবসায়ী। এতে ব্যাংকে তার দেনা বাড়তে থাকে। প্রচুর সম্পত্তি আমাদের কাছে বন্ধক থাকায় ৯৮ কোটি টাকা পাওনা আদায়ে বেশি সমস্যা হবে না। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত একজন ব্যবসায়ী ব্যবসা ছেড়ে বাজার থেকে চলে যাওয়া বা নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার ঘটনা দুঃখজনক। ব্যাংকের ৯৮ কোটি টাকা পাওনা আদায়ে বন্ধক রাখা সম্পত্তি নিলামে তোলার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান এ ব্যাংক কর্মকর্তা।
জানা গেছে, ২০১২-১৩ সালের পর থেকে আর কোনো ব্যবসায় নেই বিকে ট্রেডিং। এরপর থেকে একের পর এক সম্পত্তি বিক্রি করেন প্রতিষ্ঠানটির মালিক। এর মধ্যে চাক্তাই এলাকায় পূরবী সিনেমা হলের পাশে বহুতলবিশিষ্ট পোশাক কারখানাসহ ১০০ শতক সম্পত্তি বিক্রি করেছেন মাত্র ১৮ কোটি টাকায়। এরপর নগরীর জাতিসংঘ পার্কের পাশে বিরাট ভূসম্পত্তি বিক্রি করে দেন হারুন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংক এশিয়ার ৯৮ কোটি টাকা পাওনার বিপরীতে বিকে ট্রেডিংয়ের বাকলিয়া, শিকলবাহা, অক্সিজেন, খুলশী ও চকবাজার এলাকার ৩৫০ শতক সম্পত্তি বন্ধক রয়েছে। এর মধ্যে অক্সিজেন এলাকার সম্পত্তির দাম প্রায় শতকোটি টাকা। চকবাজার এলাকার বিকে টাওয়ারের দামও প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, নগরীর অক্সিজেন এলাকায় বাংলাদেশ অক্সিজেনের বিক্রি করা ১৩ কানি জায়গা টেন্ডারে কেনেন বিকে ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী হারুন। বর্তমানে ওই জমির দাম শতকোটি টাকা। কিন্তু ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়ায় ওই জমিসহ বিকে ট্রেডিংয়ের প্রায় ৫০০ কোটি টাকার সম্পত্তি এখন বেহাত হওয়ার পথে।
এদিকে সম্প্রতি ব্যাংক এশিয়ার তিন মামলায় রায় হওয়ার পর এখন পলাতক রয়েছেন হারুন-অর-রশিদ। গতকাল তার ব্যক্তিগত মোবাইলে একাধিকবার ফোন করে পাওয়া যায়নি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন