স্বর্ণ নীতিমালা জারির ছয় মাসের মধ্যে সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে স্বর্ণ শিল্পের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলক মূসক নিবন্ধন সনদ নিতে হবে। একইসঙ্গে মজুদ স্বর্ণালঙ্কারের সুনির্দিষ্ট ঘোষণাও প্রতিষ্ঠানকে দিতে হবে।
পাশাপাশি দেশে বৈধ স্বর্ণের ঘাটতি দূর করতে ব্যাংকের মাধ্যমে স্বর্ণ আমদানির সুযোগ, আমদানিতে বন্ড সুবিধা প্রদান, রফতানি বিকাশে গুচ্ছ সুযোগ থাকছে। বুধবার এসব সুযোগ রেখে স্বর্ণ নীতিমালা-২০১৮-এর খসড়া অর্থনৈতিক বিষয়ক সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন দিয়েছে।
চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ‘স্বর্ণ নীতিমালা-২০১৮’ শিগগিরই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের (কেবিনেট) বৈঠকে পাঠানো হবে। এটি অনুমোদিত হলে আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বক্তব্যে নীতিমালার কিছু অংশ সংযোজন করা হবে।
নীতিমালা প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তার বাজেট বক্তব্যে স্বর্ণ নীতিমালা সংক্রান্ত পৃথক অনুচ্ছেদ রাখতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন।
সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রণীত স্বর্ণ নীতিমালার খসড়া প্রস্তাবের অনুমোদন দিয়ে অর্থনৈতিক বিষয়ক সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভাপতি অর্থমন্ত্রী বলেন, এটি কেবিনেটে অনুমোদনের পর তা কার্যকর হবে।
স্বর্ণ আমদানির বিধান প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, এর আগে দেশে স্বর্ণ আমদানি হয়নি। বরং স্বর্ণ চোরাচালান হতো। এখন বৈধপথে স্বর্ণ আমদানি করা হবে। বৈঠকে কমিটির সদস্য মন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিনিয়র সচিব, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দেশে বৈধপথে স্বর্ণ আমদানির ব্যবস্থা না থাকা এবং আমদানি নিশ্চিত না করে রফতানি বিলাসী পরিকল্পনা, অস্বচ্ছতা ও নৈরাজ্যের নানা দিক তুলে ধরে দৈনিক যুগান্তরে ‘স্বর্ণ ব্যবসার আদ্যোপান্ত’ শীর্ষক চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
এসব প্রতিবেদনের মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশে সময়োপযোগী কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন করা। এছাড়া দুটি ফলোআপ প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সভাপতি গঙ্গাচরণ মালাকার যুগান্তরকে বলেন, খসড়া নীতিমালায় আমাদের মতামতের প্রতিফলন ঘটেছে। এসব বিষয়ে বহু বছর ধরে আমরা বলে আসছি। এসব বিষয় কয়েক মাস আগে দৈনিক যুগান্তরে সুনির্দিষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বলেন, এখন এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব শুভাশীষ বসু যুগান্তরকে বলেন, স্বর্ণ শিল্পকে সুষ্ঠুভাবে ও অধিকতর স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালনা করতে অনুমোদিত নীতিমালায় করণীয় সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে।
এতে ভোক্তা স্বার্থ ও মানরক্ষার ওপরও জোর দেয়া হয়েছে। এছাড়া অর্থমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে দফায় দফায় বসে সবার মতামত নেয়া হয়েছে। তাদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। তাই এর অনুমোদনে কোনো বিতর্ক তৈরি হয়নি।
দেশে স্বর্ণ শিল্পের প্রতিবন্ধকতা দূর ও সুষ্ঠু বিকাশে অনুমোদিত নীতিমালায় ব্যাংকের মাধ্যমে স্বর্ণ আমদানির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আমদানিকারক ব্যাংককে অনুমোদন ও লাইসেন্স নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে দুটি বাণিজ্যিক ব্যাংককে স্বর্ণ আমদানির জন্য অনুমোদিত ডিলার ব্যাংক হিসেবে মনোনীত করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে সাফল্য বিবেচনায় আগ্রহী অন্য ব্যাংককেও এ সুযোগ দেয়া হবে।
এক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে স্বর্ণ ক্রয়কারী ব্যবসায়ীদের ‘গোল্ড প্রকিউরমেন্ট স্টোরেজ অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন অর্ডার ১৯৮৭’-এর আওতায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে লাইসেন্স নিতে হবে। পাশাপাশি তাদের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক সংগঠনেরও বৈধ সদস্য থাকতে হবে।
অথোরাইজড ডিলার (এডি) ব্যাংক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের চাহিদা দাখিলের আহ্বান করবে। স্বর্ণালঙ্কার ব্যবসায়ীরা চাহিদা দাখিলের সময় নিরাপত্তা জামানত হিসেবে ৫ ভাগ অর্থ এডি ব্যাংককে জমা দিতে হবে।
কিন্তু এডি ব্যাংক সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকের কাছে স্বর্ণবার বিক্রয়ের আগে তার আগের বছরের মোট বিক্রয়ের পরিমাণ, সরকারি রাজস্ব পরিশোধ, স্বর্ণের প্রকৃত মজুদ ও রেকর্ডপত্র এবং হিসাব বিবরণীর স্বচ্ছতা যাচাই করবে।
এক্ষেত্রে প্রয়োজনে ভ্যাট কমিশনারেট কার্যালয়ের সহযোগিতা নিতে পারবে। আর বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় শুল্ক-কর আদায় করবে এবং ওই অর্থ তাৎক্ষণিক রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেবে।
এছাড়া নীতিমালায় স্থানীয়ভাবে তৈরি স্বর্ণালঙ্কার রফতানির ক্ষেত্রে রফতানিকারকদের নগদ সহায়তা প্রদান এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি বরাদ্দ দেয়াসহ গুচ্ছ প্রণোদনার সুযোগ রাখা হয়েছে।
পাশাপাশি ভোক্তার স্বার্থরক্ষার গুরুত্বারোপ এবং ক্রয়-বিক্রয় ও রফতানি প্রক্রিয়ায় সরবরাহ করা স্বর্ণালঙ্কারে ‘হলোগ্রাম’ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে বলা হয়, এক্ষেত্রে স্বর্ণের নিজস্ব মান প্রণয়নের এখতিয়ার থাকবে সরকারের হাতে।
রফতানি নীতিতে স্বর্ণ শিল্পকে বিশেষ উন্নয়নমূলক ও রফতানিমুখী শিল্প খাত হিসেবে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। যেসব স্বর্ণ ব্যবসায়ী ভ্যাট ও ট্যাক্সের আওতায় নিবন্ধিত তাদের অনুকূলে স্বর্ণালঙ্কার রফতানিকারক হিসেবে রফতানি সনদ দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। শুধু নিশ্চিত, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য রফতানি আদেশের চাহিদার বিপরীতেই সংশ্লিষ্ট রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানকে স্বর্ণ সরবরাহ করা হবে।
এছাড়া বৈধভাবে স্বর্ণালঙ্কার রফতানি উৎসাহিত করতে স্বনামধন্য রফতানিকারককে স্বর্ণালঙ্কার তৈরির কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে রেয়াতসহ বিভিন্ন প্রকারের প্রণোদনামূলক বিশেষ সহায়তা দেয়া হবে।
রফতানির উদ্দেশ্যে আমদানি করা স্বর্ণের ক্ষেত্রে ডিউটি ড্র ব্যাক পদ্ধতির মাধ্যমে প্রদত্ত শুল্ক ফেরত দেয়া হবে। এছাড়া তৈরি স্বর্ণালঙ্কারে আন্তর্জাতিকভাবে অনুমোদনযোগ্য ধাতু বা অবচয়ের পরিসীমা প্রতিপালন, হলমার্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক, বন্ডেড ওয়্যার হাউজ সুবিধা প্রদান, হস্তনির্মিত ও মেশিনে তৈরি অলঙ্কার রফতানির ক্ষেত্রে মূল্য সংযোজন কর সুনির্দিষ্টকরণ, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্বর্ণ রফতানিকারকদের জমি বরাদ্দ প্রভৃতির সুপারিশ করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে রফতানিসংক্রান্ত সব তথ্য বন্দর-কাস্টম, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকসহ সব পর্যায়ে সমন্বিতভাবে সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি স্বর্ণ খাতে তথ্য সংরক্ষণের জন্য ব্যাংলাদেশ ব্যাংককে স্বর্ণসংশ্লিষ্ট জাতীয় তথ্য ভাণ্ডার সৃষ্টির নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের খসড়া নীতিমালা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, স্বর্ণ শিল্পের ব্যবসা নির্বিঘ্ন করতে বিভিন্ন ধাপে ৪৯ দফা সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে স্বর্ণ আমদানির দ্বার খুলতে ১১ দফা, স্বর্ণালঙ্কার রফতানির বিকাশে ১১ দফা, অভ্যন্তরীণ স্বর্ণবাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে ১১ দফা বাস্তবায়নের সুপারিশ রয়েছে। এছাড়া ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণে পাঁচ দফা, স্বর্ণমান প্রণয়ন, যাচাই ও নিয়ন্ত্রণে চার দফা সুপারিশসহ নীতিমালা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোন মন্ত্রণালয়, সংস্থা বা বিভাগের কার কোন দায়িত্ব থাকবে সেটিও স্পষ্ট করা হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন