স্বামী-স্ত্রী মিলেই একটি পরিবার..স্বামী-স্ত্রী মিলেই একটি পরিবার..
পরিবারে কন্যা, বোন প্রভৃতি দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নারী একপর্যায়ে নিজেকে আবিষ্কার করে স্ত্রীর ভূমিকায়। নতুন সংসারে প্রবেশ করেই তাকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। প্রচলিত পদ্ধতিতে সে এমন একটি নতুন সিস্টেমে প্রবেশ করে, যেখানে আগের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে যেন বাধ্য হয়ে পড়ে। যদিও দেশ, জাতি ও সমাজের প্রতি তার বয়স উপযোগী আরো দায়িত্ব পালনেও সে হয়ে পড়ে অপারগ। এর দায়ভার কি শুধু সে নারীর একার?
শিগগিরই সে আবিষ্কার করে অভিভাবকের জায়গায়। এ থেকে বেশ কিছু সমস্যার সূত্রপাত হতে থাকে। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় সন্তান ধারণের ব্যাপারে ও অন্যান্য বিভিন্ন দাবি পূরণের জন্য মা-বাবাকে খুশি করতে গিয়ে স্ত্রীর ওপর স্বামী কর্তৃক বিভিন্ন চাপ প্রয়োগ, অসন্তুষ্টি লালন ও তা আদায় করতে গিয়ে স্ত্রীর অধিকার সঙ্কীর্ণ করে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটে থাকে। অনেক সময় স্ত্রীর অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়। ছোটখাটো খুঁটিনাটি বিষয়ে শুরু হয় অনধিকার চর্চা। এমনকি নিজ সন্তানদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রেও স্বাধীনতা হরণ করা হয়।
আবার কখনো সংসারে অর্থবিত্তের সমৃদ্ধি না আনতে পারলে তাকে অন্যদের তুলনায় মর্যাদায় খাটো করে দেখানো হয়। নিজের জীবন দর্শন ও স্বাধীনচেতা মনোবৃত্তি প্রকাশ করলে এর উত্তরে আসে ঠাট্টাবিদ্রুপ ও অবহেলা, কখনো কখনো নিজেদের রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়স্বজনের তুলনায় সেই নারীকে ‘অন্য বাড়ির মেয়ে’ বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য পেতে হয়ে। প্রতিবাদ করতে গেলে সেই নারীর প্রতি অভিযোগ ওঠে বড়দের আনুগত্য না করতে পারার। এমনকি সবার সাথে মিলেমিশে চলতে না পারার মতো অপবাদের মুখোমুখি হতে হয়। আর নয়তো তাকে অযোগ্য, অদক্ষ বলে অবহেলা ও করুণার পাত্র হতে হয়। এ থেকে মনে এসব প্রশ্ন উঠে আসা স্বাভাবিক, স্ত্রীর হক আদায় কি আসলে স্বামীর মা-বাবার সন্তুষ্টি অর্জনের সাথে শর্তযুক্ত?
আনুগত্য পাওয়ার ক্ষেত্রে নিজ মা-বাবার মতো শ্বশুর-শাশুড়িও কি একই মর্যাদার দাবিদার হতে পারে? স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা বা অন্যায় হলে তার দায়দায়িত্ব স্বামীর নিজের। স্ত্রীর জীবনযাপনে সহজতর দিকটি উপেক্ষিত হওয়ার পরও স্ত্রী তার স্বামীর আনুগত্য করার জন্য কতটুকু দায়বদ্ধ থাকে? এ সমস্যা মোকাবেলায় সুন্দর পরিবার গঠনে দায়িত্বশীল ভূমিকায় স্বামী-স্ত্রী উভয়ের ভূমিকা কী হওয়া উচিত?
এ বিষয়ে জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবনা নিয়ে আলোকপাত করা প্রয়োজন। ২০০৪ সালের জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাব ৫৮/১৪৭-তে ‘নারীদের বিরুদ্ধে গৃহ নির্যাতন নির্মূল’ বিষয়ে গৃহ নির্যাতন বিষয়ে বলা আছে, ক. গৃহনির্যাতন এমন নির্যাতন, যা সংঘটিত হয় ব্যক্তিগত পরিসরে, সাধারণত দু’জন স্বতন্ত্র ব্যক্তির মধ্যে যারা রক্ত বা অন্তরঙ্গ সম্পর্কে সম্পর্কিত। খ. গৃহ নির্যাতন নারীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে প্রচলিত ও সবচেয়ে কম প্রকাশিত নির্যাতন এবং এর ফলাফল ভুক্তভোগীর জীবনের বিভিন্ন দিককে প্রভাবিত করে। গ. শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনসহ বিভিন্ন আকারে গৃহ নির্যাতন হতে পারে। ঘ. অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও বিচ্ছিন্নতা গৃহ নির্যাতনের অন্তর্ভুক্ত এবং এ ধরনের আচরণ নারীদের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য অথবা ভালো থাকার ব্যাপারে তাৎক্ষণিক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
উপরি উক্ত তথ্য থেকে গৃহ নির্যাতনের আকার, স্বরূপ ও এর প্রভাব সম্পর্কিত নীতিগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কোনো ধরনের আচরণ সূক্ষ্মভাবে গৃহ নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে যেতে পারে, সে বিষয়ে উপলব্ধি করা যায়। এ সমস্যা মোকাবেলায় পরিবার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ইসলাম প্রদর্শিত দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে হলে প্রথমে কুরআনে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ভিত্তির ব্যাপারে জানতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ভিত্তি হলো পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া।
আল্লাহ বলেছেন, ‘আর তার নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সঙ্গিনীদের, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন (৩০:২১), আবার সূরা তাওবার ৭১ নম্বর আয়াতে বলা আছে, ‘মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী একে অপরের অভিভাবক (ওয়ালি), একে অপরের বন্ধু। এ আয়াত থেকে আমরা বুঝি, তারা একে অপরের সাহায্যকারী, তারা একে অপরকে সৎ পরামর্শ দেবে ও নিজেদের জীবন সুন্দর করবে, আল্লাহর বিধান অনুযায়ী পরিবার গড়বে, মানবকল্যাণে, সমাজে তথা বৃহত্তর পরিবারে খলিফার দায়িত্ব পালন করবে। আর খলিফার দায়িত্বের কথা বলতে গিয়ে বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ শাহ আব্দুল হান্নান কুরআন থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টির সময় বলে দিলেন, ‘তোমরা সবাই খলিফা।’
তিনি বললেন, ‘ইন্নি জায়িলুন ফিল আরদি খলিফা’ (২:৩০)। আল্লাহ বলেননি যে, তিনি নারী পাঠাচ্ছেন বা পুরুষ পাঠাচ্ছেন। মানুষকে তিনি খলিফা নামে অভিহিত করলেন। এই খলিফার মর্যাদার মধ্যেই রয়েছে সব ক্ষমতায়ন। নারীর ক্ষমতায়নের ভিত্তি এই খেলাফতের মধ্যে রয়েছে (ইসলামে নারীর মর্যাদা, অধিকার ও ক্ষমতায়ন, নির্বাচিত সঙ্কলন, শাহ আব্দুল হান্নান)। কাজেই পুরুষের পাশাপাশি নারীরও সমাজে অনুরূপ পালনীয় কর্তব্য রয়েছে। সূরা হুজুরাতের ১৩ নম্বর আয়াতে বলা আছে, ‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকি।’ কাজেই স্বামী-স্ত্রী উভয়ই এ মর্যাদা হাসিলের জন্য অগ্রসর হবে, এটাই অধিক প্রত্যাশিত।
স্বামী-স্ত্রী উভয়েই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে এবং আল্লাহর বিধান এই যে, শরিয়তের গণ্ডির মধ্যে থেকে প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ মা-বাবার আনুগত্য করবে। আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য ছাড়া আর কারো আনুগত্য নিঃশর্ত নয়। যার যার নিজ মা-বাবার সেবাযতœ নিজেরই করা যুক্তিসঙ্গত। আত্মীয়দের হক একটু বেশি হতে পারে। স্ত্রীর জন্য স্বামীর মা-বাবা আত্মীয়ের মধ্যে গণ্য। তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার ইহসানেরই অংশ। আল্লাহ ঈমানদারদের উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘যারা তাদের মালিকের ডাকে সাড়া দেয়, নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, নিজেদের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে নিজেদের কর্ম সম্পাদন করে’ (৪২:৩৮)।
সংসারের সিদ্ধান্ত পরামর্শক্রমে হওয়া উচিত। আবার যেহেতু স্বামীকে অতিরিক্ত কিছু দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তাই স্ত্রী স্বামীর আনুগত্য করবে, তবে ন্যায়বহির্ভূত আদেশের ক্ষেত্রে নয়। তারা কোনো কর্ম সম্পাদনে একে অপরের ওপর বাড়াবাড়ি ও জোরজবরদস্তি করবে না। রাসূল সা: বলেছেন, ‘তোমরা সহজ করো, কঠিন করো না।’ আল্লাহ সহজতা চান, কঠোরতা নয়। নিজের করণীয় কর্তব্যের ব্যাপারে সে নিজেই দায়িত্বশীল। এ জন্য পরিবারের অন্য সদস্যদের জীবন কঠিন করে ফেলা উচিত নয়। ইসলামি শিক্ষা সিরিজ গ্রন্থে ড. জামাল আল বাদাবি বলেছেন, ‘ইসলামে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর আনুগত্য প্রশ্নাতীত ও নিরঙ্কুশ নয়। অন্ধ-নির্বিচার আনুগত্য ইসলামবিরোধী। সে (স্বামী) যা আদেশ করবে তা হতে হবে সামাজিক, ন্যায্য, যৌক্তিক ও সুন্দর। কোনো স্বামী স্বৈরাচারীভাবে স্ত্রীর সাথে ব্যবহার করতে পারবে না। শূরা (পারস্পরিক পরামর্শ) একটা অত্যাবশ্যকীয় ইসলামি বিষয়। সমাজ ও পরিবারের সব স্তরে এর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।’
যেহেতু মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী একে অপরের বন্ধু ও সাহায্যকারী, কাজেই তারা একে অপরকে দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তুলবে ও কল্যাণের কাজে সহযোগিতা করবে এবং এভাবে তারা নিজ নিজ কাজের জবাবদিহিতা সম্পর্কে সজাগ থাকবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন