ভালো গল্প চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে রতœসমান। একটি নিখুঁত, মৌলিক ও জীবনঘনিষ্ঠ গল্প দর্শকদের দারুণভাবে আকর্ষণ করে। গল্পের নৈকট্য ভীষণ জরুরি, জীবন থেকে নেওয়া গল্পই মানুষকে টানে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রগুলোর বেশিরভাগই ফ্যান্টাসিতে ভরা। নকল কাহিনি প্রাধান্য বিস্তার করে আছে অধিকাংশ ব্যবসায়িক চলচ্চিত্রে। দক্ষিণ ভারতের চলচ্চিত্রগুলোর কাহিনি দু-তিন ধাপে নকল হয়ে এসে পৌঁছে আমাদের চলচ্চিত্রে। দর্শক নকল ছবি দেখে হতাশ হয়ে বের হন সিনেমা হল থেকে...।
চলচ্চিত্র হচ্ছে শিল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। কারণ এতে প্রায় সব মৌলিক শিল্পের সমন্বয় থাকে। কিন্তু বর্তমান চলচ্চিত্রে দেখে একটা প্রশ্নই মনে আসেÑ সত্যিই কি তাই? গল্পই তো মৌলিক নয়! সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, ‘আমি যখন কোনো মৌলিক কাহিনি লিখি, তখন গল্পগুলো খুঁজে নিই আমার পরিচিত মানুষদের ভেতর থেকে, আর সেই সব পরিবেশ থেকে, যার সঙ্গে আমি পরিচিত। উনিশ শতকের কাল্পনিক কাহিনি আমি লিখি না।’ ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’, ‘মহানগর’, ‘চারুলতা’, ‘অপু ত্রয়ী’, ‘জলসাঘর’-এর মতো অনবদ্য চলচ্চিত্রগুলোয় তিনি কথা রেখেছেন। তুলে এনেছেন মাঠঘাটে, লোকালয়ে মানুষের জীবনে ছড়িয়ে থাকা গল্পগুলো। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বেশ কিছু খ্যাতিমান গল্পাকারের আবির্ভাব হয়েছে। এ তালিকাটা অনেক লম্বা। নির্মাতা কাজী হায়াৎ বলেন, ‘একটা সময়ে চলচ্চিত্রপাড়ায় সাহিত্যিকদের বেশ আনোগোনা ছিল। এটাই তো স্বাভাবিক। শিল্প সাহিত্য তো সব একসঙ্গে থাকবে। সিনেমাও একটা শিল্প। সেসব সাহিত্যিক এখন হারিয়ে গেছেন। যারা সাহিত্য রচনা করতেন তারা চলচ্চিত্রের জন্য গল্প লিখছেন না। দেশে সাহিত্যিকের অভাব না থাকলেও সিনেমার জন্য গল্প লেখার মানুষ নেই। অনেক শিক্ষিত লোক আছেন আমাদের চারপাশে; যারা চলচ্চিত্রের জন্য ভালো গল্প বা কাহিনি চাইলেই লিখতে পারেন। ভালো চলচ্চিত্রের জন্য মৌলিক গল্পের যেমন প্রয়োজন, ঠিক তেমনি ভালো চিন্তা-চেতনার লেখকও প্রয়োজন।’
অনেকে বলেন বড় বাজেট ছাড়া ভালো সিনেমা সম্ভব নয়। এটা পুরোপুরি ভুল। ইরানি ছবিগুলোই দেখুন। নিজেদের গল্প দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ নাম করেছে ইরান। অথচ আমরা আমাদের গল্প থেকে সরে এসেছি। আমাদের গল্পের জন্য কিন্তু খুব বেশি বাজেট প্রয়োজন নেই। মাসুম রেজা বলেন, ‘গল্পের জন্য খুব বেশি বাজেট রাখা হয় না। এটাই বাস্তবতা এবং সত্যি। যেখানে সবাই বলে একটা গল্পই চলচ্চিত্রের প্রাণ। আমাদের দেশে গল্প লেখকদের সঠিক সম্মানও নেই।’
একটা ভালো গল্প হলে মানুষ চলচ্চিত্র দেখবেই। দর্শক এখন বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের পাশাপাশি ভিন্ন ধাঁচের চলচ্চিত্রও দেখতে চায়। বর্তমান সময়ের অধিকাংশ চলচ্চিত্রের গল্প লিখে থাকেন আব্দুল্লাহ জহির বাবু। তিনি বলেন, ‘আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে যে মোটেও মৌলিক গল্প হচ্ছে না, এ কথাটা ভুল। উল্টো অভিযোগ কিন্তু আমরাও করতে পারি। দর্শক মৌলিক গল্প নিতে চায় না। কারণ মৌলিক গল্পে রসকষ কম।’
গত বছরের সবচেয়ে ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র ছিল ‘আয়নাবাজি’। এর নির্মাতা অমিতাভ রেজা বলেন, ‘মৌলিক অদেখা, না শোনা একটি গল্প চাই ও চেয়েছি সব সময়। কিন্তু সেই গল্পে আমার নিজস্বতা, আমাদের সমাজ, বাস্তবতা থাকতে হবে। আবার সেই গল্পে কোনো জটিলতা ঢুকিয়ে মাথার ওপর থেকে নিয়ে যেতে চাইনি। আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজেদের গল্প বলা, যা একেবারে মৌলিক।’
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অভিনেত্রী চম্পা কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। এ পুরো সময়টাতেই চলচ্চিত্রকে খুব কাছ থেকে বিভিন্ন কোণে দেখেছেন তিনি। তার ধারণা, গল্পের অভাবে ভুগছে আমাদের চলচ্চিত্র। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে একসময় গল্পের বৈচিত্র্য ছিল। বৈচিত্র্যপূর্ণ সেসব গল্পের ছবিগুলো দর্শকদের প্রতিনিয়ত আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। কিন্তু ইদানীং বাংলা সিনেমার গল্পে কোনো নতুনত্ব পাওয়া যাচ্ছে না। ভালো গল্প একেবারে নেই বললেই চলে।’
‘ভালো গল্প পেলে অভিনয় করব’, এমন কথা অনেক অভিনয়শিল্পীর মুখেই শোনা যায়। পূর্ণিমা বলেন, ‘আমি কাজে ফিরে নিয়মিত হতে চাই। তবে ভালো গল্পের অভাবে কাজ করা হয়ে উঠছে না। আমার কাছে গল্প হচ্ছে চলচ্চিত্রের প্রাণ। সেই গল্পই যদি না থাকে, তা হলে অভিনয় করে লাভ কী?’
তরুণ প্রজন্মের নির্মাতাদের মধ্যে অন্যতম হিমেল আশরাফ। তিনি বলেন, “আমার সেøাগান হচ্ছে, ‘আমাদের গল্পে আমাদের সিনেমা’। এটা হচ্ছে আমার বিশ্বাসের জায়গা। কিন্তু আমাদের সিনেমায় আমাদের গল্প নেই। আমাদের সিনেমা ধ্বংসের যদি অনেক কারণ চিহ্নিত করেন সেগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ভালো গল্পের অভাব।”
জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আবদুল আজিজ বলেন, ‘ভিত্তিহীন গল্প আর নকল ছবি দেখতে দেখতে দর্শকেরা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তারা এখন ভালো ছবিও দেখতে চান না। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য ভালো ও মৌলিক গল্পের ছবি নির্মাণ করতে হবে।’ গুণী নির্মাতা আমজাদ হোসেন বলেন, ‘ছবি ভালো গল্পের না হলে দর্শক স্বাভাবিকভাবেই হলে যাবেন না। পাশাপাশি নির্মাণশৈলীও ভালো হতে হবে। তরুণ পরিচালকেরা বেশি কিছু না জেনেই সিনেমা বানান, এটাই বড় সমস্যা।’ পরিচালক ছটকু আহমেদ বলেন, ‘একটা সময় ছিল ভালো চলচ্চিত্রের গল্পের জন্য একাধিক মিটিং হতো। পরিচালক, প্রযোজক, কাহিনিকার মিলে ছবির কাহিনি নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলত বিস্তর। কোনো সাজেশন থাকলে তারা দিতেন। আর এখন তো বিদেশি গল্পের ছবি কোনোরকম উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে লিখে দেওয়া হচ্ছে।’ পরিচালক মালেক আফসারী বলেন, ‘মূলধারার ছবিতে মৌলিক গল্প দর্শক গ্রহণ করবে না। বিশ্বের বেশিরভাগ ছবিই কোনো না কোনো ছবির কাহিনি থেকে নেওয়া।’ অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী বলেন, ‘আমি এর আগেও বেশ কিছু পত্রিকায় বলেছি, আমরা ভালো গল্প পাচ্ছি না। এজন্য চলচ্চিত্রগুলো দর্শকের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না।’ মৌসুমী বলেন, ‘ভালো গল্পের খুব অভাব আমাদের এখানে। তেমন গল্প পেলে আবারও হয়তো পরিচালক মৌসুমীর প্রত্যাবর্তন ঘটবে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন