রোকসানা হাবিব প্রায়ই খেয়াল করেন মেয়ে তাহিয়া স্কুলের টিফিন না খেয়ে বাসায় ফেরত নিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করলে বলে, ক্ষুধা ছিলো না, খেলতে খেলতে সময় পাইনি অথবা অমুক ফ্রেন্ডের জন্মদিন ছিলো, তাই সে সবার জন্য চাইনিজ এনেছিল ইত্যাদি। ক্লাস ফোরে পড়া তাহিয়ার এমন আচরণে তার মা বিপাকে পড়েছেন।
এর মধ্যেই হঠাৎ একদিন মেয়ের স্কুল থেকে বাসায় ফোন আসে। জানানো হয়, তাহিয়া প্রায়ই স্কুলে টিফিন নিয়ে আসে না। টিফিন পিরিয়ডে মন খারাপ করে বসে থাকে। তাকে মনে করে টিফিন দেয়ার কথা জানাতেই স্কুল কর্তৃপক্ষের এ ফোন। সব শুনে তো তাহিয়ার মা আকাশ থেকে পড়েন। কারণ, প্রতিদিন তিনি খুব যত্ন করে সন্তানকে টিফিন দিয়ে দেন। পইপই করে মেয়েকে বলেন, যেন সব টিফিন শেষ করে।
এই ঘটনার পর তাহিয়াকে ভালো করে জিজ্ঞাসা করায় সে জানায়, মায়ের দেয়া টিফিন নিয়ে তাকে স্কুলে লজ্জায় পড়তে হয়। তাই টিফিন বের না করে সে বলে টিফিন বক্স ব্যাগে তুলতে ভুলে গেছে।
তাহিয়ার টিফিনের মেন্যুতে থাকে- রুটি-ওমলেট, এগ ব্রেড টোস্ট, নুডলসের মতো স্বাস্থ্যকর খাবার। তাহিয়ার এসব খাবার পছন্দ নয়। প্রতিদিনই চিকেন ফ্রাই, বার্গার, পিৎজা- ফাস্টফুড জাতীয় খাবার টিফিন দেয়ার জন্য জেদ করে সে। অবশ্য ওকেও তেমন দোষ দেয়া যায় না। তার বন্ধুরা টিফিনে এসব খাবারই আনে। তাই সে লজ্জায় রুটি-ওমলেট ভর্তি টিফিন বক্সটা স্কুলব্যাগ থেকে বেরই করতে পারে না।
তাহিয়ার মতো এখনকার বেশিরভাগ শিশুই টিফিনে চায় চিকেন ফ্রাই, পিৎজা বা বার্গার। যা একেবারেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। শিশুদের বায়নার কাছে বাবা-মাকেও হার মানতে হয়। এমনই জাঙ্কফুড পাগল শিশু শুভ্র। ধানমন্ডির মাস্টার মাইন্ড স্কুলে পড়ে সে। মা মাইশা তাবাসসুম জানান, ছেলের এই টিফিনের বায়না নিয়ে খুব চিন্তিত তিনি। কোনোভাবেই চান না- সন্তান এভাবে জাঙ্কফুডে অভ্যস্ত হয়ে পড়ুক। কিন্তু টিফিনে সে একেবারেই স্বাস্থ্যকর খাবার নিতে চায় না। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘আমরা ভাত-আলুভাজি টিফিনে নিয়ে যেতাম খুশি মনে। আর এখন টিফিনেও বাচ্চাদের প্রেস্টিজ নির্ভর করে ‘।
হ্যাপি টাইমস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ক্লাস টুয়ের ছাত্র আহনাফ। বাবা তাকে প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে যান। মা কর্মজীবি, সময় পান না। তাই ছুটির পর আহনাফকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নানা আব্দুল্লাহ আল মামুনের। তিনি জানান, বাসা থেকে টিফিন দেয়া হলেও ছেলে প্রতিদিন চিপস, জুস বা ওয়েফারের বায়না করে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার স্কুল-কলেজের ক্যন্টিনগুলোতেও পাওয়া যায় না স্বাস্থ্যসম্মত কোনো খাবার। আবার অনেক স্কুলের নিজস্ব কোনো ক্যন্টিনও নেই। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোর ক্যন্টিন ভরা মিনি বার্গার, মিনি পিৎজা, পেস্ট্রি, চিপস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, জুস,সামুচা, চিকেন প্যাটিস, কোমল পানীয়ের মতো খাবারে।
এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাইরের খাবারের জন্য শিশুরা বায়না করবেই। এসব খাবারের অপকারিতা সম্পর্কে ওদের জানাতে হবে। না কিনে বরং ঘরেই বাইরের খাবারের মতো টিফিন তৈরি করে দেয়া যেতে পারে। মা-বাবার উচিত নয়, বাইরের খাবারের সঙ্গে বাচ্চাদের পরিচিত করানো। মাঝেমধ্যেই বাইরে খেতে যাওয়ার অভ্যাস বা শিশু বায়না করলেই খাবার কিনে দেওয়া ঠিক নয়। স্কুলে শিশুকে টিফিন খাওয়ার জন্য টাকা দেওয়াও ঠিক নয়। এতে সে বাইরের খাবার কেনার প্রতি উৎসাহী হবে।
বিভিন্নভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে শিশুদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুললে শিশুরা পুষ্টিকর খাবারও খেতে চাইবে। স্যান্ডউইচে গাজর, টমেটো আর মটরশুঁটি দিয়ে চোখ, নাক, মুখ বানিয়ে দিতে পারেন। নুডলসে সবজি দিয়ে হাসিমুখ বানিয়ে দিন। অথবা পাউরুটিতে ঘরে বানানো জেলি লাগিয়ে তিন বা চারকোনা করে কেটে ঘরের আকৃতি দিতে পারেন। ঘরেই ফলের রস তৈরি করুন স্বাস্থ্যসম্মত রেসিপি দেখে। সন্তানের পছন্দ অনুযায়ী এমন সব চমৎকার আইডিয়া তো আপনিই বের করে ফেলতে পারেন। শুধু টিফিনেই না, বিকেলের নাশতাও এভাবে সাজিয়ে দিন তাদের।
মনে রাখবেন বাচ্চাকে বকাঝকা করা কোনো সমাধান নয়। তার পছন্দের খাবার বাড়িতেই স্বাস্থ্যসম্মত করে বানিয়ে খাওয়ানোর অভ্যাসেই সমাধান আসবে।
বাংলা ইনসাইডার
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন