ঋতুরাজ বসন্তের ফাগুন হাওয়ায় উন্মাতাল শহরের যান্ত্রিক মানুষেরাও। সবার মনেই যেন ভালোবাসার ছোঁয়া। অথচ সকাল থেকেই এফিডিসিতে ঝাড়ু হাতে দেখা গেল ঢাকাই চলচ্চিত্র অঙ্গনের তারকাদের। ভালোবাসা দিবসে পরিচ্ছন্নতার অঙ্গীকার নিয়ে এফডিসির ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার অভিযানে নেমে যান নায়ক-নায়িকারা।
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন যৌথ উদ্যোগে এই পরিচ্ছন্ন অভিযান সকাল ১১ টায় শুরু হয়। ঝাড়ু হাতে চলচ্চিত্রের এই আঁতুড়ঘরের রাস্তা ও অলিগলিতে জমে থাকা ময়লা পরিষ্কার করা শুরু করেন শিল্পীরা।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন চিত্রনায়ক রুবেল, শিল্পী সমিতির সভাপতি ও খল অভিনেতা মিশা সওদাগর, সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান, রিয়াজ, পপি, কেয়া ডিপজল, শাহনূর, রোজিনা, নূতন। নতুন চিত্রশিল্পীদের মধ্যে ছিলেন বিপাশা কবির, জয় চৌধুরী, অধরা খান, নাদিম, শান প্রমুখ। অন্যদিকে পরিচালকদের মধ্যে এই কর্মসূচীতে উপস্থিত ছিলেন পরিচালক মুশফিকুর রহমান গুলজার, শাহ আলম কিরণ এবং গাজী মাহবুব প্রমুখ। তারকা শিল্পী ছাড়াও আরো এই পরিচ্ছন্ন অভিযানে অংশ নিয়েছেন ঢাকা উ. মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম, সিটি কর্পোরেশনের সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট এর ডিজি কমোডোর আব্দুর রাজ্জাকসহ সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা। তারা সবাই মিলে এফডিসি পরিচ্ছন্ন করতে ঝাড়ু নিয়ে রাস্তায় নেমে যান।
জানতে চাইলে শিল্পী সমিতির সাধারন সম্পাদক ও চিত্রনায়ক জায়েদ খান বলেন, শিল্পীরা হচ্ছে একটি পরিবার আর এফডিসি হচ্ছে শিল্পীদের ঘর। তাই আমরা আমাদের ঘরকে পরিছন্ন করছি। আমরা বলতে চাই, সচেতন নাগরিক হিসেবে আপনারা চারপাশ পরিষ্কার রাখুন, তাহলেই দেশটা পরিচ্ছন্ন থাকবে।
অভিনেতা রিয়াজ বলেন, আজকের এই পরিচ্ছন্ন অভিযানের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘মন সুন্দর যার, সে রাখে দেশ পরিষ্কার’। আমরা সবাই আমাদের প্রাণের প্রিয় এই দেশকে একটু সচেতন হলেই সুন্দর করে পরিচ্ছন্ন রাখতে পারি।
এর আগে চলচ্চিত্র নির্মাণের সূতিকাগার বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (এফডিসি) বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানটির কোনো জৌলুসই আর অবশিষ্ট নেই। শুটিং ফ্লোরগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। কালারল্যাব, এডিটিং, সাবটাইটেল মেশিন সব অকেজো। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুণ। নির্মাতাদের কাছ থেকে আদায় হচ্ছে না বকেয়া। ফলে ব্যাংকে গচ্ছিত এফডিআর ভাঙিয়ে প্রতিমাসে বেতন দিতে হচ্ছে ২৪০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর। সেই সঙ্গে দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
বর্তমানে এফডিসিতে আধুনিকায়ন প্রকল্পের আওতায় উন্নতমানের পাঁচটি সনি এফ-৫৫ ও একটি রেড স্কারলেট ক্যামেরা, পাঁচটি ডিজিটাল এডিটিং মেশিন, একটি কালার গ্রেডিং মেশিন, উন্নতমানের লাইট ও দুটি ক্রেনসহ অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এলেও একদিকে চলচ্চিত্র নির্মাণ কম অন্যদিকে নানা লোভনীয় অফারের কারণে অনেক নির্মাতা প্রাইভেট সেক্টরে যন্ত্রপাতি ও শুটিং ফ্লোর ব্যবহার করছেন। ফলে আয় বঞ্চিত হচ্ছে এফডিসি।
চলচ্চিত্র নির্মাতারা বলছেন, দেশে সিনেমা হলের সংখ্যা ১২০০ থেকে কমে ২৫০টিতে এসে ঠেকেছে। নতুন হল হচ্ছে না। পুরনো হলগুলো দর্শক শূন্যতার কারণে ভেঙে সুপারমার্কেট বা গুদামঘর করা হচ্ছে। চলচ্চিত্র নির্মাণ কমছে প্রতি বছর। নব্বইয়ের দশকেও রমরমা ব্যবসা ছিল। তখন বছরে ১০০টি ছবির মধ্যে ৯৫টিই এফডিসিতে তৈরি হতো। ২০১২ সালে থার্টি ফাইভ মিলিমিটার থেকে ডিজিটালে যাত্রা শুরু করে ঢাকার চলচ্চিত্র। সেই সঙ্গে প্রযুক্তির উত্কর্ষের তাকলাগানো চমক ধারণ করতে পারেনি। ৬০ বছর বয়সী এফডিসি প্রযুক্তির ধাবমান গতি থেকে পেছনে হটে যায়। একদিকে ভারতীয় ছবির বাজার আর স্যাটেলাইটের অনুষ্ঠানের প্রভাব, অন্যদিকে দর্শকদের রুচি ও চাহিদার পরিবর্তন পূরণে মূল ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ কমে গেছে। সবাই গল্প প্রধান ও দক্ষিণ ভারতীয় নকল চলচ্চিত্র এবং ভারতের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায় সিনেমা বানাতে ব্যস্ত। ওইসব সিনেমার গল্প লোকেশন হিসেবে এফডিসিকে সমর্থন করছে না। ফলে এফডিসির কাজ কমে গেছে। ফলে অব্যবহূত মেশিনপত্র, ফ্লোর ও সরঞ্জামাদি সচল রাখতে বিকল্প হিসেবে এফডিসিতে দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞাপন, নাটক বা টেলিভিশন চ্যানেলের জন্য ভাড়া দেয়া হচ্ছে।
এদিকে এফডিসিতে যারা কাজ করছেন তাদের অনেকেই প্রায় সময় কর্মবিহীন থাকেন। এফডিসিতে সংরক্ষিত দুর্লভ ছবির নেগেটিভগুলোও অবহেলার কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নির্মাতা আমজাদ হোসেন জানান, বিভিন্ন শাখায় জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘কসাই’ এফডিসিতে নেগেটিভ জমা ছিল। তারা এটিকে যত্ন না নেয়ায় নেগেটিভ গলে গেছে। শুধু ‘কসাই’ নয়, এমন অসংখ্য ছবি এফডিসির অবহেলায় নষ্ট হয়ে গেছে। ১৯৮০ সালে ছবিটি মুক্তি পায়। ছবিটি ওই বছর মস্কো চলচ্চিত্র উত্সবে প্রদর্শিত হয়। এফডিসিতে ঢুকলে মনে হবে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ।এক সময়ের অন্যতম আকর্ষণীয় ঝরনা স্পট এখন নোংরা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ। কড়ইতলাও আবর্জনার ভাগাড়।
এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন কুমার ঘোষ জানান, চরম আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছে বিএফডিসি। আয় বর্তমানে মাসে ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকার বেশি নয়। ব্যাংকে থাকা এফডিসির এফডিআর ও জমানো টাকা থেকে পাওয়া সুদ এবং নির্মাতাদের কাছ থেকে পাওনা বকেয়া টাকা আদায় করে বেতনের বাকি অংশ ও অন্যান্য খরচ বহন করা হচ্ছে। মাসে যদি প্রতিদিন ফ্লোর ভাড়া ও যন্ত্রপাতি সম্পূর্ণভাবে ভাড়াও হয় তারপরেও বেতনের ১ কোটি ১৬ লাখ টাকা আয় কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, ২০১১ সাল পর্যন্ত ল্যাব থেকেই ৮০ ভাগ আয় হতো। সর্বশেষ একটি ছবির প্রিন্ট বাবদ আয় ছিল ৮০ হাজার টাকা। এই আয় দিয়েই এফডিসি চলত। ২০১২ সাল থেকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ছবি নির্মাণ শুরু হলে ধীরে ধীরে ল্যাবে কাজ কমে আসতে থাকে। গত দু-তিন বছর ধরে ল্যাব বন্ধ। এখন আর ছবি নির্মাণে নেগেটিভ ব্যবহার না হওয়ায় প্রিন্টের প্রয়োজন হয় না। মাঝে মধ্যে ফিল্ম আর্কাইভ ও ডিএফপির জন্য দু-একটি প্রিন্টের অর্ডার পাওয়া গেলেও তা একেবারেই অপ্রতুল। প্রায় জনশূন্য ও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে প্রশাসনিক ভবনের নিচ তলায় অবস্থিত জহির রায়হান ল্যাবটি। তিনি বলেন,এটিকে সময়োপযোগী করে তুলতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আবারো ঘুরে দাঁড়াবে এফডিসি।
এদিকে এফডিসির আশির দশক থেকে বকেয়ার পরিমাণ ১০ কোটি টাকারও বেশি। এফডিসি প্রযোজকদের কাছে দ্রুত বকেয়া পরিশোধের জন্য নোটিস পাঠায়। কিন্তু এফডিসিতে এন্ট্রি করা ঠিকানায় ৯৫ ভাগ প্রযোজককে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে বকেয়া পাওনার টাকাও আদায় হচ্ছে না।
এদিকে বিএফডিসিতে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবসরে যাচ্ছেন তারা অবসরকালীন ভাতা পাচ্ছেন না। গত ৭ বছরে ৪০-৪৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী অবসরে গেছেন। তাদের মধ্যে কেউ দশ, কেউ বিশ, কেউবা ত্রিশ লাখ টাকা অবসরকালীন ভাতা পাবেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন