মঙ্গলবার দুপুর ১২টা। নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের শিশুকানন কিন্ডারগার্টেন। সেখানে দেখা গেল দুই কিশোরী ইংরেজি বিষয়ে লেখালেখি করছে। এরমধ্যে একজন মৌরি আখতার রিয়া। মাথায় আধুনিক ডিজাইনের বাহারী রঙের হিজাব। মৌরি জানালো- 'মূলত চুল আবৃত করতেই হিজাব পরি। তবে এটা এখন আমার ফ্যাশন। হিজাব পড়লে নিজেকে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়।'
শুধু এই কিশোরীই নয়, মঙ্গলবার বসন্তের প্রথম দিনে সারাদেশে কিশোরী-তরুণীসহ সব বয়সী নারীদের ফ্যাশনের অন্যতম অনুসঙ্গ ছিল হিজাব। বাসন্তীসহ বিভিন্ন রঙ ও ডিজাইনের হিজাব নারীদের ফ্যাশনে এনে দিয়েছিল ভিন্নমাত্রা।
বিকেলে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও কারমাইকেল কলেজে অধিকাংশ নারীকেই দেখা গেছে বাসন্তিসহ নানা রঙের শাড়ি কিংবা জামার সাথে মাথায় বাহারি ডিজাইনের হিজাব। রংপুর মহানগরীর রাস্তাঘাটেও দেখা গেছে একই চিত্র। মনে হয়েছে নারীদের হিজাবের দিকে আকৃষ্ট হওয়ার মাত্রা বেড়েছে। একসময় পাশ্চাত্যের আদলে শর্ট কামিজ, খোলামেলা পোশাক পরার যে ধুম লেগেছিল, তা থেকে বেরিয়ে আসছেন নারীরা। অনেকে হিজাবকে নিয়েছেন ফ্যাশন হিসেবে। স্কুল-মাদরাসা থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা হিজাবকেই পছন্দের ফ্যাশন হিসেবে গ্রহণ করেছে।
হিজাব শুধু ফ্যাশনই নয়, এটি নারীর মর্যাদাকেও বাড়িয়েছে বহুগুন। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে হিজাবের ব্যাপক প্রচলন ঘটেছে। শাড়ি বা জামার সাথে হিজাব পরে কর্মক্ষেত্রসহ বিভিন্ন স্থানে নারীদের উপস্থিতি তাদের আভিজাত্য বাড়িয়েছে। প্রাচীন বাংলার জনগণের মুসলিম ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, হালের নারীরা ফিরিয়ে আনছেন। যে দেশের নারীরা বেশি বোরকা কিংবা হিজাব পরবেন-তারা অধিকতর ডান, গোঁড়া বা রক্ষণশীল বলে যে বুলি আওড়ানো হচ্ছিল বাংলাদেশের নারীরা তাকে চপেটাঘাত করে হিজাবকে নান্দকিভাবে উপস্থাপন করেছে।
রাজনীতি থেকে রান্নাঘর। সবখানেই তাই হিজাবের জয়জয়কার। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আদালতে হাজিরা দেয়ার সময় হিজাব পরিহিত আফরোজা আব্বাসের উপস্থিতিও অনেক নারীকে আকৃষ্ট করেছে। টিভি সেটের সামনে বসা
দর্শকদের মন্তব্য থেকে তা প্রতীয়মান।
রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্রী শারমিন আখতার নয়া দিগন্তকে বলেন, জাতি হিসেবে মুসলিমরা সেরা। তাই তাদের ফ্যাশনের নান্দনিকতাও ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে সেরা হওয়া উচিৎ। এখন তাই আমরা মুসলিম নারীরা শালীন পোশাকের সাথে হিজাব ব্যবহার করে বিশ্বের সর্বাধুনিক নারী হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছি। যা এবারের বসন্তবরণকে আরো সুন্দর করেছে।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী মুনিরা আখতার বললেন- মুসলিম নারীদের যারা কথিত গোড়া রক্ষণশীল বলে গালমন্দ করার চেষ্টা করে থাকেন। হিজাব পরিধান করে বড় বড় অনুষ্ঠানসহ সর্বক্ষেত্রে মুসলিম নারীদের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ তাদের মুখে কুলুপ এটে দিয়েছে। এর মাধ্যমে ইসলাম যে নারীকে সবচেয়ে বেশি মর্যাদা দিয়েছে সেটি যেমন উচ্চকিত হয়েছে। ঠিক তেমনি আমরা সম্মানও পাচ্ছি। বসন্ত বরণে আমি হিজাব অংশ নেয়ায় সবাই রেসপেক্ট করেছে।
রংপুর হোমিও কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মুমতাহিনা কাউছার। তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন- প্রথমত একজন মুসলিম নারী হিসেবে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতেই হিজাব পরি। কিন্তু এর সুবিধা অনেক। একদিকে হালের সব চেয়ে চমৎকার ফ্যাশন এই হিজাব। অন্যদিকে চলতে ফিরতে খারাপ মানসিকতার লোকদের কুনজর থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এছাড়াও হিজাব পড়া নারীদের সবাই সম্মান করে। কিন্তু খোলামেলাভাবে পোশাক পড়লে মানুষ অন্যভাবে দেখে।
তিনি বলেন- সবচেয়ে বড় উপকার হয় স্বাস্থ্যের। ধুলাবালি থেকে সেভ থাকা যায়। কারণ নারীদের চামড়া নরম। ধুলবালি পড়লে দ্রুত চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। বাড়তি পরিচর্যার দরকার হয়। তিনি বলেন, ফাগুনের প্রথম দিনে তাই ফ্যাশন হিসেবে আকর্ষণীয় হালকা হলুদ রঙের হিজাবকেই বেছে নিয়েছি আমি।
কারমাইকেল কলেজের ইসলামের ইতিহসের ছাত্রী ফারহানা আখতার নয়া দিগন্তকে বলেন, খোলামেলা পোশাকের এ সময়ে আমরা যে হিজাব ব্যবহার করছি, এটা খবুই তাৎপর্যপূর্ণ। এর মাধ্যমে মুসলিম নারী হিসেবে আধুনিক বিশ্বকে লিড দিতে পারছি আমরা। এবারের বসন্তবরণে আমরা ফ্যাশনে হিজাবকে গুরুত্ব দিয়েছি। নিঃসন্দেহে এটা নারীদের নান্দনিক সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে অনেকে মাথায় হিজাব পড়লেও বুকের একপাশে ওড়না ব্যবহার করেন। এটা দৃষ্টিকটু।
রংপুর ধাপসাতপাড়া মডেল কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ আনম হাদিউজ্জামান নয়া দিগন্তকে বলেন, নারীদের হিজাব পড়ার এই মানসিকতা একটি একটি সভ্য সমাজ বিনির্মাণের জন্য ইতিবাচক দিক। কথিত পাশ্চাত্য সভ্যতায় নারীদের যে ভোগের সামগ্রী হিসেবে খোলামেলাভাবে উপস্থাপন করা হয়, সেই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে নারীদের শালীন পোশাক পরিধান একটি পদক্ষেপ। বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে এখন নৈতিকতাবোধ সৃষ্টি হচ্ছে। তারা গড্ডালিকা প্রবাহে থাকতে চান না। এছাড়াও মানুষের মধ্যে এখন যে ধর্মই পালন করুক না কেন, নিজ ধর্মের অনুশাসন মেনে চলার আগ্রহ বেড়েছে। একটি মুসলিম প্রধান দেশে নারীদের এই মানসিকতা একটি সভ্য সভ্যতা বিনির্মাণে সহায়ক হবে।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন স্টাডিজ সেন্টার প্রিয় পোশাক জানতে একটি সমীক্ষা করে। ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পরিচালিত সমীক্ষায় ৩২ শতাংশ পাকিস্তানি নারী-পুরুষ বলেছেন, তাদের প্রিয় পোশাক নেকাব। সমীক্ষায় থাকা দেশগুলো ছিল- তিউনিশিয়া, পাকিস্তান, মিশর, ইরাক, লেবানন, সৌদি আরব এবং তুরস্ক। ওই সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়, ইরান, ইরাক ও লেবাননে এই পোশাকের চল রয়েছে। এতে হাত ও মুখের কিছু অংশ খোলা থাকে। তবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে যে পোশাকটি রয়েছে, সেখানে মাথায় স্কার্ফ ধরনের এবং লম্বা পোশাকের সঙ্গে পুরো মুখাবয়ব খোলা থাকে। মিশরের নারীদের ৫২ শতাংশ এটি পরেন।
রিপোর্ট বলেছে, মুসলিম বিশ্বের নারীরা এই পোশাকটিকেই বেছে নিয়েছেন। বিশেষ করে ইরান ও তুরস্কের আধুনিক নারীরা এই পোশাক পছন্দ করছেন। এর সঙ্গে আরো একটি স্টাইল রয়েছে। সেটি হলো, হাল ফ্যাশনের রঙিন লম্বা ধরনের পোশাক, কিন্তু মাথায় বড় মাপের ওড়না দিয়ে মাথা শিথিলভাবে মোড়ানো।
এদিকে মুসলিম নারীদের এই সর্বাধুনিক হিজাব ফ্যাশনেও বসন্তের আবহ তৈরিতে কাজ করেছে ফ্যাশন হাউজগুলো। তারা বাহারী ডিজাইনের নানা মাত্রিকতার হিজাব তৈরি করে, যা বিক্রি হয়েছে ধুমছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন