যতীন্দ্রমোহন বাগচীর সেই অমর কবিতা আমাদেরকে বাঁশ গাছের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়: ‘বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই?’
বিশ্বে বাঁশের প্রজাতি সংখ্যা দেড় হাজার। কোনো কোনো প্রজাতির বাঁশ ১৩০ ফুট লম্বা হতে পারে। অথচ বাঁশ তৃণ ছাড়া আর কিছু নয়। দেখা গেছে কোনো কোনো প্রজাতির বাঁশ দৈনিক দেড় থেকে দুই ইঞ্চি পর্যন্ত বাড়ে। অন্য কোনো উদ্ভিদ সাধারণত বাঁশের মতো এত দ্রুত বাড়ে না। এটা চেক, ডেনিশ ও জার্মানে bambus, ডাচে bamboe, ফিলিপিনোতে kawayan, ফিনিশে bambu, ফ্রেঞ্চে bambou, ইতালিয়ান, পর্তুগিজ ও স্পেনিশে bamb, মালয়ে buluh ও সোহালিতে mianzi নামে পরিচিত।
আবার যে কোনো উদ্ভিদের চেয়ে প্রতিকূল পরিবেশে বাঁশের টিকে থাকার সামর্থ্য বেশি। ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমাতে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর প্রথম যে সবুজ উদ্ভিদ জন্মেছিল তা ছিল বাঁশ। আবার বাঁশ অনাবৃষ্টি ও বন্যা অবস্থায়ও দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে।
বাঁশ যে শুধু কাউকে বাঁশ দেয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় এটা ঠিক নয়। বাঁশ ব্যবহারের ভালো দিকও আছে। আদিম যুগ হতেই আমাদের দেশে বাঁশের ব্যবহার হয়ে আসছে। বাঁশ দিয়ে ঘর বানানো, ঘরের বেড়া দেয়া, খাল পারাপারের জন্য সাঁকো তৈরি, গৃহস্থালি তৈজস তৈরি, মাছ ধরার জন্য চালন ও সুন্দর সুন্দর মনোরম আসবাবপত্র তৈরি হয়।
অন্যদিকে রাখালের বাঁশের বাঁশির সুরে অনেকে আকুল হন। তারপরও আর্থসামাজিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এনে একজন কলামিস্ট বড়ই আক্ষেপ করে লিখেছেন ‘বাংলাদেশে ঘুষ না দিলে আবার অনেক সময় বাঁশের গুঁতা খেতে হয়’।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের কেরালা রাজ্যের লোকেরা বাঁশের নাম দিয়েছে সবুজ সোনা। পরিবেশবান্ধব এই ফসলটি আজ কেরালার হাজারো মানুষের আয়ের উৎস।
ঘরের মেঝে, আসবাবপত্র, এমনকি দাঁত খোঁচানোর খিলাল বানাতেও ব্যবহার করা হয় বাঁশ। দক্ষিণ ভারতের ঐতিহ্যবাহী শিল্প এটি। এর উৎপাদনকে আরো আধুনিক করতে এখন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে কেরালার রাজ্য সরকার। এতে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে।
তবে বাঁশ যে শুধু টাকাই আনছে, তা নয়। জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতেও জনপ্রিয় হচ্ছে এটি। কেরালার সরকারি ব্যাম্বু করপোরেশন বাঁশশিল্পীদের ১৩ ভাগ পর্যন্ত ভর্তুকি দিচ্ছে। জানা গেছে, অনেক বাঁশকর্মী এখন প্রতিদিন গড়ে প্রায় তিন ডলারের কাছাকাছি আয় করেন।
কেরালার বন গবেষণা সংস্থার বিজ্ঞানী ড. কে. কে. সীতালক্ষী মনে করেন, কার্বন অফসেট শিল্পেও বাঁশের সম্ভাবনা রয়েছে। গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন কমাতে সাহায্য করার একটি প্রকল্প হলো কার্বন অফসেট শিল্প। গাছ লাগানোর মতো এ খাতেও ক্ষতিপূরণ দিয়ে থাকে দূষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
ড. সীতালক্ষী বললেন, কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণের জন্য অন্য যে কোনো গাছের তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর বাঁশ গাছ। তার ভাষায় ‘কার্বন ডাই অক্সাইড’ শোষণের পাশাপাশি এই গাছের সালোক সংশ্লেষণের হারও অনেক বেশি। সেগুন কিংবা ইউক্যালিপটাসের গাছের চেয়েও অনেক বেশি কার্বন শুষে নেয় বাঁশ গাছ। পরিবেশের কার্বন ডাই অক্সাইড কমাতে সাহায্য করে এটি।’
বিশ্বের যে কোনো দেশের মতো বাঁশ বাংলাদেশেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। দেশের বনাঞ্চল ও গ্রামাঞ্চলে বাঁশ জন্মে। এটি গরিবের কাঠ হিসেবে সবার কাছে পরিচিতি পেয়েছে। নির্মাণকাজে, কৃষি উপকরণ, আসবাব তৈরি, কুলা, চালুন, ডালা, ঝুড়ি বানাতে ও কাগজ শিল্পের কাঁচামালের উপাদান হিসাবে বাঁশ ব্যবহার হয়ে আসছে।
অন্যদিকে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত বাঁশের কোঁড়ল বা বাঁশের কচি কাণ্ড একটি উপাদেয় খাবার হিসেবে আমাদের দেশে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে ইতিমধ্যে বাঁশের কোঁড়ল খাবার টেবিলে একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে।
একটি বাঁশের ঝাড় হতে যতগুলো কোঁড়ল বের হয়, তার সবই পূর্ণাঙ্গ বাঁশে পরিণত হয় না। তাই নির্মাণ ও শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য হিসেবে বাঁশের কোঁড়ল উৎপাদনের জন্যও বাঁশের চাষ করা যায়।
অনেকের ধারণা, বাঁশ কোঁড়ল সংগ্রহ করলে বাঁশের ঝাড় ধ্বংস হয়ে যাবে বা নতুন বাঁশ ঝাড়ে উৎপাদন হবে না। এ ধারণা অমূলক। পরিকল্পিত ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে বাঁশের কোঁড়ল আহরণ করলে বাঁশ উৎপাদনে কোনো ব্যাঘাত হয় না। বরং এক পাশ থেকে একটা কোঁড়ল সংগ্রহ করলেই অন্যপাশে নতুন নতুন কোঁড়ল সৃষ্টি হয়।
কোঁড়লের কচি অংশটি সবজি, সালাদ, আচার, স্যুপ ও অন্যান্য উপকরণ যেমন মাছ ও গোশতের সঙ্গে রান্না করে খাওয়া যায়।
বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক জরিপে দেখা গেছে, চার প্রজাতির বাঁশ যথা- মূলি, ওরা, প্যাঁচা ও ফারয়া বাঁশের কোঁড়ল অত্যন্ত সুস্বাদু। এ ছাড়া বরাক, কাটাবাঁশ, মিতিংগা, বাঁইজ্যা ও ভুদুমবাঁশের কোঁড়ল স্বাদে তিতা হলেও সিদ্ধ করে পানি ফেলে খাওয়ার উপযোগী করা যায়।
কিছু কিছু কোঁড়লে সায়ানাইড নামক এক প্রকার বিষাক্ত পদার্থ থাকে। তাই কচি মাংসল অংশগুলো ছোট ছোট টুকরা করে কেটে পানিতে এক থেকে দুই ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে এবং সিদ্ধ করে পানি ফেলে নিরাপদে খাওয়া যায়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক হিসাব মতে, বিশ্বে প্রতিবছর ২ লাখ ৫০ হাজার টন বাঁশজাত খাবার উৎপন্ন হয়, যা প্রতিবছর ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে। আর চীন পৃথিবীর ৩৭টি দেশে প্রতিবছর গড়ে এক লাখ ৩৭ হাজার টন টিনজাত বা প্যাকেটজাত বাঁশ কোঁড়ল রফতানি করে। থাইল্যান্ড থেকেও জাপান, যুক্তরাষ্ট্র প্রচুর বাঁশ কোঁড়ল আমদানি করে। তবে বিশ্ব বাজারে জাপান সর্বোচ্চ (৭০ শতাংশ) বাঁশ কোঁড়ল আমদানি করে থাকে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি প্রতি বছর ৬০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের বাঁশ কোঁড়ল আমদানি করে।
এ ছাড়াও আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সুইডেনে বাঁশের কোঁড়লের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বিশ্ব বাজারে বাঁশ কোঁড়লের ক্রমবর্ধমান এ চাহিদার প্রধান কারণ খাদ্য হিসাবে এর স্বাদ, খাদ্যমান ও ভেষজগুণ।
আমাদের দেশের পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী এবং পার্বত্য এলাকার আশপাশের গ্রামের বাসিন্দারাও আদিকাল থেকে বাঁশ কোঁড়ল তরকারি হিসেবে ব্যবহার করছে। বিশেষত বৃহত্তর সিলেট জেলার মানুষের কাছেও বাঁশ কোঁড়ল একটি প্রিয় খাদ্য।
জানা গেছে, বাঁশকে কাঁচামাল করে উন্নতমানের পণ্য তৈরির প্রযুক্তির বিকাশ ঘটাতে ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ ‘ন্যাশনাল মিশন অন ব্যাম্বু অ্যাপ্লিকেশনস’ নামের একটি প্রকল্প রূপায়িত করছে। এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাঁশকে কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহারকারী গ্যাসিফায়ার তৈরি করা হচ্ছে। এই গ্যাসিফায়ারগুলো বাঁশের বর্জ্য ও অন্য জৈববস্তুপুঞ্জ কাজে লাগাতে পারে। দেশটির যে রাজ্যে প্রচুর পরিমাণে বাঁশ পাওয়া যায় তারা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এই গ্যাসিফায়ারগুলো ব্যবহার করতে পারবে।
আমাদের দেশে গ্রামে বা শহরে বাঁশের তৈরি পণ্যের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বাঁশ দিয়ে এখন বুকশেলফ, ফুলদানি, ওয়ালম্যাট, অ্যাশট্রে, খেলনা সামগ্রী ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে। এসব শৌখিন পণ্য দেশি চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করা যেতে পারে।
উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের তথ্যমতে, প্রতি ৪৮ বছর পর বাঁশ গাছে ফুল ফোটে, ফল ধরে তারপর বাঁশগুলো মারা যায়। তবে সাধারণত পাহাড়ে জঙ্গলে বাঁশগুলো ৪৮ বছর ফুল ও ফল দিয়ে মরে যায় সবার অগোচরে।
বাঁশফল ইঁদুরের সবচেয়ে প্রিয় খাবার। আবার সাপের প্রিয় খাবার ইঁদুর। পাহাড়ে বাঁশফল ধরলে সবার অগোচরে ইঁদুর তার প্রিয় খাবার হিসাবে মহাআনন্দে বাঁশফল খায়। আর ইঁদুর খেতে সাপের প্রাদুর্ভাব বাড়ে।
তবে পরিবেশবান্ধব বস্ত্রশিল্পের বিপ্লব শুরুর পেছনে মুখ্য ভূমিকায় রয়েছে বাঁশ। এর উৎপাদন প্রক্রিয়া দ্রুত অথচ খরচ কম। সবচেয়ে বড় কথা হলো বাঁশ চাষে কোনো কীটনাশকের দরকার নেই। তাই এটার ফেব্রিকস নিরাপদ। এর ফেব্রিকস অনেকটা সিল্কের মতোই।
চাহিদা থাকার কারণে এখন বাঁশ দিয়ে পোশাক, তোয়ালে, ডায়াপার তৈরি হচ্ছে। এছাড়া বাঁশে এমন একটি রাসায়নিক যৌগ শনাক্ত করা হয়েছে, যেটা সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মি থেকে রক্ষা করে মানুষকে। বিশেষভাবে এটা অস্ট্রেলিয়ার জন্য ভীষণ প্রয়োজন, যেখানে স্কিন ক্যান্সারের মাত্রা অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি।
এছাড়া বাঁশের আঁশ ন্যাচারাল, যা তুলার বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু তুলার চেয়েও অনেক বেশি উপকারী। কারণ এই আঁশ অতিবেগুনি রশ্মি থেকে সুরক্ষার পাশাপাশি ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধেও বেশ নির্ভরযোগ্য হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। অন্যদিকে বাঁশ আঁশের তাৎক্ষণিক আর্দ্রতা শোষণ বা পরিশোষণ গুণাগুণ সম্পর্কেও বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকার বিষয়টির দিকে নজর দিলে বাঁশ বাগানের মাথার ওপর নতুন শিল্পের চাঁদ উঠবে।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন