তার অসুস্থতার খবর নিয়ে মার্চের মাঝামাঝি সময়টায় অজস্র গুজব রটে। আর তারপর আচমকাই একটা টুইট। সেই টুইটেই নিজের অসুস্থতার খবর জনসমক্ষে এনেছিলেন অভিনেতা ইরফান খান। আর লুকোছাপা না রেখে সে দিনই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি নিউরোএন্ডোক্রিন টিউমারে আক্রান্ত। চিকিৎসার জন্য তড়িঘড়ি লন্ডনেও পাড়ি দিতে হয়েছিল অভিনেতাকে। এ সংক্রান্ত একটি খবর প্রকাশ করেছে ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা।
কিন্তু তারপর? সব কেমন যেন খেই হারিয়ে ফেলল। কেমন আছেন ইরফান? চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছেন কি? ? রিকভার করছেন কি ? দিনের পর দিন এসব প্রশ্নের কোনও উত্তর মিলছিল না। প্রিয় অভিনেতার একটা খবরের আশায় ছটফট করছিলেন তার ভক্তরা। নীরব ছিলেন ইরফান। মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন তার ঘনিষ্ঠরাও। আদতে বিষয়টা একটু গোলমেলে। আসলে ইরফানের শারীরিক অবস্থা নিয়ে যাতে কোনও রকম গুজব না ছড়ায় তার আদ্যপান্ত চেষ্টা করেছিলেন তার প্রিয়জনেরা।
শেষ পর্যন্ত কথা রাখলেন ইরফান। নিজের মুখেই বলেছিলেন তিনি কেমন আছেন, অনুরাগীদের সেই আপডেট দিতে থাকবেন। অবশেষে মুখ খুললেন ইরফান খান। শোনালেন যন্ত্রণার সঙ্গে লড়াই করার কাহিনি।
লর্ডসের দর্শকাসনে পাকিস্তান-ইংল্যান্ডের ক্রিকেট ম্যাচ উপভোগ করছেন ইরফান
সংবাদ সংস্থাকে ইরফান বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরেই আমি নিউরোএন্ডোক্রিন ক্যানসারে আক্রান্ত। শব্দটাই আমার কাছে একেবারে আনকোরা। রোগটাও বিরল। এতটাই বিরল যে এর কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতিও নেই। খানিকটা অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতই এগিয়েছে আমার চিকিৎসা।’
এতদূর তো জানাই ছিল। তার পর...
ইরফান বলেন, ‘খুব দ্রুতগামী একটা ট্রেনে উঠে পড়েছিলাম। ছিল স্বপ্ন, একগাদা ভাবনা, উচ্চাকাঙ্খা। পরিকল্পনাও ছিল হাজারো। আর এই সবের মধ্যেই আমি বুঁদ হয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎই কে যেন পিছন থেকে ডাকতে লাগল। ঘুরে দেখি, এ যে টিকিট পরীক্ষক। বলেন ‘তোমার গন্তব্য চলে এসেছে। এবার যে নেমে যেতে হবে।’ আমি তো অবাক, হতভম্ব। বললাম আমার গন্তব্য এখনও আসেনি। তিনিও নাছোড়বান্দা। আবারও বললেন ‘না এটাই তোমার গন্তব্য।’ এই আকস্মিকতা আমাকে একটা জিনিস পরিষ্কার করে দিয়েছিল। মানুষ নিতান্তই একটা কর্ক, যাদের অনিশ্চিত কিছু স্রোতের সঙ্গে ভেসে ভেসে যেতে হয়। আর মানুষ সর্বক্ষণ মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে ওই অযাচিত স্রোতকে নিজের কব্জায় রাখার।’
ইরফান কোনওদিনই মেথড অ্যাক্টিংয়ের ধার ধারেন না
তিনি যে নিউরোএন্ডোক্রিন টিউমারে আক্রান্ত, তা জানার পর থেকেই ইরফানকে দেখা গেছে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেশ বিদেশের লেখকদের লেখা শেয়ার করতে। কখনও রাইনার মারিয়া রিলকের কবিতা। তো কখনও আবার মার্গারেট মিশেলের লেখা দু-চার লাইন। কিন্তু এমন ইরফানের সঙ্গে ভক্তদের কিন্তু আগে পরিচয় হয়নি।
অকপট ইরফান আরও যোগ করলেন, ‘ছেলে যখনই হাসপাতালে আসত, ওকে বার বার বলতাম ঘাবড়ে যেন না যাই বাবা! ভয় যেন আমাকে একঘরে না করে দেয়। আর ঠিক তার পরেই সেই যন্ত্রণার না বলে কয়ে আগমন। এতদিন তো যন্ত্রণা বিষয়টা জানতাম। আর এখন পরিচয় হল তার সঙ্গে। কাছ থেকে তাকে দেখলাম। জানতাম তার প্রকৃতি, তার ভয়াবহতা। কোনও সান্ত্বনা, কোনও প্রার্থনা— কিছুই সেইসময়ে কাজ করছিল না। ঈশ্বরের থেকেও যেন বড় হয়ে উঠছিল যন্ত্রণা।’
মে মাসের শেষের দিকে টুইটারে পাকিস্তানি সাংবাদিকের পোস্ট করা একটি ছবি নিয়ে আবার হৈ হৈ রব ওঠে। লর্ডসের দর্শকাসনের একটা ছবি। একটু ভাল করে লক্ষ্য করলেই ইরফানের মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠবে। মাথা ঢাকা ওড়নায়, সহাস্য মুখে ইরফান উপভোগ করছেন ইংল্যান্ড-পাকিস্তান টেস্ট ক্রিকেট।
হাসপাতালের প্রসঙ্গও উঠে এল ইরফানের কথা প্রসঙ্গে। বলেন, ‘যন্ত্রণায় যখন কাহিল, লন্ডনের হাসপাতালে ছুটতে হল অগত্যা। বুঝতে পারলাম ক্রিকেটের লর্ডস স্টেডিয়ামের উল্টো দিকেই আমার হাসপাতালটা। যন্ত্রণার মাঝেই আবছা চোখে ভিভিয়ান রিচার্ডসের পোস্টারটা নজরে এল। দেখি, আমার দিকে তাকিয়ে তিনি হাসছেন। তবে হাসপাতালে আমার রুমটার বাইরে দাঁড়ালেই একটা অদ্ভুত অনুভূতি হত। মনে হত, জীবন আর মৃত্যুর এই যে খেলা তার মাঝে শুধু একটাই রাস্তা চলে গেছে। এক দিকে হাসপাতাল, আরেকদিকে স্টেডিয়াম। হাসপাতালের এই অদ্ভুত লোকেশন আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। সে সময়ে আমার কাছে নিশ্চিত ছিল শুধুই অনিশ্চয়তা। আমার এই খেলাটা চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না।’
দিনকয়েক আগে পরিচালক সুজিত সরকার ইরফানের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন বলে শোনা গিয়েছিল। সংবাদমাধ্যমকে সুজিত তখন বলেছিলেন ‘ইরফান দ্রুত রিকভার করছেন। খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়।’
তবে ইরফান বলেন, ‘হাসপাতাল নিয়ে আমার ওরকম ভাবনা আমাকে বাধ্য করেছিল পুরোদমে আত্মসমর্পণ করতে। সামনে কী আছে, ভবিতব্য কী, তা না জেনেই। চার মাস, আট মাস নাকি দুবছরে সেরে উঠব তা-ও জানি না।’
ইরফান কোনওদিনই মেথড অ্যাক্টিংয়ের ধার ধারেন না। চরিত্রের সঙ্গে রীতিমতো যাপন করেন। কাজ করতেও তাদের সঙ্গেই ভালবাসেন, যারা তাকে স্বাধীন ভাবে চরিত্রটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে দেন। কিন্তু স্ক্রিপ্টের বাইরে তার নিজের স্বাধীনতা?
ইরফান বলেন, ‘প্রথমবারের জন্য টের পেলাম স্বাধীনতা আসলে কী? আর এটাই আমার কাছে সবচাইতে বড় প্রাপ্তি। মনে হচ্ছিল জীবনের স্বাদ যেন আমি এই প্রথম বার চেখে দেখছি। জীবনকে চিনতেও পারলাম এই প্রথম বার।’
‘আমার এই গোটা জার্নিটায় বহু মানুষ আমার জন্য প্রার্থনা করেছেন। তাদের কেউ আমার চেনা, অনেকেই অচেনা। পৃথিবীর কোনও এক কোণে, কোনও এক প্রান্তে, যেখানে যারা আমার জন্য প্রার্থনা করছিলেন, তাদের সকলের প্রার্থনাই যেন আমার জন্য এক হয়ে গিয়েছিল।সব প্রার্থনা একাকার হয়ে একটা অন্যরকম শক্তির যোগান দিচ্ছিল আমাকে। সেই শক্তিই আমাকে বার বার বলছিল যে লড়াইটা চালিয়ে যেতেই হবে’। বলেন ইরফান।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন