মুহাম্মাদ ইবনে জাবির আল-বাত্তানি (৮৫৮-৯২৯ খ্রি.), আবুল ওয়াফা (৯৪০-৯৯৭ খ্রি.), বিখ্যাত দার্শনিক আল-কিন্দী (৮৭৪ খ্রি.), আল-বালাখী (৮৮৮ খ্রি.), আল-সারাখামী (৮৮৮ খ্রি.), নাসিরুদ্দীন তুসী এবং আরও অনেক মুসলিম বিজ্ঞানী গণিতশাস্ত্রের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার ওপর মৌলিক অবদান রেখে গেছেন। গণিতশাস্ত্র বিজ্ঞানের মূল ভিত্তি। এ বিজ্ঞানেই যখন মুসলিম বিজ্ঞানীরা অবদান রেখে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কারক ও বিজ্ঞানী হতে পেরেছেন তখন বিজ্ঞানকেও সমৃদ্ধ ও আলোকিত করেছিলেন তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। মুহাম্মাদ ইবনে মূসা আল-খাওয়ারিজমী পৃথিবীতে প্রথম বীজগণিতের জন্মদাতা। সে সময়ে তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম গণিতজ্ঞ ছিলেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানেও মুসলমানদের অসামান্য অবদান রয়েছে। আল-রাযী মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম এবং সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিদ ছিলেন। তিনি তরুণ বয়সে আলকেমী চর্চা করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তার খ্যাতি যখন পশ্চিম এশিয়ার সব অঞ্চলের শিষ্য ও রোগী আকর্ষণ করে তখন তিনি একান্তভাবে চিকিৎসাশাস্ত্রে আত্মনিয়োগ করেন। তার জ্ঞান ছিল ব্যাপক এবং বৈজ্ঞানিক অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। তিনি ২০০টিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেন, যার অর্ধেক চিকিৎসা সংক্রান্ত।
মহানবী (সা.) চিকিৎসা বিজ্ঞানে মুসলিম জাতিকে উৎসাহিত করে বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা এমন কোনো রোগ দেননি যার ওষুধ তৈরি করেননি। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক রোগের জন্য ওষুধ রয়েছে। সুতরাং সঠিক ওষুধ যখন রোগের জন্য ব্যবহৃত হয়, তখন আল্লাহর হুকুমে রোগী রোগমুক্ত হয়ে যায়’। তিনি আরও বলেন, ‘জ্বরের উৎপত্তি জাহান্নামের তাপ হতে। সুতরাং তোমরা পানি থেকে নিয়ে তা ঠাণ্ডা কর’। জ্বরে পানি ও বরফের ব্যবহার বর্তমানে বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত এবং এটি একটি সাধারণ ব্যবস্থা। জ্বর বেড়ে গেলে মাথায় পানি ঢেলে কিংবা আইস-ব্যাগ লাগিয়ে তাপ নিবারণ করা একটি ডাক্তারি বিধান। সুতরাং এ কথা মানতেই হবে যে, নবী করিম (সা.)-এর এ বাণী আধুনিককালের চিকিৎসা শাস্ত্রেও গ্রহণীয়।
মহানবী (সা.) আরও বলেন, ‘কালোজিরার মধ্যে মৃত্যু ছাড়া সব রোগের প্রতিষেধক রয়েছে’। এ কালোজিরা বহু রোগের প্রতিরোধক হিসেবে বর্তমানে স্বীকৃত। যেমন কটু অম্ল, রস ও উষ্ণবীর্য এবং আদোষ, ক্রিমি, অপান বায়ুর উদার্যতা, উদররোগ, হৃদরোগ ও অর্শরোগে হিতকর। এভাবে আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় আমরা মুসলিম বৈজ্ঞানিকদের অবদান দেখতে পাই। যেমন পৃথিবীতে প্রথম বন্দুক তৈরি ও উন্নত ধরনের বারুদের ব্যবহার মুসলমানদের মাধ্যমেই হয়। সিরিয়ার মুসলমানরা পৃথিবীতে সর্বপ্রথম চিনি তৈরি করেন এবং আরবি ‘সাকার’ (অর্থ চিনি) নাম তাদেরই দেয়া। তার থেকেই ইংরেজি ‘সুগার’ শব্দ উদ্ভূত।
জলের গভীরতা ও সমুদ্রের স্রোত-মাপক যন্ত্রের আবিষ্কারক ইবনে আবদুল মজীদ নামক মুসলমান। ৭০২ খ্রি. তুলা থেকে তুলট কাগজ প্রথম তৈরি করেন ইউসুফ ইবনে ওমর। তার দু’বছর পর বাগদাদে কাগজের কারখানা তৈরি হয়। খলিফা হারুনুর রশীদের যুগে মুসলিম বিজ্ঞানীরাই সর্বপ্রথম জলঘড়ি তৈরি করেন। প্রথম পানি জমিয়ে বরফ তৈরি করাও মুসলিম বিজ্ঞানীদের অমর কীর্তি। ইউরোপ তার অনেক পর নিজের দেশে বরফ প্রস্তুত কারখানা চালু করে। মুসলিম আমলে স্পেনে সব ধরনের চাষাবাদ করা হতো। ভবিষ্যতের জন্য স্পেনে সব সময়ই খাদ্য সংগৃহীত করে রাখা হতো। এসব খাদ্য সংগ্রহ করার জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরকারি খাদ্যগুদাম ছিল। সেই আমলে কর্ডোবা, সেভিল, গ্রানাডা, সারাগোজা, টলেডো প্রভৃতি জায়গায় বড় বড় গুদাম তৈরি করা হয়। টলেডো এবং গ্রানাডার আবহাওয়া শস্য রক্ষার অত্যন্ত অনুকূল ছিল। পাহাড়ের গায়ে তৈরি এসব গুদামের (কোল্ড স্টোরেজ) শস্য ৫০ থেকে ৭০ বছর পর্যন্ত অবিকৃত থাকত (যা আধুনিক যুগেও প্রায় অসম্ভব)। শুকনো ফলমূল ১০ বছর পর্যন্ত রাখা যেত। গ্রানাডা অধিকারের দু’শ বছর পরও সেখানকার এক গুদামের শস্য সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের বিখ্যাত ঐতিহাসিকদের লিখিত ইসলামের অবদান সম্পর্কে অধ্যয়ন করলে আমরা স্বাভাবিকভাবেই বুঝতে পারি যে, বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে মুসলমানদের দান অপরিসীম। ঐতিহাসিক গীবন তার ‘উবপষরহব ধহফ ভধষষ ড়ভ জড়সধহ ঊসঢ়রৎব’ গ্রন্থে বলেন, লন্ডনের রাস্তা যখন অন্ধকারে ডুবে থাকত, কর্ডোভার রাস্তা তখন আলোয় উদ্ভাসিত থাকত। ড্রেপার, গিজা ডেভেনপোর্ট, লেইনপুল, সার্টন, হিট্টি প্রমুখ পাশ্চাত্য খ্রিস্টান ঐতিহাসিক বিশ্বসভ্যতার অগ্রগতিতে মুসলিম অবদানের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন।
এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত ঐতিহাসিক মন্তব্য করেন, অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত আরবি ভাষাভাষী লোকেরা সমগ্র বিশ্বের বুদ্ধি ও সভ্যতার আলোকবর্তিকা ছিলেন। তাদের মাধ্যমে প্রাচীন বিজ্ঞান এবং দর্শন পুনরুজ্জীবিত, সংযোজিত ও সম্প্রসারিত হয়। যার ফলে পশ্চিম ইউরোপে রেনেসাঁর উন্মেষ সম্ভবপর হয়। একজন গবেষক হাজার বছর পূর্বের মুসলিম স্পেনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, আটটি বড় শহর ও তিন হাজারের বেশি ছোট ছোট শহর কর্ডোভার অধীনে ছিল। প্রতি বছর রাজস্ব পাওয়া যেত আঠারো কোটি পঁচাত্তর লাখ টাকা। শহরের প্রত্যেকটি রাস্তার ধারে রাত্রে সরকারি বাতি জ্বলত। অথচ এর সাতশ’ বছর পরেও লন্ডনের রাজপথে কোনো বাতির চিহ্ন ছিল না। রাজ কর্মচারীদের প্রাসাদ ছাড়াও সাধারণ লোকদেরই ১ লাখ ১৩ হাজার প্রাসাদ, ৩ হাজার ৮০০ মসজিদ, ৯০০ স্নানাগার ও ৪ হাজার দোকান ছিল। আধুনিক কোনো ইউরোপীয় শহরও এত সমৃদ্ধশালী কিনা তা সন্দেহের বিষয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন